জুতা যখন নিছক স্টাইল নয়

কানাডায় অর্থমন্ত্রীদের বাজেট অধিবেশনে নতুন জুতা পরাও একটা রীতি হতে পারে, তা আমরা কজনই–বা জানি। অথচ এটাই প্রথা কানাডায়। এই ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় বাজেটে মূল লক্ষ্য। সে দেশে ইতিহাসের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রীর বাজেটের জন্য কেনা নতুন জুতাও স্পষ্ট করেছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বাজেট বই হাতে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডছবি: রয়টার্স

পৃথিবীতে প্রথার কোনো শেষ নেই। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রথা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আছে সব দেশেই। তবে কানাডার সরকারি বাজেট পেশ করার দিনে সে দেশের অর্থমন্ত্রীকে নতুন জুতা পায়ে দিয়ে বাজেট অধিবেশনে যাওয়ার ঐতিহ্যবাহী রীতিটি সত্যিই একেবারে আলাদা।

১৯৬০ সালে অর্থমন্ত্রী ডোনাল্ড ফ্লেমিংয়ের হাত ধরেই হয়েছিল এই রীতির সূচনা
ছবি: উইকিপিডিয়া

সেই ১৯৬০ সালে কানাডার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ডোনাল্ড ফ্লেমিংকেই প্রথম দেখা যায় এক জোড়া ঝকঝকে নতুন জুতা পরে বাজেট পেশ করতে। তখন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপারটি বেশ ফলাও করেই প্রচার করা হয় এবং এরপর থেকেই এ বাজেট অধিবেশনে কানাডার অর্থমন্ত্রীদের নতুন জুতা পরার বিষয়টি একটি ফ্যাশন ঐতিহ্য হয়ে ওঠে। প্রতিবছর না হলেও প্রায় বছরই অর্থমন্ত্রীরা বেশ ঘটা করে বাজেটের জন্য নতুন জুতা কিনেছেন এবং পরেছেন, অন্তত ইতিহাস সেটাই জানাচ্ছে।

তবে লক্ষণীয় ব্যাপারটি হলো এই বাজেট উপলক্ষে কেনা জুতা কিন্তু সমকালীন কানাডার অর্থনৈতিক অবস্থা, সে ব্যাপারে কানাডা সরকারের স্ট্র্যাটেজি, বাজেটের মূলমন্ত্র—এসব কিছুরই প্রতিনিধিত্ব করত। যেমন ১৯৭৯ সালে জো ক্লার্ক এস্কিমো বুটের মতো ‘মুকলুক’ জুতা পরে বাজেট অধিবেশনে গিয়েছিলেন কানাডার নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে।

পল মার্টিন
ছবি: উইকিপিডিয়া

১৯৯৪ সালে পল মার্টিন একেবারে কেজো ডিজাইনের ওয়ার্ক বুটস পরেছিলেন কানাডার জনশক্তির উন্নতি ঘটানোর কামনায়। আবার ২০০৮ সালে কানাডার বিখ্যাত অর্থমন্ত্রী জিম ফ্ল্যাহারটি নতুন জুতা না কিনে পুরোনো জুতা মেরামত করিয়ে নিয়েছিলেন এই বার্তা দিতে যে এই অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে কানাডা সরকার বিলাসিতা চায় না।

র‍্যাল্ফ গুডেল
ছবি: উইকিপিডিয়া

বেশির ভাগ সময়েই অর্থমন্ত্রীরা ফরমাল ড্রেস শু–ই বেছে নিয়েছেন বাজেট জুতা হিসেবে। যেমন ২০০৪ সালে র‍্যাল্ফ গুডেল পরেছিলেন নতুন চকচকে অক্সফোর্ড শুজ কানাডার অর্থনীতিতে চমক আনার প্রত্যয় নিয়ে। আবার ২০০৫ সালে তাঁর পায়ে শোভা পেয়েছিল বিখ্যাত একো কোম্পানির একেবারে কেতাদুরস্ত স্কোয়ারটো ফরফাল জুতা। হাসির ছলে সেই জুতা টেবিলে তুলে রীতিমতো প্রদর্শনও করেছিলেন তিনি মিডিয়ার সামনে।

এরপরে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে কানাডার জাঁদরেল অর্থমন্ত্রী জিম ফ্ল্যাহার্টি একেক বছরের বাজেট অধিবেশনে একেক রকম ফরমাল জুতা পরেছেন। ২০০৮ সালে অবশ্য তিনি সুকতলা বা সোল মেরামত করে ‘ব্রোগ’ স্টাইলের জুতা পরেছিলেন, যা কিনা ড্রেস শুজের মতো অত ফরমাল নয়, কিছুটা ক্যাজুয়াল ও আরামদায়ক স্টাইলের।

জিম ফ্ল্যাহার্টি
ছবি: উইকিপিডিয়া

২০১১ সালেও তিনি সারিয়ে নিয়ে পুরোনো ড্রেস শুজ পরেছেন কানাডার অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে কৃচ্ছসাধনের ইঙ্গিত দিয়ে। আবার ২০১২ ও ২০১৩ সালেও জিম ফ্ল্যাহার্টি একেবারে ঝাঁ–চকচকে আটোসাঁটো, খাঁটি চামড়ার তৈরি লেস আপ অক্সফোর্ড শু পরে বাজেট পেশ করেছেন চাঙ্গা অর্থনীতির খুশিতে।

জো অলিভার
ছবি: উইকিপিডিয়া

জিম ফ্ল্যাহার্টির প্রয়াণের পরে নতুন অর্থমন্ত্রী জো অলিভার ২০১৫ সালে কানাডার বাজেটে ভারসাম্যের কথা বোঝাতে পরেছিলেন ‘নিউ ব্যালান্স’ কোম্পানির রানিং শুজ বা স্নিকার্স। তাঁর এই বুদ্ধিদীপ্ত জুতা নির্বাচন বেশ আলোচনায় এসেছিল সেবার।

এরপর পরবর্তী অর্থমন্ত্রী বিল মরনো কিন্তু এই নতুন বাজেট জুতার ঐতিহ্যটিকে একটি বৈপ্লবিক রূপ দিলেন এবং অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করলেন কানাডার নিজস্ব শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কাজে । নিজস্ব কাঁচামালে তৈরি একেবারে কানাডিয়ান ডিজাইনার ও কারিগরদের বানানো জুতা পরার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে কানাডিয়ান জুতা ডিজাইনার রন হোয়াইটের বানানো লেস দেওয়া ফিটফাট ড্রেস শুর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করেছিলেন তিনি শিশুদের কল্যাণধর্মী কিওয়ানিজ বয়েজ অ্যান্ড গার্লস ক্লাবের বাচ্চাদের উপস্থিতিতে।

আবার ২০১৭ সালে বিল মরনোর বাজেট জুতা জোড়া ছিল মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়গানের প্রতীক। কানাডিয়ান উদীয়মান নারী উদ্যোক্তা দুই বোনের ব্র্যান্ড পপি বার্লি থেকে নেওয়া তাঁর জুতাজোড়া কানাডার ডিজাইনেই মেক্সিকোতে প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিপিং ব্যবস্থায় পাঠানো হয়েছিল। এথিকাল ম্যানুফ্যাকচারিং বা অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে বিপণন পর্যন্ত পরিবেশ, বন্য প্রাণী ও কোনো এলাকার মানুষের কোনো রকম শারীরিক বা সামাজিক ক্ষতি না করার মূলনীতি অনুসরণ করায় তিনি পরপর দুই বছর এই পপি বার্লির জুতাই পরেছেন। গরুর চামড়ায় তৈরি কালো রঙের এই ডার্বি জুতা যেন কানাডার অর্থনীতিতে স্থানীয় নারী উদ্যোক্তাদের জয়রথের বিজয়গাথা হয়েছিল।

বিল মরনো
ছবি: উইকিপিডিয়া

আবার এদিকে ২০১৯ সালে সেই বাচ্চাদের ক্লাবের সদস্যদের কলকাকলির মধ্যেই হাস্যোজ্জ্বল বিল মরনো মোড়ক খুলে সোল বদলানো মেরামত করা এক জোড়া পলিশ করা কালো ড্রেস শুজ বের করে সবাইকে অবাক করে দেন। তারপরই তিনি শোনান নতুন বাজেটে কানাডিয়ান পিপল ওয়েলফেয়ার বা কানাডার মানুষের কল্যাণে বড় বরাদ্দের পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই জুতা জোড়াকে সামনে আনা।

এরপর পুরো নতুন বাজেটে জুতার ফ্যাশন ঐতিহ্যের ব্যাপারটিতে একেবারে অন্য রকম এক আবেদন এনে দিয়েছেন কানাডার প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড।
তাঁকে নিয়ে নানা মহলের কৌতূহল ছিল অন্য কারণে। প্রথমত কানাডার ইতিহাসে প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী জাতীয় বাজেট দিচ্ছেন, যিনি একসময় ছিলেন ডাকসাইটে সাংবাদিক।

নতুন জুতা পরে গতকাল বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড
ছবি: কানাডীয় ফটোগ্রাফার ডেভ চেনের টুইটার হ্যান্ডল থেকে

রয়টার্সের ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতিতে আসা ক্রিস্টিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষ করে এখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন, একই সঙ্গে আছেন উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। সংসদ স্থগিত করে দিয়ে নতুন যাত্রার পর লিবারেল সরকার কোনো বাজেট পেশ করেনি। গত দুই বছরে এটিই তাদের প্রথম বাজেট। ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর এটি হচ্ছে তাঁর প্রথম বাজেট। কানাডার ইতিহাসে কোনো নারী অর্থমন্ত্রীর দেওয়া প্রথম বাজেটও এটি।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে ভার্চুয়াল সংলাপে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড
ছবি: রয়টার্স

নিজের নামের প্রতি পুরোপুরি সুবিচার করা এই মুক্তমনের অধিকারী ও অত্যন্ত প্রভাবশালী নারী রাজনীতিক একেবারে হালের প্রথা মেনে রীতিমতো বাজেটের জন্য কেনা নতুন জুতার আনবক্সিং বা মোড়ক উন্মোচনের ভিডিও দিয়েছেন তাঁর টুইটারে।

এমনিতেও প্রথম নারী অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেটের জুতা কেমন হবে, তা নিয়ে আগ্রহের শেষ ছিল না কানাডিয়ানদের মধ্যে। তার ওপর এই ভিডিও ফ্রিল্যান্ডের বাজেটের জুতা জোড়াকে নিয়ে এসেছে বিশ্বব্যাপী আলোচনার শীর্ষে। আর ঠিক এই সুযোগের মাধ্যমেই কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড তুলে ধরতে চেয়েছেন কানাডার অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের উজ্জ্বল ভূমিকাকে।

অত্যন্ত স্টাইলিশ আর অভিনব কালো রঙের এই পাম্প শুর ডিজাইনার এল আইয়ুবজাদেহ আবার পারস্য বংশোদ্ভূত। তাঁর ব্র্যান্ডের নাম ভাজেল। এই জুতা কোম্পানি টরন্টোয় যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৫ সালে। অপেক্ষাকৃত নতুন ও ক্ষুদ্র একটি কোম্পানি থেকে বাজেট অধিবেশনের জুতা কেনার পর তিনি ফোন করেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর এল আইয়ুবজাদেহকে।

নিজের আউটলেটে এল আইয়ুবজাদেহ
ছবি: এল আইয়ুবজাদেহ ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

খানিকটা উল্টা করে রাখা পার্সি পাঁচ সংখ্যাটির প্যাটার্ন রয়েছে রায়না নামের এই জুতার ডিজাইনে, এমনটাই তিনি বলেছেন। তাই অভিবাসীদের প্রতি সমান গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের ব্যাপারে নব প্রত্যয়ের হাতছানি দেখি আমরা ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের বাজেটের জন্য কেনা নতুন জুতা জোড়ায়। আর সেই সঙ্গে দেশীয় কাঁচামালে তৈরি দেশীয় ডিজাইনকে তুলে ধরার ব্যাপারটি তো আছেই।

আরও রয়েছে টরন্টোর ডাউন টাউনে তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে বাজেট অধিবেশনের জন্য জুতা কেনার বিষয়টি। ২৯৫ ডলার দিয়ে তিনি ‘রায়না’ নামের এই জুতা জোড়া কিনে সমর্থন দিলেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের। কারণ, তিনি কোভিড থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধারের কর্মসূচিকে ‘ফেমিনিস্ট রিকভারি’ হিসেবে আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন।

শু আনবক্সিং
ছবি: ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

তাই তো তিনি বেছে নেন ছোট প্রতিষ্ঠানে তৈরি কানাডার ওয়ার্কিং উইম্যানদের পায়ে দেওয়ার জুতা। এর মধ্যে দিয়ে আরও গুরুত্ব পান একজন নারী উদ্যোক্তা, নারী ডিজাইনার তথা অভিবাসী। এ প্রতিষ্ঠানের স্লোগানই হলো ‘ওয়াক হাউ ইউ ওয়ান্ট’, অর্থাৎ তুমি যেভাবে চাও, সেভাবেই হাঁটো।

এই সেই জুতা
ছবি: ছবি: ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

ফ্যাশন দুনিয়ায় এখন যে নতুন জোয়ারটি এসেছে, তা হলো নিছক ফ্যাশনের জন্য যেন ফ্যাশন না হয়। ফ্যাশনের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ, এথিকাল বা নৈতিক শিল্পপ্রক্রিয়া, মানবকল্যাণ আর বিশ্বশান্তির বার্তা দিতে পারাটাই সত্যিকারের ফ্যাশন আইকনদের সার্থকতা। আর বাজেটের জন্য কানাডার অর্থমন্ত্রীদের নতুন জুতার ঐতিহ্যবাহী প্রথাটি এদিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে আছে, এ কথা বলাই যায়।