সেই গার্মেন্টসেই নতুন করে ফিরেছি নতুন পদে
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)–এর ১০ শিক্ষার্থীকে প্রতিবছর ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি দেয় প্রথম আলো ও আইডিএলসি। শুধু এটিই নয়, সুবিধাবঞ্চিত আরও বহু নারীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে চট্টগ্রামের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেমন ‘তৈরি পোশাকশিল্প’ খাত থেকে এ পর্যন্ত ১২৩ জন আন্তর্জাতিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন আরজু আরা বেগম। হাজারো বাধা পেরিয়ে সাফল্যের দেখা পাওয়া এই নারীর কথা নিশ্চয়ই আরও অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হবে। অনুলিখন করেছেন জিনাত শারমিন
এসএসসি পরীক্ষার পরই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হলো—যথেষ্ট হয়েছে। পড়ালেখা আর না, এবার চাকরিতে ঢুকতে হবে। বই বুকে জড়িয়ে সেদিন খুব কাঁদলাম। পরদিন থেকে নামলাম চাকরির খোঁজে।
আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলাম তৃতীয়। বাবা ছিলেন ফিশারিজ কনট্রাক্টর, মা গৃহিণী। পরিস্থিতিটাই এমন, তাঁদের কথা না মেনে উপায় ছিল না।
ড্রিম বেঙ্গল গার্মেন্টসে কো-ওয়ার্কার হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয় ৫ হাজার ৬০০ টাকা বেতনে। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কাজ। এরপর কম্পিউটার শিখতে যেতাম। কেননা জানতাম, যদি দক্ষতা না বাড়াই, সারা জীবন এই এক কাজই করে যেতে হবে।
মা সমিতি করতেন। সেখান থেকে বিনা মূল্যে কম্পিউটার কোর্স করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে সুলতান আহমেদ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হই। আর কম্পিউটারের বেসিক কোর্স করা শেষে যোগ দিই একটা জাপানি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে। কর্মঘণ্টা কমল, বেতনও বাড়ল। ফলে পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার পাশাপাশি পড়াশোনার সুযোগটাও বাড়ল।
২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিই। ফল প্রকাশের পর আরেকটি গার্মেন্টসে কাটিং লিডার হিসেবে যোগ দিই। তবে পড়াশোনা থামাইনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হই। জীবনে কখনো থামতে চাইনি। সে জন্যই শিখতে চেয়েছি, দক্ষতা বাড়াতে চেয়েছি।
২০১৫ সালে হিরদারামানি বাংলাদেশ গার্মেন্টসে যোগ দিই। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের বৃত্তির খোঁজ সেখানেই পাই। জানতে পারি—থাকা, খাওয়া, আনুষঙ্গিকসহ স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পূর্ণ ফ্রি। সেই সঙ্গে এই পাঁচ বছর কাজ না করেই আমার গার্মেন্টস থেকে বেতনও পাব। এ কথা যাকেই বলি, সে-ই ভয় দেখায়। বলে, এসব অফারের লোভ দেখিয়ে আমাদের মতো মেয়েদের নিয়ে বিক্রি করে দেয়…ইত্যাদি। আমার এক শিক্ষক তো এমনও বললেন যে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে আসতে আসতে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে, কেউ বিয়ে করবে না।
সেই সময় অনুপ্রাণিত করেছেন বাবা। বলেছেন, ‘পড়াশোনা শুরু করো। কে জানে, ভালো কিছু তো হতেও পারে।’ লিখিত পরীক্ষা দিলাম। দুই মাস পর দিলাম ভাইভা। আমার গার্মেন্টস থেকে একমাত্র আমিই বৃত্তি পেয়ে গেলাম।
২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক শুরু করলাম। এক বছর পর বাবা মারা গেলেন। তাঁকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছিলাম ভীষণ। মনে হচ্ছিল, আর পারব না। সেটা ছিল আমার জীবনের কঠিনতম সময়। ফেসবুকে আমার হতাশামূলক পোস্ট পড়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন স্যাম গিলানি। মার্কিন এই ব্যবসায়ী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডোনার। সন্তানের জন্য একজন বাবা যা যা করেন, যেভাবে পাশে থাকেন, সেভাবেই আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। প্রতিনিয়ত জুগিয়েছেন মানসিক শক্তি। ২০২১ সালে নেপালে তাঁর সঙ্গে আমার সামনাসামনি দেখা হয়। ২০২২ সালে স্নাতকের পরপর যখন বিয়ে করি, তখন তিনি বাংলাদেশে আসেন। আমাদের বাড়িতে ছিলেন। আমার বিয়েতে বাবার সব দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কন্যাদানের আনুষ্ঠানিকতাও তিনি করেছেন। আমার কাবিনে অভিভাবকের স্বাক্ষরের জায়গাতেও তাঁর নাম।
যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ২০০৬ সাল থেকে হাইস্কুলে আমরা একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। ও এখন মেরিনার, নাম হুমায়ূন কবির।
পড়াশোনা শেষে আমার গার্মেন্টসে, আমার বিভাগেই সিনিয়র পদে যোগদান করি। ২০২৩ সালে যখন সন্তানসম্ভবা হই, হাসপাতাল থেকে শুরু করে ওষুধ—সব খরচ দিয়েছে হিরদারামানি বাংলাদেশ। সাত মাস ছুটি কাটিয়ে আবার যখন চাকরিতে যোগ দিই; কমিউনিকেশন এক্সিকিউটিভ, সাসটেইনেবলিটি এক্সিকিউটিভ ও এক্সিকিউটিভ ইন সোর্সিং ডিপার্টমেন্ট আন্ডার সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, এ তিনটি বিভাগ থেকে অফার দেওয়া হয়। আমি বেছে নিই সোর্সিং ডিপার্টমেন্ট। কেননা, এখানে কাজের চ্যালেঞ্জ ও শেখার সুযোগ বেশি। এর মধ্যে আমার এক ভাইকে সৌদি আরব পাঠিয়েছি। মা ও ছোট বোনের সব দায়িত্ব নিয়েছি। আর বড় বোনের ছেলের পড়াশোনার খরচও আমিই দিচ্ছি। নিজের সঙ্গে পরিবারটাকেও দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি।
সারাটা জীবন শেখার চেষ্টাই আমাকে পথ দেখিয়েছি। সামনেও তা-ই চাই।