পৃথিবীর ‘ডাক্তার’ হতে চান তাঁরা

সিলেটের লালাখালে সারি গোয়াইন নদীর তীরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা
ছবি: সংগৃহীত

‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা হয়তো সম্ভব না। তবে উপকূলের মানুষের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি দুর্যোগের সঙ্গে সহাবস্থান করে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করি,’ ১৯ মে মুঠোফোনে বলছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হাফিজ আশরাফুল হক।

ঘূর্ণিঝড় মোখার সামান্য আঘাতেই লন্ডভন্ড হয়েছে প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ছিল উচ্চ ঝুঁকিতে। মানুষের মুখে ঘুরেফিরে তখন বারবার এসেছে পর্যাপ্ত সচেতনতা, সঠিক ব্যবস্থাপনা, যথাযথ প্রস্তুতির কথা। সুখবর হলো, এখন বাংলাদেশে এসব নিয়ে গবেষণা হচ্ছে এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে।

একমাত্র বিভাগ হিসেবে শুরু

উপকূল অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের যাত্রা শুরু ২০১৬ সালে। এটি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের অধিভুক্ত। বিভাগীয় প্রধান হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, ‘উপকূল অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মূলত প্রকৌশলভিত্তিক বিষয়। সেভাবেই সাজানো হয়েছে এর পাঠ্যক্রম। উপকূল প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি পৃথিবীর কোথাও দেওয়া হতো না। ২০১৬ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কার্যক্রমটি শুরু হয়।’ বিশেষায়িত বিষয় হওয়ায় প্রতিবছর সাধারণত ২০ শিক্ষার্থী এখানে ভর্তির সুযোগ পান। তবে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৩০ শিক্ষার্থী নেওয়া হচ্ছে।

পড়াশোনার বিষয়

উপকূলীয় অঞ্চল ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা বিষয় এখানকার শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠ্য। নদীর গঠন, গভীরতা, জলজ বাস্তুসংস্থান যেমন পড়ানো হয়, একইভাবে নদী ভাঙন, ভূমিকম্প, ভূমিধসসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় (কেন হয়, কীভাবে হয়, প্রতিকার করা যায় কীভাবে ইত্যাদি) হাতে-কলমে শেখানো হয়। তার মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে জোর দেওয়া হয় বেশি। যেমন মৃত্তিকা বলবিদ্যা, উপকূল প্রকৌশল, নৌবন্দর প্রকৌশল, সমুদ্রবিজ্ঞান, ভৌগোলিক তথ্যব্যবস্থা (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম বা জিআইএস), জলজ চাষ ও সামুদ্রিক মাছ, গবেষণাপদ্ধতি ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।

গবেষণার সুযোগ

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণ অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন তাঁরা। বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইতি খান বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ যেহেতু বেশ দুর্যোগপ্রবণ, অনেক কিছু নিয়েই তাই গবেষণা করা যায়। চতুর্থ বর্ষে ‘প্রজেক্ট ওয়ার্ক’ নামে একটা কোর্স যেমন আছে। ইতিমধ্যে অনেক গবেষণা কার্যক্রম চলছে। আশা করি, দ্রুত সেগুলো প্রকাশ পাবে।’

ব্যবহারিক ও মাঠগবেষণার ওপর এখানে আলাদা গুরুত্ব দেন শিক্ষকেরা। চার বছরের স্নাতক ডিগ্রিতে ব্যবহারিক কাজেই ১৮ ক্রেডিট। আবার, মাঠগবেষণা ও প্রতিবেদনের জন্য রয়েছে আরও ছয় ক্রেডিট। তাই পদ্ধতিগতভাবেই গবেষণায় দক্ষ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা।

সামুদ্রিক প্রবাল সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন বিভাগীয় প্রধান হাফিজ আশরাফুল হক
ছবি: সংগৃহীত

কেন পড়বেন

‘এখনকার পৃথিবীতে অর্থনীতি ও প্রযুক্তির পর সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তন কথাটিই উচ্চারিত হয় সবচেয়ে বেশি। আর এর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগীও বাংলাদেশের মতো সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলো। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রাণ-প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে কীভাবে নিজেদের উন্নয়ন করা যায়, সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব শেখার জন্যই আমাদের বিভাগ,’ বলছিলেন উপকূল অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী সুফিয়া খাতুন।

বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, ‘আমি নিজেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের একজন ভুক্তভোগী। আমার বাপ-দাদার ভিটেমাটি নদীভাঙনে পড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে। নদীভাঙনের ফলে মানুষের দুঃখ–দুর্দশা খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই ভর্তি পরীক্ষায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন বিষয় নিয়ে সুযোগ পাওয়ার পরও এখানেই ভর্তির সিদ্ধান্ত নিই। যেন কিছুটা হলেও মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারি। তাঁদের নিয়ে কাজ করতে পারি। একটা কথা আমি প্রায়ই বলি, এ বিষয়ে পড়ে একদিন পৃথিবীর ডাক্তার হব। পৃথিবীটাকে সারিয়ে তুলব।’

আছে সম্ভাবনা

দেশ ও দেশের বাইরে উপকূল অধ্যয়নের বেশ চাহিদা আছে বলে জানান হাফিজ আশরাফুল হক। আছে বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়ার সুযোগও। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে আবহাওয়া অধিদপ্তর, জলবায়ুসংক্রান্ত বিজ্ঞান ও দুর্যোগসংক্রান্ত সব ক্ষেত্র, এনজিওর গবেষণা খাত, উপকূল ও পরিবেশগত প্রকৌশল, পোতাশ্রয় এলাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অবদান রাখতে পারবে। আমাদের দেশে পাঁচটি বাণিজ্যিক বন্দর চালু হচ্ছে। চট্টগ্রাম এবং মোংলায় আগেই ছিল, এখন আরও তিনটি হচ্ছে। এসব জায়গায় অন্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের চেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো করতে পারেন।’ যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ের চাহিদা আছে বলে তিনি জানান।