চিঠি পাঠিও চত্বরে
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিতিভিত্তিক সংগঠন বৃত্ত কুবি, আঁকাআঁকি করাই যাদের মূল কাজ। এই সংগঠনের উদ্যোগেই ক্যাম্পাসে একটি চত্বর চালু হয়েছে, নাম ‘চিঠি চত্বর’। শুধু নামেই নয়, চত্বরে দেখা যাবে লালরঙা একটি ডাকবাক্সও। নামে–বেনামে চিঠি পাঠানো যাবে এখানে। অবসর সময়ে বসে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ তো থাকছেই।
ভাবনাটা কীভাবে মাথায় এল?
উত্তরটা শোনা যাক বৃত্ত কুবি সংগঠনের হেড অব ফিন্যান্স আরাফাত রাফির কাছ থেকে, ‘আড্ডা তো প্রায়ই হয়। হুট করে একদিন কথা উঠল পুরোনো চিঠি নিয়ে। আমাদের তো চিঠি লেখার সুযোগ হয়নি। তবে সবারই কমবেশি চিঠি নিয়ে স্মৃতি আছে। কেউ দাদা-দাদির কাছ থেকে গল্প শুনেছে, কারও মা এখনো বাবার দেওয়া চিঠিগুলো যত্ন করে রেখেছেন। তখনই আমরা দুই–একজন একটু আলোচনা করলাম এটা নিয়ে কিছু করা যায় কি না। হালের ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ই–মেইলের যুগে হাতে লেখা চিঠি প্রায় জাদুঘরের বস্তু হতে চলেছে। তাই চিঠি আদান–প্রদানের একটা মাধ্যম তৈরি করতে চেয়েছি। প্রিয়জনের হাতে লেখা একটা চিঠি পাওয়ার যে আনন্দ, সেটা ফিরিয়ে আনতেই আমাদের এই চিঠি চত্বরের উদ্যোগ।’
চিঠি চত্বরে গেলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা সেলফি তোলেন, আড্ডা দেন। তবে কিছুদিন আগেও এখানে ছিল ময়লার স্তূপ। পরিবর্তনটা নিশ্চয়ই চ্যালেঞ্জিং ছিল? ‘কথা সত্যি। শুধু ময়লার স্তূপ সরানো নয়; মাটি কেটে সমান করা। চারদিক পরিষ্কার করাও কাজ ছিল। আমাদের উপদেষ্টা সোহরাব উদ্দিন স্যার এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকবল দিয়ে কাজ করিয়েছেন। তাই আমাদের কষ্ট কম হয়েছে,’ জানালেন আরাফাত।
সংগঠনের বাইরের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আঁকাআঁকিতে স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছিলেন। হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন। তাই ছোটখাটো উৎসবের মতো করেই নতুন এই চত্বর জায়গা করে নিয়েছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়।
চিঠি চত্বরের এক পাশে রাখা আছে একটি লাল ডাকবাক্স। দাপ্তরিক লোগো, নম্বরও আছে। কিন্তু এ রকম ডাকবাক্স তো শুধু সরকারি ডাকঘরে থাকে। বিষয়টা খোলাসা করে বললেন সংগঠনের হেড অব কমিউনিকেশন ও শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী কানিজ ফাতেমা, ‘ঠিক করেছিলাম আমরা নিজেরাই একটা কাঠের ডাকবাক্স বানাব। যেহেতু পুরো পরিকল্পনা সংগঠনের শিক্ষার্থীদের নিজেদের অর্থায়নে হচ্ছিল, তাই একটু টাকাপয়সার ঘাটতি ছিল। ধীরে ধীরে আমরা কাজ করছিলাম। তবে আমাদের উপদেষ্টা স্যার এ উদ্যোগের কথা কুমিল্লার প্রধান ডাকঘরকে জানান। ডাকঘর কর্তৃপক্ষ উদ্যোগের প্রশংসা করে আমাদের একটি লাল ডাকবাক্স উপহার দেয়। চিঠি চত্বরের এই ডাকবাক্সে তিন ধরনের চিঠি পাঠানোর সুযোগ আছে। নামে, বেনামে ও খোলাচিঠি।’
কিন্তু চিঠি এলে পৌঁছে দেবে কে? সংগঠনের ডাকপিয়নও আছে নাকি? হাসলেন কানিজ। বললেন, ‘হ্যাঁ, তেমনটাই। আমাদের একটা দল আছে, যারা যত্নসহকারে প্রাপকের হাতে চিঠি পৌঁছে দেয়। যদিও এই সুবিধা শুধু ক্যাম্পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চত্বর উদ্বোধনের আগে থেকেই আমরা চিঠি পেতে শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি থাকায় এখন অবশ্য এই কার্যক্রম বন্ধ।’
চত্বরের রক্ষণাবেক্ষণ ও চিঠি আদান-প্রদানের জন্য একটা দল তৈরি করেছে বৃত্ত কুবি। সংগঠনটির দাবি, আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের চিঠি আদান–প্রদান করা গেলেও শিগগিরই পুরো দেশের চিঠি যেন এই ডাকবাক্সে আসতে পারে, সে ব্যাপারে তারা কাজ করছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ চলছে। শিক্ষার্থীরা যেন চিঠির মাধ্যমে তাঁদের পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, এটিই সংগঠনের চাওয়া। ডাকবাক্সে জমা পড়া খোলাচিঠিগুলো নিয়ে কিছুদিন পরপর একটি চিঠি প্রদর্শনী করারও পরিকল্পনা আছে। পুরো কার্যক্রমে পাশে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন। তাই তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানালেন শিক্ষার্থীরা।
চিঠি চত্বরের মাধ্যমেই চিঠির প্রেরক ও প্রাপক হওয়ার সুযোগ হয়েছে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাসমিয়া মাহমুদের। ক্যাম্পাসের একটি উদ্বেগজনক বিষয় নিয়ে উপাচার্যকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। সমাধানসহ ফিরতি চিঠি পেয়েছেন পরদিনই। তাসমিয়ার বক্তব্য, ‘গল্প শুনে এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্রে চিঠি লেখার মাধ্যমে আমাদের চিঠির সঙ্গে পরিচয়। বাস্তবে চিঠি লেখা হয়ে ওঠেনি। তাই এই সংস্কৃতিকে নতুন করে ফিরতে দেখে আমরা খুব খুশি।’
চিঠি চত্বরের বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বৃত্ত কুবির উপদেষ্টা, সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন। তিনি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘যেসব ছেলেমেয়ে জীবনে কখনো চিঠি লেখেনি, তাদের আগ্রহ দেখে বেশ ভালো লেগেছে। ফোনের মেসেজ যতই আধুনিকতার ছোঁয়া দিক, একটা হাতে লেখা চিঠি তাদের মা-বাবাকে অন্য রকম ভালোলাগা দেবে। তা ছাড়া এর মাধ্যমে সবার লেখার অভ্যাসও গড়ে উঠতে পারে।’
চাইলেই তো সরকারি ডাকবাক্স পাওয়া যায় না, তা-ও দাপ্তরিক লোগোসহ। কীভাবে সম্ভব হলো? জানতে চেয়েছিলাম কুমিল্লার প্রধান ডাকঘর সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল কাম পোস্টমাস্টার আবদুল্লাহ আল নোমানের কাছে। তাঁর মতে, ‘আমাদের কাছে যখন ডাকবাক্স চাওয়া হলো, আমরা তখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটা ডাকবাক্স দিই। তবে এটা স্মারক ডাকবাক্স বা ডেমো ডাকবাক্স বলা যেতে পারে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই আমাদের একটা পোস্ট অফিস আছে, তাই এই ডাকবাক্সকে সরকারি করা আপাতত হচ্ছে না। তবে, প্রয়োজনীয়তা তৈরি হলে বা শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে আমরা ভবিষ্যতে আবারও ভেবে দেখব।’