ঢাকার এআইইউবিতে পড়েছেন, এখন ডিজনি প্লাসের লিড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

২০০৫ সালেই জাহিদ সোহেল যদি ‘স্টকহোম টু ঢাকা’ টিকিট কেটে ফেলতেন, তাহলে হয়তো এই সাক্ষাৎকারের সূত্রপাতই হতো না। দেশের বাইরে বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করে ক্যারিয়ার শুরু করা মানুষটি এখন বিশ্বের জনপ্রিয় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ডিজনি প্লাসের লিড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন জিনাত শারমিন

প্রথম আলো:

‘লিড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে ডিজনিতে আপনার দায়িত্ব মূলত কী?

জাহিদ সোহেল: ডিজনি প্লাস ব্যবহারকারীকে তাঁর উপযোগী কনটেন্ট সাজেস্ট করা, কোন কনটেন্ট তিনি বাফারিং ছাড়া দেখতে পারবেন, সেটি খুঁজে বের করা, ফ্রড চেকিং (যেমন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে যেন তিনটির বেশি ডিভাইস থেকে লগইন করা না হয়) নিশ্চিত করা, বিভিন্ন অ্যালগরিদমে ব্যবহারকারীকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া—সহজ করে বললে আমাদের টিম এই কাজগুলো করে।

প্রথম আলো:

আপনি তো ২০ বছর ধরে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে আছেন। ডিজনির আগে কোথায় ছিলেন?

জাহিদ সোহেল: ২০০২ সালে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (এআইইউবি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে প্রেসিডেন্টস গোল্ডমেডেল পেয়ে স্নাতক করি। তারপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেছি। এরপর ফুল ফ্রি স্কলারশিপ নিয়ে সুইডেনের স্টকহোমের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেম নিয়ে মাস্টার্স করি। পড়াশোনা করতে করতেই চাকরি হয়ে যায়। সুইডেনে প্রায় ১৭ বছর কিউলিক (ক্লিক নামেই পরিচিত), সনি মোবাইলফোনস, আইকিয়ার মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি।

প্রথম আলো:

সুইডেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কেন এলেন?

জাহিদ সোহেল: ওখানে সব ঠিকই ছিল, তবে পরিবারকে মিস করছিলাম। আমার মা–বাবা, ভাই–বোনকে। তারপর ওরা সবাই যখন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হলো, আমিও স্ত্রী, তিন সন্তান নিয়ে উড়াল দিলাম যুক্তরাষ্ট্রে। ওখানে সাতটা ভাইভার পর ডিজনিতে এখন যে বিভাগে চাকরি করছি, সেখানে চাকরি হলো। শুরুতে অন্য একটা বিভাগে ছিলাম।

জাহিদ সোহেল
ছবি: সংগৃহীত
প্রথম আলো:

এআইইউবিতে কেন ভর্তি হয়েছিলেন?

জাহিদ সোহেল: অনেকের ধারণা, যাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না, আর ‘বাপের টাকায় ফুটানি করে’, তাঁরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আমি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলাম। সেটা ছিল ঢাকার বাইরে। আর সাবজেক্টটাও পছন্দ হয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় পেয়েছি। এখানে পড়েছি মায়ের টাকায়।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

আপনি যখন সিএসইতে ভর্তি হন, তখন তো এ বিষয়টা প্রায় নতুন। কেন আগ্রহী হলেন?

জাহিদ সোহেল: শুরুতে ভর্তি হয়েছিলাম বিবিএতে। ওখানে এক বছর পড়ার পর মনে হলো, বিষয়টা আমার জন্য নয়। সিএসই (কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) তুলনামূলকভাবে নতুন। সেখানে নতুন গবেষণা, উদ্ভাবনের সুযোগ আছে। ভর্তি হয়ে গেলাম। এআইইউবির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান ডিন মশিউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। তিনিই আমাকে টিএ (টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট) হিসেবে সিলেক্ট করে আমার ক্যারিয়ার শুরু করতে সাহায্য করেছিলেন।

প্রথম আলো:

প্রথম কম্পিউটার কিনলেন কবে?

জাহিদ সোহেল: অনেক পরে। প্রথম আড়াই বছর আমি আমার বন্ধুর কম্পিউটার ব্যবহার করেছি। সারা দিন ক্লাস করতাম। ক্লাস শেষে টিউশনিতে যেতাম। বাসায় ফিরে পড়াশোনা করতাম। খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতাম। রাতে যেতাম বন্ধুর বাসায়। বন্ধু সব কাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়লে ওর কম্পিউটার ব্যবহার করে প্রোগ্রামিং করতাম। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে তারপর ঘুমাতাম। এভাবেই চলেছে দুই বছর। থার্ড ইয়ারে যখন কম্পিউটার কিনি, দেখলাম বাংলাদেশে তখন কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আলাদা আমদানি করে একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে সফটওয়্যার ইনস্টল করে বিক্রি করা হচ্ছে। আমরাও কয়েকজন বন্ধু মিলে এই ব্যবসা শুরু করলাম। মূলত আমিই কারিগরি দিকগুলো দেখভাল করতাম। সে সময় প্রায় ৮০ থেকে ১০০টা কম্পিউটার বিক্রি করি। এরপর আমি এআইইউবিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করি।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

আপনি তাহলে ছাত্রাবস্থা থেকেই ‘ধনী’ বলা যায়!

জাহিদ সোহেল: (হাসতে হাসতে) কীভাবে! লাভের টাকা বন্ধুদের মধ্যে ভাগ হয়ে যেত না? তবে মোটামুটি সচ্ছলতা এসেছিল বলতে পারেন।

প্রথম আলো:

ব্যবসা করতে নেমে নিশ্চয়ই পড়াশোনার বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে বুঝেছিলেন, যেহেতু কম্পিউটার নিয়েই পড়ালেখা।

জাহিদ সোহেল: একদম, একদম। আরও যেটা বুঝলাম, সেটা হলো কীভাবে উদ্যোক্তা হতে হয় বা বড় একটা দল চালাতে হয়। ওখান থেকেই মূলত বড় স্বপ্ন দেখার সাহসটা জুটে গেল।

বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর
ছবি: জাহিদ সোহেলের সৌজন্যে
প্রথম আলো:

ছাত্রাবস্থায় আপনি তো সফটওয়্যার বানিয়েছেন?

জাহিদ সোহেল: ক্লাসমেট খালেদের সঙ্গে আমি তখন ‘স্মার্টহোম’ বানাই। অফিস বা দূর থেকেই কীভাবে বাসার লাইট, ফ্যান, এসি, টেলিভিশন, চুলা বন্ধ (বা চালানো) যায়, এমন সফটওয়্যার তৈরি করি। এখন শুনলে হয়তো অনেকে বলবে, এ আর এমন কী! এখন তো এই প্রযুক্তি ঘরে ঘরে। তবে ২০০০ সালের দিকে এটা বড় ব্যাপার ছিল। ২০০২ সালে আমি এআইইউবির ক্যাম্পাসগুলোতে যেন পিএবিএক্সের নেটওয়ার্ক ছাড়াই ইন্টারনেট-টেলিফোনের সাহায্যে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়, সে জন্য একটা সফটওয়্যার লেখার কাজ শুরু করেছিলাম। এ জন্য অ্যামাজন থেকে টেলিফোন এপিআইয়ের (অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস) ওপর বই কিনে দিয়েছিলেন আমার ছাত্রের বাবা, সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান। সিসকোর টেলিফোন পরে এক্সাক্টলি যেটা করেছে! তবে কাজটা শেষ করতে পারিনি। কেননা তার আগেই আমার সুইডেনে স্কলারশিপ হয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

আপনি তো বাড়ির ছোট ছেলে। ঢাকার বাইরেই পড়তে গেলেন না। সুইডেনে গিয়ে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি?

জাহিদ সোহেল: ভাগ্যিস ২০০৫ সালে ওয়ান ওয়ে টিকিট করেছিলাম। রিটার্ন টিকিট করার টাকা ছিল না। যদি থাকত, মাস্টার্স না করেই চলে আসতাম! কোনো দিন মা ছাড়া থাকিনি, রান্নাবান্না কিছুই জানি না…কোনো দিন একটা ডিম ভেজেও খাইনি। অবস্থা এমন হয়েছিল—হয় আমাকে নিজের কাপড় নিজেই ধুতে হবে, নয়তো নোংরা কাপড় পরে ক্লাসে যেতে হবে। হয় বিছানা পরিষ্কার করতে হবে অথবা ময়লা বিছানায় ঘুমাতে হবে। হয় নিজে রান্না করতে হবে নতুবা না খেয়ে থাকতে হবে। আক্ষরিক অর্থেই আমি আকাশের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। প্রথম কয়েকটা মাস খুবই কঠিন ছিল। পরে ধীরে ধীরে সবকিছু শিখতে শুরু করলাম। মাকে ফোন করে রান্নার রেসিপি নিতাম (তখন ইউটিউব ছিল না)। একদিন রান্না করে কয়েক সপ্তাহ চলত। রেজাল্টও ভালো হতে শুরু করল। সে সময় আমি বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করার একটা পার্টটাইম জব নিয়েছিলাম। প্রায় ১০ মাসের মাথায় আমার একটা চাকরি হলো। সবার আগে প্লেনের টাকা গুছিয়ে দেশে এসে বিয়ে করলাম। ২০০৬ সালে স্ত্রী ফারহানা কবিরকে নিয়ে সুইডেন ফিরলাম। আমার তিন সন্তানের জন্মই সুইডেনে।

প্রথম আলো:

কী মনে হয়, আপনার কোন গুণটা আপনাকে এআইইউবির বিবিএর একজন সাধারণ ছাত্র থেকে ডিজনি প্লাসের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠানের উঁচু পদে নিয়ে গেল?

জাহিদ সোহেল: আমরা তিন ভাই-বোনই এ গুণটা পেয়েছি আমাদের মায়ের কাছ থেকে। যে কাজটাই করি, সুন্দরভাবে করার চেষ্টা করি। নিজের সেরাটা ঢেলে করার চেষ্টা করি। সেটা যেন সবার চেয়ে ভালো হয়, সেই থাকে লক্ষ্য। এখন পর্যন্ত আমি যতগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছেড়েছি, তার একটাই কারণ ছিল, আমি আরও ভালো চাকরি পেয়েছি। আমার এই জার্নিতে বাবা-মা, ভাইয়ের পাশাপাশি আলাদা করে আমার স্ত্রীর ভূমিকার কথা বলতেই হবে। সে–ও সিএসইর শিক্ষার্থী ছিল। ওর রেজাল্ট আমার চেয়েও ভালো। ও নিজের ব্যক্তি ও পেশাজীবনে অনেক ছাড় দিয়ে আমাকে সমর্থন করেছে। আমার জার্নিতে তাই আলাদা করে আমার জীবনসঙ্গীর কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।