ইতালি ছেড়ে ফাদার রিগন রয়ে গেলেন এই বাংলাতেই, জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা
‘তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও—আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব’। জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তির সঙ্গে যেন মিলে যায় ফাদার মারিনো রিগনের জীবন। একজন ইতালীয় হলেও বাংলার প্রেমে মজে গিয়েছিলেন তিনি। এ দেশের মাটি-মানুষ আর সংস্কৃতিকে ধারণ করেছিলেন মনে-প্রাণে।
১৯৫৩ সালে একজন মিশনারি হিসেবে বাংলাদেশে আসেন ফাদার রিগন। কিছুদিন যশোরে কাজ করার পর যান সুন্দরবনঘেঁষা জনপদ বাগেরহাটের মোংলায়। মোংলা তখন বিচ্ছিন্নপ্রায় এক জনপদ। লোকে বলত, সেখানে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ বাস করে। পানিপথই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এমন এক পরিবেশে গিয়ে কাজ শুরু করেন মারিনো রিগন।
রিগনের কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল শিক্ষা। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল শিক্ষার মাধ্যমেই জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন সেন্ট পলস উচ্চবিদ্যালয়। স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করেছেন। মানুষের বাড়িতে গিয়ে বোঝাতেন শিক্ষা কতটা জরুরি। তিনি হয়ে উঠলেন সেখানকার আলোর ফেরিওয়ালা। এভাবে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেছেন রিগন। তাঁর হাত ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেসব প্রতিষ্ঠানে আজও নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী।
মোংলায় ফাদারের সহযোগী ছিলেন পল ললিত সরকার। মূলত তাঁর কাছ থেকেই ফাদার সংগ্রহ করেন শরৎচন্দ্রের ‘পণ্ডিতমশাই’। প্রবল আগ্রহ নিয়ে পড়তে থাকেন। অনেক কিছুই বুঝতে পারতেন না। ললিত সরকার তাঁকে বুঝিয়ে দিতেন। এভাবে রিগনের ভাষাগত দক্ষতা বাড়তে থাকে। একে একে তিনি পড়ে ফেলেন বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু বই। যা তাঁকে মুগ্ধ করে। বিশেষ করে রবীন্দ্রসাহিত্য। রবীন্দ্ররচনা পড়ে তাঁর জীবনভাবনায় তোলপাড় ঘটে যায়। নিজের সেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম। ভাই-বোন ও বন্ধুদের কাছে সেসব পাঠান। পড়ে তাঁরাও মুগ্ধ হন। অনুবাদে তাঁর উৎসাহ বাড়ে। ইতালিতে প্রকাশকও মিলে যায়। ১৯৬৪ সালে ইতালিয়ান ভাষায় তাঁর অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকাশিত হয়। এটা ছিল বাংলা থেকে সরাসরি ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম ইতালীয় অনুবাদ। সুধীজনদের মধ্যে সমাদৃত হয় অনুবাদকর্মটি। এভাবে একে একে রবীন্দ্রনাথের প্রায় ৪০টি গ্রন্থ অনুবাদ করেন তিনি।
কবি জসীমউদ্দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ও কিছু কবিতা ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন ফাদার রিগন। এ ছাড়া লালনের গানসহ এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের বেশ কিছু কবিতা অনুবাদ করেন তিনি।
লালনের জীবনদৃষ্টি ফাদার রিগনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। লালনের গানের ভেতরে আবিষ্কার করেন আধ্যাত্মিক এক অনুভূতি। মনের মানুষের খোঁজে হয়ে পড়েন ভিনদেশি এক বাউল। কিন্তু কে তাঁর বেশি প্রিয়, রবীন্দ্রনাথ, না লালন? জানতে চাইলে চুপ হয়ে যেতেন। তিনি বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমার মস্তিষ্কে, আর লালনের বাস আমার অন্তরে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন এই খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী। মুক্তিযুদ্ধকে মনে করতেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। তখন তিনি গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর মিশনপল্লীর প্রধান। মিশনপল্লীতে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসতেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। নিজ হাতে তাঁদের চিকিৎসাসেবা দিতেন ফাদার। তাঁর কাছে চিকিৎসা পেয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দীন বীর বিক্রম। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফাদারকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন এই যোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন ফাদার রিগন। তাঁর দিনলিপিতে ফুটে উঠেছে বাঙালির রক্তাক্ত ইতিহাস। তাঁর ডায়েরির শেষ দিকে কিছু উদ্ধৃতি এ রকম, ‘অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আজ বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সৃষ্টি হয় নতুন একটি দেশ—বাংলাদেশ।
‘১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকালে মুক্তিবাহিনীর একটি লঞ্চ নদীপথে টেকেরহাট থেকে গোপালগঞ্জে যাচ্ছিল। লঞ্চে পতপত করে উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আমাদের নদীর ঘাটে শত শত জনতার চিৎকারে আকাশ–বাতাস মুখরিত “জয় বাংলা! জয় বাংলা!” আমরাও আমাদের লঞ্চের গোটানো পতাকা উড়িয়ে দিলাম। নতুন লঞ্চের নাম দিলাম “মুক্ত বাংলা!”
‘বিকেলে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল আমাদের মাঠে মিলিত হলো। তারা সারিবদ্ধ হয়ে কুচকাওয়াজ, ফাঁকা গুলি করে বিজয়ের আনন্দ উদ্যাপন করল। মাঠে সেদিন শত শত লোক। আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। আমি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতার সেই লাইনগুলো আবৃত্তি করলাম, “বল বীর/ বল উন্নত মম শির…” একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে, বানিয়ারচর ধর্মপল্লীতে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করলাম।’
২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি দান করেন ফাদার রিগন।
২০০১ সালে রিগনের হার্ট অ্যাটাক হয়। প্রাথমিক চিকিৎসায় সেবার বেঁচে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন তাঁর উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। ইতালিতে ভাই-বোনেরা জেনে যান তাঁর অসুস্থতার কথা। উন্নত চিকিৎসা নিতে তাঁকে ইতালিতে যেতে বলেন স্বজনেরা। তিনি ইতালিতে যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। মরলে বাংলাদেশই মরবেন, এই ছিল তাঁর মনোবাঞ্ছা। ওদিকে ভাই-বোনদের প্রবল আকুতি, তিনি যেন ইতালিতে ফিরে যান। হার্টের অপারেশনটা যেন সেখানেই করান। একসময় ভাই-বোনের ডাক ফেলতে পারেন না ফাদার রিগন। তবে তিনি শর্ত দেন, অস্ত্রোপচারে যদি মৃত্যু হয়, মরদেহ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। সেই যাত্রায় উন্নত চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাংলাদেশে ফিরেছিলেন।
২০১৪ সাল। বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় জর্জর রিগন। বাংলাদেশে এসে তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যান বোন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর তিনি মারা যান। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে সমাহিত করা হয়। তিনি এই বাংলায়ই রয়ে গেলেন।
২০০৯ সালে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় ফাদার রিগনকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ২০১২ সালে তাঁকে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার মারিনো রিগনের জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভেনিসের অদূরে ভিল্লভেরলা গ্রামে। আজ ৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর শততম জন্মবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি সহস্র সালাম।
লেখক: প্রবাসী পুঁথিশিল্পী