রেসিং ট্র্যাকে অভিক আনোয়ার আজ যে গাড়ি নিয়ে ছুটবেন, সেটির নম্বর জানেন?

প্রথম বাংলাদেশি রেসিং ড্রাইভার হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিজের ৯০তম আন্তর্জাতিক মোটর রেস সম্পন্ন করেছেন অভিক আনোয়ার। রেসের সেঞ্চুরি থেকে একটু দূরে থাকা অভিকের গল্প শোনাচ্ছেন পল্লব মোহাইমেন

দুবাইয়ে অভিক আনোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

‘ছয় বছর আগে একটা স্বপ্ন ছিল—বাংলাদেশের পতাকা বিশ্বের সব রেসট্র্যাকে উড়বে, আজ আমার সেই স্বপ্ন অনেকটাই সফল, আলহামদুলিল্লাহ। এই সেই রেসট্র্যাক, কানাডার কুইবেক প্রভিন্সের মন্ট ট্রেম্বলেন্ট পাহাড়ে, যেখান থেকে আমি আমার রেসিং স্কুল সম্পন্ন করি এবং বাকিটা ইতিহাস।’

কানাডা থেকে ২ ডিসেম্বর নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এই স্ট্যাটাস দেন বাংলাদেশি মোটর রেসার অভিক আনোয়ার। সঙ্গে একটা ছবি, সেই ছবির পটভূমিতে বরফে ঢাকা মোটর রেসিং ট্র্যাক।

এদিকে ৯ ডিসেম্বর ইতিহাস গড়তে নিজেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছেন ৩৭ বছর বয়সী এই তরুণ। প্রথম বাংলাদেশি রেসিং ড্রাইভার হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির ইয়াস মেরিনা মোটর রেসিং ট্র্যাকে দেশের নিজের ৯০তম আন্তর্জাতিক মোটর রেস সম্পন্ন করেছেন অভিক আনোয়ার। এর আগে বাংলাদেশে আরও তিনটি রেস করার অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর।

নিজের রেসের সেঞ্চুরি থেকে ১০ রেস দূরে অভিক আনোয়ার। শততম রেস কবে সম্পন্ন হবে? তিনি বলেন, ‘জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দুবাইয়ে, মাঝামাঝি সময়ে আবুধাবি কয়েকটা রেস আছে। ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতে রেস রয়েছে। মনে হচ্ছে, কুয়েতের ট্র্যাকে আমার শততম রেস হবে।’

আরও পড়ুন
মোটর রেসার অভিক আনোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

৯ ডিসেম্বর দুপুরে ‘ক্লিও কাপ মিডল ইস্ট অ্যাট ১২ আওয়ার্স’ নামের মোটর রেসিং প্রতিযোগিতায় প্রথম রেসে ৭১ নম্বর গাড়ি নিয়ে ১৯ জনের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন তিনি। এ প্রতিযোগিতায় ১১ দেশের ১৯ জন পুরুষ ও নারী রেসার অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চ্যালেঞ্জার শ্রেণিতে ৬ জন এবং জেন্টলম্যান শ্রেণিতে ছিলেন ১৩ জন রেসার। নিজের ‘রেসিং ডিএনএ’ দল থেকে অংশ নিয়ে অভিক আনোয়ার রেস করেন জেন্টলম্যান শ্রেণিতে। তাঁর পৃষ্ঠপোষক এমজিআই গ্রুপ। এই প্রতিযোগিতায় যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারত, বাংলাদেশ, রাশিয়া, বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মেক্সিকো, ইতালি ও মিসরের রেসাররা অংশ নেন।

৯ ডিসেম্বর আবুধাবিতেই অভিকের ৯১তম রেস সম্পন্ন হতে পারত। বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ১১টায় ক্লিও কাপের রেস–২ শুরু হয়। ইউটিউব চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত রেসিংয়ে দেখা গেল, রাশিয়ার মোটর ড্রাইভার স্তানিস্লাভ নোভিকভ প্রথম তিনজনের মধ্যেই ছুটছেন গাড়ি নিয়ে। তীব্র গতি। সপ্তম ল্যাপে হঠাৎ তাঁর গাড়িটি মাটি থেকে যেন উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে রেসিং ট্র্যাকের রেলিংয়ে (ব্যারিয়ার)। নোভিকভ অক্ষত থাকলেও দুমড়েমুচড়ে যায় গাড়িটি। এরপর কর্তৃপক্ষ লাল পতাকা (রেড ফ্ল্যাগ) উড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ রেস–২ বাতিল।

শনিবার রাতের রেসে অভিক আনোয়ারও দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার শুরুটা ভালোই হয়েছিল। দ্বিতীয় ল্যাপেই নিজের ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিলাম। হঠাৎ আমার গাড়ির (৭১ নম্বর) সামনের বাঁ দিকের চাকা পাংচার (ফেটে যাওয়া) হয়ে যায়।’

এমন দুর্ঘটনায় গাড়ি উল্টে যেতে পারত। কেননা, গাড়ির গতি তখন ছিল প্রতি ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার। কিন্তু দক্ষ হাতে গাড়ি ঘুরিয়ে অঘটন ঠেকান অভিক। এরপর গাড়ির চাকা বদলে আবার ফিরে আসেন ট্র্যাকে। ৭ নম্বর ল্যাপে যখন গাড়ি চালাচ্ছেন অভিক, তখনই নোভিকোভের ‘দুর্ঘটনা–পরবর্তী নিরাপত্তার জন্য’ রেস বন্ধ করে দেওয়া হয়।   

অভিক আনোয়ার তাঁর ৯০তম রেসিং যে ট্র্যাকে সম্পন্ন করেছেন, আবুধাবির সেই ইয়াস মেরিনা ট্র্যাকে ফর্মুলা ওয়ান, গ্রাঁ প্রির মতো মোটর রেসের আয়োজন হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার আয়োজক ফরাসি গাড়ি প্রস্তুতকারক রেনল্ট। প্রত্যেক রেসারকে রেনল্টের ক্লিও অ্যালপিন সিরিজের গাড়ি ব্যবহার করতে হয়েছে। এখানে বলা ভালো, এর আগে অভিক এই গাড়ি কখনো চালাননি, ‘কানাডা থেকে আবুধাবি এসে জেটল্যাগ নিয়েই চালকের আসনে বসেছি। ক্লিও গাড়িতে প্রথমবারের অভিজ্ঞতা ভালোই বলতে পারি।’

ক্লিও কাপের প্রথম রেসে ১২টি ল্যাপ সম্পন্ন করেন অভিক আনোয়ার। প্রতিটি ল্যাপের দূরত্ব ৫ দশমিক ২৮ কিলোমিটার। অভিক আনোয়ারের সেরা সময় ছিল এক ল্যাপে ২ মিনিট ২০ দশমিক ১২৬ সেকেন্ড।

গাড়ির সঙ্গে সখ্য

অভিকের বাবা মো. আনোয়ার হোসেনের গাড়ির ব্যবসা ছিল। গত জুলাইতে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কাকরাইলের সেই প্রতিষ্ঠান কার হাউস এখন অভিক দেখাশোনা করেন। বাবার ব্যবসার কারণে গাড়ির সঙ্গে অভিকের সখ্য ছোটবেলা থেকেই। টেলিভিশনে নিয়মিত মোটর রেস দেখতেন। ফর্মুলা ওয়ান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে মাইকেল শুমাখার ও মিকা হ্যানিকেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখে রেসিংয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মে অভিকের। এভাবেই ২০০৭ সালে রেসিংয়ের শুরু তাঁর। ঢাকায় স্কলাস্টিকা স্কুলের পাঠ চুকিয়ে তিনি তখন কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক পড়তে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রশিক্ষণ নেন রেসিংয়ের। টাকা জোগাড়ের জন্য তীব্র ঠান্ডায় পিৎজা ডেলিভারির কাজও করেছেন। এরপর নিজের মতো করেই অভিক শিখলেন রেসিং।

২০১৪ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে র‌্যালি ক্রস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিলেন। হলেন চ্যাম্পিয়ন। ২০১৫ ও ২০১৬ সালেও চ্যাম্পিয়ন। এরপর অভিক বাইরে যাওয়ার কথা ভাবেন। ভারত থেকে পরীক্ষা দিয়ে রেসার লাইসেন্স নেন। ২০১৭ সালে ভারতে প্রথম রেসে অংশ নিলেন অভিক। সেটা ছিল ইন্টারন্যাশনাল মোটর স্পোর্টসের আয়োজন। হলেন চতুর্থ। পরের দুই বছরে কোনো রেসিংয়েই শীর্ষ তিনের মধ্যে পৌঁছাতে পারেননি অভিক। ২০১৯ সালে আবার এল সাফল্য। এরপর বেশ কটি রেসে প্রথম স্থানও অর্জন করেছেন। এ পর্যন্ত ৪৮টি আন্তর্জাতিক রেসে পোডিয়ামে (শীর্ষ তিনের বিজয়স্তম্ভ) বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে পেরেছেন। দেশে পাঁচটি রেসে শীর্ষস্থান অর্জন করেছেন শুরুর দিকেই।  

৭১ নম্বর গাড়ি নিয়ে আজ দুটি রেসে অংশ নেবেন অভিক আনোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে কারহাউস ইমপোর্টস নামে ঢাকার বনানীতে অভিকের নিজের গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। ইউটিউবে গাড়ির পর্যালোচনাও করেন তিনি। সেখানে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। অভিক আনোয়ার এ পর্যন্ত ভারতে ৩৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৮টি ও মালয়েশিয়ায় ১৯টি রেসে অংশ নিয়েছেন। মোটর রেসের জন্য পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক সার্কিটে রেস করেছেন বাংলাদেশের এই তরুণ রেসিং ড্রাইভার।

বিখ্যাত সব রেসিং ট্র্যাকে লালসবুজ পতাকা ওড়াতে চান অভিক আনোয়ার। গতি আর রোমাঞ্চের খেলায় তিনি বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চান। তাঁর দল রেসিং ডিএনএর সবাই বাংলাদেশি। রেসিং ট্র্যাকে অভিক আনোয়ার তুমুল গতিতে যে গাড়ি ছোটান, সেটির নম্বর ‘৭১’। আজ ১৬ ডিসেম্বর দুবাইয়ের অটোড্রোম ট্র্যাকে সেই ৭১ নম্বর গাড়ি নিয়েই ক্লিও কাপের আরও দুটি রেসে অংশ নেবেন অভিক আনোয়ার। এভাবেই মনেপ্রাণে ধারণ করে নিজের দেশকে তুলে ধরতে চান বিশ্বের কাছে।