বানরছানাকে উদ্ধার করে কোলে-পিঠে করে বড় করেছিলেন এই দম্পতি, তারপর কী হলো?

একটা বানরছানাকে উদ্ধার করে কোলে-পিঠে করে বড় করেছিলেন ইমরোজা তাম্মিমতৌহিদুর রহমান দম্পতি। দিনে দিনে বানরটা হয়ে উঠেছিল পরিবারেরই সদস্য। কিন্তু বনের প্রাণীকে ঘরে আটকে রাখা তো অন্যায়। তাই আদরের পোষ্যকে একদিন স্বজাতিদের কাছে রেখে আসতে গেলেন। তারপর কী হলো? ইমরোজার কাছে সেই গল্পই শুনলেন সজীব মিয়া

গোপাল নামের পোষ্য বানরকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা ভ্রমণ করেছেন ইমরোজা ও তৌহিদুর
ছবি: সংগৃহীত

টঙ্গী থেকে হঠাৎ পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের ফোন। টঙ্গী স্টেশন রোডের পাশেই এক লোকের হাতে সে একটা বানরের বাচ্চা দেখেছে। বানরছানাটা ভীষণ অসুস্থ। সে জানে, আমার শ্বশুরবাড়ি পুরান ঢাকায়। আসিফদের (তৌহিদুর রহমান) বাড়ির আশপাশেই একসময় বানর ছিল। বানর নিয়ে তার ভীষণ আগ্রহ। তাই আসিফকেই সে খবরটা দিল।

দ্রুতই টঙ্গী চলে যাই আমরা। রোগাপটকা বানরছানাকে খুব অযত্নে রেখেছিল লোকটা। কোথা থেকে ছানাটাকে এনেছে, বলল না। কিছু টাকার বিনিময়ে আমাদের দিয়ে দিল। লোকটা জানাল, ওর নাম গোপাল। নামটা আমাদের পছন্দ হয়নি। উদ্ধার করে বাসায় আনার পর নতুন একটা নাম রাখলাম। কিন্তু নতুন নামে গোপাল সাড়া দেয় না। কী আর করা, গোপালই থেকে গেল ওর নাম। এসবই গত বছরের ঘটনা।

আরও পড়ুন
গোপাল তখন অনেক ছোট
ছবি: সংগৃহীত

গোপালের দিনরাত্রি

গত রমজানের ঘটনা। গোপালের বয়স তখন পাঁচ মাস। তাকে খাঁচায় রেখে নিচতলায় শাশুড়ির সঙ্গে ইফতার করতে গেলাম। মিনিট ১৫ হয়তো ছিলাম। বাসায় ফিরে থ। পুরো ঘরে জিনিসপত্র ছড়ানো। দেয়ালে টাঙানো ছবির ফ্রেমগুলো বাঁকা হয়ে আছে। রান্নাঘরের কাচের বয়ামগুলো ভাঙা। বারান্দায় গিয়ে দেখি, গাছও নষ্ট করা। আর ওদিকে দুষ্টুটা গ্রিলে বসে এক পা দোলাচ্ছে, আর আয়েশ করে পাতা খাচ্ছে। সেদিনই প্রথম সে খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু বের হয়েও সে আমাদের ছেড়ে যায়নি।

সেদিনের পর থেকে গোপালকে আমরা ছেড়ে রাখতে শুরু করি। এরপরও কিছুদিন জিনিসপত্র নষ্ট করেছে। দিনে দিনে আমাদের কথা শুনতে শুরু করে। আমরা মানা করলে শুনত।

গোপাল আমাদের কাছে ছিল প্রায় সাড়ে ১০ মাস। এ সময় বাসায় রেখে আমরা বাইরে গিয়ে দু-তিন ঘণ্টার বেশি থাকিনি। বিভিন্ন জেলায় ওকে নিয়েই ঘুরেছি। ওকে নিয়ে ভ্রমণের সময় নানা ঘটনা ঘটেছে। তবে কুষ্টিয়ার ঘটনাটা কোনো দিন ভুলব না। ছোট একটা বাচ্চা একদিন সেখানে গোপালকে পাথর ছুড়ে মারে। গোপালও গিয়ে বাচ্চাটাকে কামড়ে দেয়। কামড় অবশ্য খুবটা একটা লাগেনি। তবে শিশুটা ভীষণ ভয় পায়। কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে চলে যায়। আমরাও গোপালকে নিয়ে অন্য দিকে চলে যাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা লোক দা হাতে ছুটে আসেন। শুধু গোপালকে নয়, পারলে তার পালককেও কোপ মারেন। তাঁর আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গিতে খুব ভয় পেয়ে যাই। কোনোভাবেই তাঁকে বোঝাতে পারছিলাম না, গোপাল ছোট একটা বানর, ওকে টিকা দেওয়া আছে, এটুকু কামড়ে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মুহূর্তে পুরো গ্রামের প্রায় শ খানেক মানুষ চলে আসে। অনেক কষ্টে সেদিন গোপালকে রক্ষা করেছিলাম।

গোপাল যখন বড় হলো
ছবি: সংগৃহীত

গোপালকে নিয়ে বাইরে গেলেই আসলে সমস্যায় পড়তে হতো। মানুষ খালি ওর ছবি তুলত। আর মানুষ আমাদের এমনভাবে দেখত, মনে হতো আমরা বানরের খেলা দেখাই, এটাই আমাদের আয়ের উৎস। সত্যি বলতে, গোপাল আমাদের যতটা না বিরক্ত করত, তার চেয়ে বেশি বিরক্ত করত এসব অতি উৎসাহী মানুষ।

দিনে দিনে কেমন যেন একটা মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল গোপাল। আরও স্পষ্ট করে বললে, গোপাল আসলে আমাদেরই একজন হয়ে উঠেছিল। গোপালকে ঘিরে দুটি মানুষের দিনরাত এক হয়েছিল। প্রায় একটা বছর ওর কথা ভেবেই আমাদের সব পরিকল্পনা করতে হয়েছে। অবলা প্রাণীটার যত্নে, খাবারদাবারে কমতি হবে দেখলে আমরা কোথাও যেতামই না। কিন্তু দিন শেষে আমরা ভেবেছি, ও তো আমাদের স্বজাতি নয়, আমাদের সঙ্গও ওর স্বাভাবিক পরিবেশ নয়। তাই একটা সময় প্রিয় বানরটাকে ওর স্বজাতিদের কাছে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিই। এ জন্য অনেকের কাছে পরামর্শ নিয়েছি, সহযোগিতা চেয়েছি। নানাজনের নানা পরামর্শও পেয়েছি।

গোপালকে ঘিরেই অনেক দিন কেটেছে তাঁদের
ছবি: সংগৃহীত

গোপালটা ওদের দলে ভিড়ে গেল

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে একটা বানরের দল আছে। একবার সেখানে গেছি। টানা সাত দিন ধরে গোপালকে ওই দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কোথায় কী, গোপাল কিছুতেই ওদের সঙ্গে মিশতে পারল না। ওর কাজ ছিল শুধু আমাদের আশপাশের তিন-চার গাছে সারা দিন লাফিয়ে বেড়ানো, আর ঘুম পেলেই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে আমার কাছে ছুটে আসা।

চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আরেকবার নিয়ে গেলাম কাপ্তাইয়ের সীতারঘাটে। সেখানেও বানরের ঝাঁক আছে। এবার গোপাল কিছুটা চেষ্টা করল। কয়েকবার উত্তেজনা নিয়ে স্বজাতিদের কাছে ছুটে গেল। কিন্তু ওই দল মুখ ফিরিয়ে নিল। এরপরই সিলেটের আবঙ্গী টিলা এলাকার এক মাজারের কথা শুনতে পেলাম। এক ছোট ভাই জানাল, মাজারে বানরের আনাগোনা আছে। প্রায় দিনই ঝাঁক বেঁধে তারা আসে। আর গোপালের গায়ের রঙের সঙ্গে এই বানরদের গায়ের রঙে মিলও আছে।

বুড়ো বানরের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে গোপাল (ডানে)!
ছবি: সংগৃহীত

তাদের কাছে গোপালকে তুলে দিতেই গত মাসে সেই মাজারে যাই। ঢাকা থেকে গিয়ে পৌঁছাই রাত আটটা কি নয়টায়। মাজারে কোনো বানরের দেখা পেলাম না। গোপাল ছাড়া পেয়ে এগাছ-ওগাছে ঘুরে বেড়াল। তবে ভিতুটা আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে গেল না। রাত আড়াইটার দিকে গাছ থেকে নেমে এল। বুঝতে পারলাম, ওর ঘুম পেয়েছে।

রাতের নিষ্ফল চেষ্টার পর আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে দেখি, ওর সারা গায়ে রাবারের কষ লেগে আছে। রাতে খেয়ালই করা হয়নি। রাবারের গাছে নেচে বেড়ানোর সময় এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। গোপালকে কোলে নিয়ে গিয়ে আসিফ গোসল করিয়ে দিল, খাওয়াল।

দুপুর তখন। হঠাৎ দেখি, একটা বড় বানর এগিয়ে আসছে। কাছে আসার পর বুঝলাম, গোপালকে দেখেই সে এদিকে এসেছে। বানরটা বয়স্ক। বয়স ১৫-২০ বছর তো হবেই। গোপালকে আমরা বড় বানরের দিকে ঠেলে দিলাম। ধীরে ধীরে ও বুড়ো বানরটার কাছে গেল। গোপালকে সে এমন ভয় দেখাতে লাগল যে দুই লাফে আবার আমাদের কাছে ফিরে এল।

এরই মধ্যে দেখতে পেলাম, আরও বানর আসছে। একে একে ৬০-৭০টা বানর চলে এল। এদের মধ্য থেকে সাত-আটটা বয়স্ক বানর আচমকা গোপালকে আক্রমণ করে বসল। গোপালও কম যায় না। সে-ও পাল্টা আক্রমণ করে বসল। অনেকক্ষণ পরে বুঝলাম, গোপাল ভেবেছে, বানরগুলো আমাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। তাই গোপাল পাল্টা আক্রমণ করে আমাদের রক্ষা করছে। ওর এই ভালোবাসা দেখে মনে হচ্ছিল, গোপালকে নিয়ে চলে আসি। কিন্তু আমরা চাচ্ছিলাম, ও আমাদের ভুল বুঝুক। তাই আক্রমণের মুখেও গোপালকে বারবার ঠেলে দিতে থাকি। একসময় গোপালও সম্ভবত বুঝতে পারে, আমরা ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছি। সে আর ফিরে আসে না।

দুই-আড়াই ঘণ্টা পর একদম চুপচাপ হয়ে যায়। গোপাল বয়সে ছোট। বানর দলের নেতারা হয়তো বুঝতে পেরেছে, সে ওদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না। এবার তাই অনেকটা সহজেই তাকে গ্রহণ করে। গোপাল ওর বয়সী কয়েকটা বানরের কাছে যায়। ওদের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করে। অন্য বানরের ঘ্রাণ নেয়। অন্যরাও এসে গোপালের গায়ের ঘ্রাণ নেয়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই গোপালকে আর খুঁজে পাই না। অনেকগুলো গোপালকে দেখতে পাই। আমরা গোপাল ভেবে গুলিয়ে ফেলি। একটু পর দেখি, বানরগুলো চলে যাচ্ছে। একটা, দুইটা করে টিলার অন্য দিকটায় ছুটল ওরা। আচমকা খেয়াল করে দেখি, আর কোনো বানর নেই। তারপর সব চুপচাপ।

সব বানরকে এখন মনে হয় গোপাল

সেদিন কষ্ট পেয়েছি বটে, তবে ভালো লাগছে, গোপালকে আমরা ওর স্বজাতির মাঝে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। এখন সে মুক্ত পরিবেশে তার মতো থাকবে। গোপালকে রেখে আসার পর পুরো বানর জাতিকেই এখন মনে হয় গোপাল। আমরা পরিকল্পনা করেছি, খুব শিগগিরই খাবারদাবার নিয়ে সিলেটে যাব। গোপালদের সবাইকে খাওয়াব। সবার ভিড়ে গোপালও হয়তো খাবে। আচ্ছা, গোপাল কি সেদিন আমাদের চিনবে?