অধরা কে-টু জয়ে আনন্দ ও সারগির জন্য শোক

কে-টুর পথে নির্মল পুর্জা ও তাঁর দল

পর্বতারোহণের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ছিল গত শুক্রবার। হাজার বছরের অধরা একটি স্বপ্ন সেদিন পূরণ হলো। এই প্রথম শীতকালে নেপালের কয়েকজন পবর্তারোহী বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কে-টু চূড়ায় পৌঁছাতে সফল হলেন। এত বছর ধরে বহু পর্বতারোহী এই চেষ্টা চালালেও কেউই সফল হতে পারছিলেন না।

শীতকালীন পর্বতারোহণ ইতিহাসে একমাত্র অধরা ছিল চায়না-পাকিস্থান বর্ডারের কারাকোরাম রেঞ্চের সর্বোচ্চ পর্বত এবং বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কে-টু (৮৬১১ মিটার)। পবর্তটিকে বলা হয় দ্য কিং অব মাউন্টেন।

কে-টুর পথে মিংমা ও দুই সহ–অভিযাত্রী

১৬ জানুয়ারি বিকেলে ১০ জনের একটি নেপালি টিম কে-টু চূড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। পর্বতারোহণের ইতিহাসে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। অন্য যেকোনো আট হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বতের চেয়ে কে-টু অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। পর্বতটি এতই ভয়ংকর যে এখানে অভিযানে মৃত্যুহার প্রতি চারজনে একজন। ১৯৫৪ সালের ৩১ জুলাই প্রথমবারের মতো কে-টু সামিট করেন ইতালিয়ান দুই পর্বতারোহী এচিলে কমপ্যাগনোনি ও লিনো ল্যাচেডেলি।

২০১৭ সালে নেপালের থামেলে মিংমার সঙ্গে লেখক

কিন্তু শীতকালে এই পর্বতের চূড়ায় পৌঁছতে পারছিলেন না কেউই।

শীতকালে কে-টু চূড়ায় পৌঁছানোর অনেক চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৩ সালে জর্জিয়া, উজবেকিস্তান আর কাজাখস্তানের কয়েকজন পর্বতারোহী ৭৬৫০ মিটার পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন।

এবারের শীতকালীন অভিযানে দুটি দল অংশগ্রহণ করে। বিশ্ববিখ্যাত পর্বতারোহী নির্মল পুর্জার নেতৃত্বে একটি ও মিংমা গ্যালজে শেরপার নেতৃত্বে একটি দল। দুটি দল আলাদা আলাদাভাবে অভিযান শুরু করলেও ক্যাম্প ১ থেকে একসঙ্গে অভিযান করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত ১০ জনের মিলিত টিম এ অভিযান সম্পন্ন করেন। ১০ জন হচ্ছেন নির্মল পুর্জা, মিংমা ডেভিড শেরপা, গেলজি শেরপা, মিংমা গেইজেল, সোনা শেরপা, মিংমা তেনজি শেরপা, পেম চিরি শেরপা, দাওয়া তেম্বা শেরপা, কিলি পেম্বা শেরপা, দাওয়া তেনজিং শেরপা।

২০১৫ সালে মাউন্ট ক্যাজুরি বেসক্যাম্পে কিলির সঙ্গে

পর্বতারোহী দুটি দলের মধ্যে মিংমা গ্যালজে ও কিলি পেম্বাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাই এবারের অভিযানে এই দুজনকে নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। মিংমার মালিকানাধীন ইমাজিন নেপাল পর্বতারোহণ এজেন্সির সাথে ২০১৫ সালে মাউন্ট ক্যাজুরি অভিযানে আমি বেসক্যাম্প পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেই অভিযানে সামিট টিমকে লিড করছিলেন কিলি পেম্বা। কিলির সাথে মাউন্ট ক্যাজুরির বেসক্যাম্পেই পরিচয়। সেবার মাত্র ক্যাজুরি চূড়া থেকে একটা অভিযান শেষ করে আবার আমাদের টিমকে নিয়ে সামিটে গিয়েছিলেন। অভিযান শেষে তিনি যখন বেসক্যাম্পে নেমে এলেন, আমি শুধু তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পুরো মুখ সানবার্নে কালো হয়ে আছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হবার অবস্থা। হাসতেও পারেন না ঠিকঠাক। চুপচাপ স্থির একটা মানুষ। কিছু বললে একটু–আধটু কথা বলেন। আলাপকালে জেনেছিলাম তখন পর্যন্ত ছয়বার এভারেস্ট সামিট করেছেন তিনি। এতই সাবলীলভাবে বলেছিলেন যে আমি অবাক হওয়ার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

এবারের অভিযানে মৃত সারগি মিনগোতে

মিংমা গ্যালজের সঙ্গেও ওই অভিযানেই প্রথম দেখা। এর আগে তাঁর গল্প অনেক শুনেছি। সেবার ক্যাজুরি অভিযান সফল হওয়ায় তাঁর অফিস কাম বাসায় আমাদের লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করেন। সেই থেকে মিংমার সঙ্গে বন্ধুত্ব। অসাধারণ একজন মানুষ। তখন তিনি বিশ্বের ১৪টি ৮ হাজার মিটার উঁচু পর্বত অভিযানের মিশন শুরু করছিলেন। আজ তিনি পর্বতারোহণের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্পর্শ করলেন।

এই অভিযান একদিকে যেমন আনন্দের খবর নিয়ে এসেছে, তেমনি বেদনার বার্তাও আছে। অভিযানে আজ মারা গেছেন স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ একজন পর্বতারোহী সারগি মিংগোতে। ২০১৮ সালে সারগি মিংগোতে অক্সিজেন ছাড়াই কে-টু চূড়ায় আরোহণ করেন। গত ডিসেম্বরে তিনি শীতকালীন এই অভিযানে অংশ নিতে পাকিস্তানে আসেন। আজ তিনি কে-টুর ক্যাম্প-‌১ থেকে অ্যাডভান্স বেজ ক্যাম্পে আসার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান। সারগির জন্য আমরা শোকাহত।

লেখক: পর্বতারোহী