শাহরুখের কাছে ঈদের পোশাক মানেই পাঠানি বা শেরওয়ানি

আজ ঈদ। বরাবরের মতো আজও হয়তো আলোর রোশনাই ছড়াবে শাহরুখ খানের ‘মন্নত’-এ। তবে বাড়ির সামনে হাজার হাজার অনুরাগী উন্মাদনার থাকবে না করোনার কারণে চলমান লকডাউনে।

ঈদের দিন প্রতিবারের মতো এবারও হয়তো আলোয় ঝলমলিয়ে উঠবে শাহরুখ খানের ‘মন্নত’। তবে তাঁর বাড়ির সামনে হাজার হাজার অনুরাগীর সেই উন্মাদনার ছবি এবার আর ধরা পড়বে না। কারণ, করোনার কারণে এখন মুম্বাই, তথা মহারাষ্ট্রজুড়ে লকডাউন চলছে।

ছেলে আরিয়ানের সঙ্গে শাহরুখ

ঈদ মানেই সাদা অথবা কালো পাঠানি বা শেরওয়ানিতে নিজেকে সাজিয়ে তোলেন বলিউডের বাদশাহ শাহরুখ খান। ঈদে শাহরুখ শেরওয়ানি বা পাঠানি পরতে বেশি পছন্দ করেন। আর এই বেশেই ভক্তদের সামনে হাজির হন তিনি। সেলাম দিয়ে আর ভালোবাসার চুম্বন ছুড়ে কিং খান তাঁর অনুরাগীদের জানান ঈদের শুভেচ্ছা। পুরো খান খানদান এদিন সেজে ওঠে উৎসবের সাজে। চুড়িদার নয়, ঘেরওয়ালা পাটিয়ালা পরতে ভালোবাসেন শাহরুখ। একবার ঈদে আরিয়ানকে শেরওয়ানি পরানোর ইচ্ছা হয়েছিল তাঁর। তাই তিনি তাঁর প্রিয় ডিজাইনার নরেশকে ডেকে পাঠান। কিং খান এবং তাঁর ছেলের জন্য কালো রঙের একই মেটেরিয়ালের শেরওয়ানি বানিয়ে দেন নরেশ। শাহরুখের দূরন্ত ফ্যাশন ট্রেন্ড হামেশাই মুগ্ধ করেছে সবাইকে। তিনি আজ যা পরেন, কাল সেটাই ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়ায়।

এদিন ছিল ডাবল ধামাকা। শাহরুখ খানের জন্মদিন, আবার তাঁর ‘জিরো’ ছবির ট্রেলার লঞ্চ। মুম্বাইয়ের ওয়াডালার আইম্যাক্সে সংবাদমাধ্যমের জন্য এলাহি আয়োজন। বলিউডের বাদশাহর ৫৩তম জন্মদিন বলে কথা। সংবাদ সম্মেলনে শাহরুখের পাশে দুই বলিউড রূপসী—আনুশকা শর্মা আর ক্যাটরিনা কাইফ। ক্যাটরিনা এদিন পরে ছিলেন স্লিভলেস লং ওয়েস্টার্ন ফ্রক, আর তার ওপর ডেনিম জ্যাকেট। হঠাৎই কিং খান ক্যাটরিনার গা থেকে জ্যাকেট খুলে নিজে পরে নিলেন। আর দুষ্টু হাসি হেসে ক্যাটরিনার উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘নারীর সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখা ঠিক নয়।’ সেদিন সেই মেয়েলি ডেনিম জ্যাকেট পরেই শাহরুখ অবলীলাক্রমে সংবাদ সম্মেলন করলেন। তিনি এ রকমই। ফ্যাশনের যেকোনো ধারা তিনি অনায়াসে বহন করতে পারেন। আর বলিউডের বাদশাহ আজ যেটা পরেন, এ প্রজন্ম তা অনুসরণ করে। তবে সেদিন শাহরুখের গামছা প্রিন্টের সুতির শার্ট ফ্যাশন দুনিয়ায় রীতিমতো ঝড় তুলেছিল। বলিউডের বাদশাহর কালো প্যান্টের ওপর লাল ‘গামছা শার্ট’-এর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর তাঁর ‘গামছা ফ্যাশন’ রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

একটি অনুষ্ঠানে কাজল ও করণ জোহরের সঙ্গে শাহরুখ

প্রায় বছর দুই আগে করণ জোহর আয়োজন করেছিলেন তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর ২০ বছরের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। মুম্বাইয়ের এক পাঁচতারা হোটেলে সেই জমকালো রাতে কথায় কথায় উঠে আসে সুপারহিট এই ছবিতে শাহরুখের সেই রঙিন টাইট টি-শার্ট আর জেল লাগানো চুলের কথা। তখন বলিউডের বাদশা তরুণ প্রজন্মের কাছে ফ্যাশনের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন। এমনকি বলিউড অভিনেতা সিদ্ধার্থ মালহোত্রা শাহরুখের সেই ট্রেন্ড অনুসরণ করেছিলেন বলে জানান সেই রাতে। অভিনেতা বরুণ ধাওয়ান আজও চুলে জেল লাগাতে ভোলেন না ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’-এর রাহুলের মতো। রাজ কাপুর, দেবানন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ, মিঠুনের মতো তারকাদের পাশে শাহরুখ ‘ট্রেন্ড সেটার’ হিসেবে অনায়াসে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন।

আজ তিনি যেটা পরেন, কাল সেটাই ফ্যাশন। এর আগে তাঁর ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ ছবির সেই টুপি আর সানগ্লাস রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ছবিতে শাহরুখের ‘লুঙ্গি ড্যান্স’-এর প্রেমে পড়েছিলেন ৯ থেকে ৯০ বছর বয়সীরাও। এখন তাঁর ‘পাঠান’ ছবির লুক মুগ্ধ করছে সবাইকে। লম্বা চুলে ‘পনি’ বেঁধে এক নতুন ট্রেন্ড এনেছেন তিনি। চুলের স্টাইলেও নিত্যনতুন ধারা এনেছেন বলিউডের এই সুপারস্টার। কখনো ব্যাক ব্র্যাশ করা লম্বা চুল, আবার কখনো জেল লাগানো স্পাইক চুল, কখনোবা তাঁর কপালের ওপর পরে থাকা অবিন্যস্ত চুল বাজিমাত করেছে।

এক সাক্ষাৎকারে শাহরুখ বলেছেন, ‘সিনেমাতে আমি এমন পোশাক পরতে চাই না, যেটা ফ্যাশনেবল। আমাকে এমন পোশাক পরানো হোক, যেটা ছবির মুক্তির পর ফ্যাশন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়াবে।’

পর্দাতে শাহরুখ নানান এক্সপেরিমেন্ট করতে কখনো ভয় পাননি। তবে পর্দার বাইরে সাদামাটা থাকতেই ভালোবাসেন বলিউডের এই বাদশাহ। নীল রঙের ডেনিমের ওপর সাদা বা কালো শার্ট পরতে সবচেয়ে পছন্দ করেন তিনি। আর শার্টের কিছুটা অংশ খোলা থাকে, আর কিছুটা অংশ গোঁজা। বলিউডের এই সুপারস্টারকে কখনো শর্টস এবং চটি পরে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। শোনা গেছে, আজ থেকে ২৫ বছর আগে তাঁর শরীরের যে মাপ ছিল, আজও তা একই আছে। মাঝেমধ্যে সিনেমাতে চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের শরীরকে তিনি ভাঙচুর করেছেন।

শাহরুখের ক্যারিয়ারের শুরুর দিন থেকে তাঁর প্রিয় ডিজাইনার নরেশ রোহিরা। নরেশের ডিজাইন করা কালো স্যুট পরে বলিউডের বাদশাহ বিয়ে করেছিলেন। নরেশ নিজের হাতে ডিজাইন করে এই স্যুট দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন। আর তাঁর খুবই পছন্দ হয়েছিল নরেশের ডিজাইন করা কালো ‘টাক্সিডো’। এরপর কিং খান এই ডিজাইনারকে দিয়ে এক হাজারের বেশি টক্সিডো স্যুট বানিয়ে ছিলেন। আর সব কটি স্যুটের রং ছিল কালো এবং ভেতরের শার্ট সাদা রঙের। নরেশ হাজার চেষ্টা করেও শাহরুখকে নীল এবং ছাই রঙের স্যুট পরাতে পারেননি। কারণ, বলিউডের বাদশার কালো রঙের স্যুট পরতেই বেশি পছন্দ করেন। বিয়ের পর শাহরুখ মুম্বাইতে ফিরে বলেছিলেন যে এবার থেকে তাঁর সব পোশাক নরেশই বানাবেন। তবে শুরুর দিকে নরেশকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতেন শাহরুখপত্নী গৌরী। গৌরী নরেশকে শাহরুখের আউটফিটের ব্যাপারে নানান পরামর্শ দিতেন। নিজের পোশাকের ব্যাপারে কিং খান গৌরীর মতামতকে খুব গুরুত্ব দিতেন। তবে এখন গৌরী এসব কিছু থেকে দূরে থাকেন। শাহরুখের পোশাক ডিজাইনের ব্যাপারে নরেশকে পরিচালক, তথা প্রযোজক করণ জোহরও খুব সাহায্য করে ছিলেন। পোশাক নিয়ে কিং খানের খুব একটা ছুঁৎমার্গ নেই। নিজের প্রিয় রংটা পেলেই তিনি খুশি। আর তাঁর প্রিয় রং যে কালো, সাদা, নীল—তা কারোর জানতে বাকি নেই। খুব খাটো বা লম্বা ঝুলের টি-শার্ট পছন্দ করেন না তিনি। একটা নির্দিষ্ট ঝুলের টি-শার্ট পরেন বলিউডের এই নায়ক। স্কিনি ট্রাউজার বা জিনসকে মজা করে ‘ড্রেনপাইপ’ বলেন শাহরুখ। তিনি মজার ছলে একবার বলেছিলেন, ‘মরার আগে আমি কখনো “ড্রেনপাইপ” পরব না।’ একই পোশাক একাধিকবার পরতে আপত্তি নেই তাঁর।

স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে

উৎসবের জন্য কালো রং বেছে নিলেও, শোকসভাতে শাহরুখ সাধারণত সাদা রঙের পাঠানি পরেন। পোশাকের ক্ষেত্রে না হলেও জুতার ব্যাপারে খুঁতখুঁতানি আছে শাহরুখের। চটি এবং বুট পরতে মোটেও স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন না তিনি। তবে শাহরুখ পর্দাতে চরিত্রের প্রয়োজনে বুট পরে নেন। স্পোর্টস শু, স্নিকার, জুতাতে বেশি স্বচ্ছন্দ্য এই সুপারস্টার। তবে শাহরুখ ট্যান, কালো ও বাদামি রঙের ইতালিয়ান জুতা খুবই পছন্দ করেন। বলিউড এই নায়ক একটা বিষয়ে খুব বিরক্ত বোধ করেন। তাঁর শার্টের রং এবং মোজার রং এক হওয়া চাই। জুতা নিয়ে একটা মজাদার ঘটনা বলেছিলেন ডিজাইনার নরেশ। একবার একটা ছবির শুটিংয়ে নরেশ সব পোশাকের সঙ্গে শাহরুখের জন্য জুতাও পাঠিয়েছিলেন। হঠাৎই ইউনিট থেকে ফোন করে নরেশকে ডেকে পাঠানো হয়। নরেশ গিয়ে দেখেন, বলিউডের বাদশাহর জন্য তিনি জুতার একটার সাইজ ৮, আরেকটার সাইজ ৯ পাঠিয়েছেন। শাহরুখ দুই পায়ে দুটি আলাদা সাইজের জুতো পরে বসে আছেন। তবে কিং খান এই ঘটনায় এতটুকু রেগে যাননি। তিনি মজা করে বলেন, ‘আমি একটা ৮ ও আরেকটা ৯ সাইজের জুতা পরেছি। অভিনেতা অজিত “ইয়াদো কি বরাত” ছবিতে এ রকমই পরে ছিলেন। এবার থেকে এটাই ট্রেন্ড হবে।’ শাহরুখের পুরুষ অ্যাক্সেসরিজের একদমই শখ নেই। তিনি মনে করেন, পুরুষদের হাতে একটা হাতঘড়ি ও আংটিই যথেষ্ট। শাহরুখ একটা নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরতে ভালোবাসেন। তবে রোদচশমার শখ আছে তাঁর। রোদচশমার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বাইরে সাধারণত বের হন না।

শাহরুখ খান নিজেকে ফ্যাশনেবল কখনো মনে করেন না। তাঁর বিশ্বাস, ফ্যাশন মানে তাঁকে কী রকম দেখতে লাগছে, তা–ই নয়, শারীরিকভাবে একজন মানুষের ফিট থাকা জরুরি। ৫৫-এ দাঁড়িয়ে আজও তারুণ্যে ভরপুর কিং খান শরীরে এবং মননে। তবে সব থেকে বড় রহস্য যে ২২ কাপ কফি এবং অসংখ্যবার ধূমপান করেও কী করে এত এনার্জিটিক থাকেন বলিউডের কিং খান। কারিনা কাপুর খান, ফারহা খান একবার বলেছিলেন, শাহরুখকে কখনো তাঁরা খেতে দেখেননি। শুধু তাঁরা নন, কিং খানের কাছের মানুষেরাও তাঁকে কখনো খেতে দেখেননি। কারিনা বলেছিলেন, ‘শুনেছি শাহরুখ চিকেন তন্দুরি খেতে বেজায় ভালোবাসে। তাই আমি শাহরুখের জন্য চিকেন তন্দুরি বানানো শিখতে চাই।’ চিকেন তন্দুরি ছাড়া বাড়ির তৈরি সাদামাটা ডাল-ভাত খেতেও ভালোবাসেন এই বলিউড তারকা। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে নিজে অতটা শৌখিন নন শাহরুখ। তবে তাঁর সন্তানদের নিজের হাতে পাস্তা রেঁধে খাওয়াতে ভালোবাসেন তিনি।

আনুষ্কা ও ক্যাটরিনার সঙ্গে

শাহরুখের পার্সোনাল ট্রেইনার প্রশান্ত সাওয়ান্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শাহরুখ ৪৫ মিনিটের বেশি কখনো ওয়ার্ক আউট করেন না। তবে যখন তিনি ওয়ার্ক আউট করেন, তখন মনপ্রাণ দিয়ে সেটাই করেন। ওই সময় তিনি গান শোনেন না, কথাও বলেন না। আর গভীর রাতে শাহরুখ সাধারণত ওয়ার্ক আউট করেন। জানা গেছে, শাহরুখের ওয়ার্ক আউট চার্ট ১৫ দিন অন্তর বদল হয়। তবে পেটের এক্সারসাইজ তিনি কখনো বন্ধ রাখেন না। শাহরুখ ‘ওম শান্তি ওম’ ছবিতে সিক্স প্যাক এবং ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ছবিতে এইট প্যাক করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সব বয়সী মানুষ তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হন। সাইক্লিং, ওয়েট ট্রেনিং, কার্ডিওভাসকুলার এক্সারসাইজ ছাড়া এই বলিউড তারকা বেলি ড্যান্স করেও নিজেকে ফিট রাখেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে পুষ্টিকর ডায়েট সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি।

ছবি: আইঅ্যামএসআরকের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল