অন্য ভালোবাসা দিবসে, অচেনা বার্সেলোনায়

ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে বার্সেলোনা শহরের একটি ভবন
ছবি: লেখক

পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের চক্করে পড়ে তিন মাস ধরে স্পেনের বার্সেলোনাতেই আছি। রাস্তাঘাট বেশ চেনা হয়ে গেছে। কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে ২৩ এপ্রিলের বার্সেলোনা হয়ে গেল সম্পূর্ণ অচেনা এক নগরী। কল্পনার শহরের সঙ্গে সেদিন এই কাতালুনিয়ান শহরটির পার্থক্য ছিল ভীষণ অল্প! পুরো শহর ভেসে গিয়েছিল গল্প আর প্রেমে, বইয়ে আর গোলাপে। ‘ভালোবাসা দিবস’ বলতে আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইনস ডে বুঝি। তাই ২৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ যখন বার্সেলোনার অলিগলি, বারান্দা-রাজপথ ভালোবাসার বার্তায় ছেয়ে গেল, অবাক হতে হলো!

ভ্যালেন্টাইনস ডের সঙ্গে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রেম ও ত্যাগের ইতিহাস জড়িয়ে আছে বটে, তবে সমালোচকেরা বলেন, সেখানে এখন ভালোবাসার উষ্ণতার সঙ্গে পুঁজিবাদের ঘোর মাখামাখি! ভালোবাসার দিনে দামি উপহার আদান-প্রদানের পুঁজিবাদী নিয়মের কট্টর সমালোচকদের দলে আছেন কাতালুনিয়ানরাও। তাই ভ্যালেন্টাইনস ডে নয়, বরং নিজস্ব সংস্কৃতির একটি দিনকে বই ও ফুলের আবরণে মুড়িয়ে ‘ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালন করেন তাঁরা।

২৩ এপ্রিল ভিন্ন এক রূপ পায় বার্সেলোনা শহর
ছবি: লেখক

তবে ভ্যালেন্টাইনস ডের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছেন ভ্যালেন্টাইন নামের এক সাধু, তেমনি কাতালুনিয়ানদের ভালোবাসা দিবসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন এক সাধু। বলা হয়ে থাকে, বহু আগে মন্টব্ল্যাংক নামের এক কাতালুনিয়ান গ্রামে আবির্ভূত হয়েছিল এক ভয়াবহ ড্রাগন। গ্রামে নিয়মিত ধ্বংসলীলা চালিয়েও ক্ষান্ত হলো না সে ড্রাগন, বন্দী করল রাজকন্যাকেও। একদিকে রাজকন্যার জন্য দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে গ্রামকে রক্ষা করার তাগিদে রাজামশাই যখন পাগলপ্রায়, তখনই হঠাৎ সাদা ঘোড়ায় চেপে হাজির হলেন এক সুদর্শন যুবক। যুবকের নাম সেন্ট হর্দি। প্রলয়ংকরী যুদ্ধ শেষে দুর্দান্ত সাহসী হর্দি ভয়ংকর ড্রাগনকে বধ করলেন, উদ্ধার করলেন রাজকন্যাকে। আর রাজকন্যা ভালোবেসে হর্দির হাতে তুলে দিলেন লাল টুকটুকে গোলাপ। এরপর কী হলো বলে ভাবছেন? ধুমধাম করে রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে? সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব? রাজা তেমনটাই চেয়েছিলেন! তবে রাজি হলেন না সাধু হর্দি। হঠাৎ যেমন রক্ষাকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি, তেমনি হঠাৎ বিদায় নিলেন।

প্রেম ও সাহসের এই গল্প সময় ও অঞ্চলভেদে আরও বিভিন্নভাবে বলা হয়। তবে সাধু হর্দির সাহস ও প্রেমের কথা সবখানেই অপরিবর্তনীয়। ২৩ এপ্রিলের কাতালুনিয়ানদের ভালোবাসা দিবসের নাম তাই ‘সেন্ট হর্দিস ডে’। প্রেম ও সাহসের প্রতীক সাধু হর্দিকে কাতালুনিয়ার বাসিন্দারা নিজেদের ‘প্যাট্রন’ বা অভিভাবক মনে করে, আর সেখান থেকেই দিবসটির এমন নামকরণ।

রাস্তার দুই পাশে তাঁবুতে ঘেরা এমন স্টলে বিক্রি হয় বই
ছবি: লেখক

২৩ এপ্রিল বার্সেলোনার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি যখন দিবসটির ইতিহাস খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখনই দেখা হলো বার্সেলোনার সিটি কাউন্সিলে কর্মরত মারিয়া দেল কারমেনের সঙ্গে। মারিয়া নিজেও কাতালুনিয়ান, তাই দিনটি নিয়ে তার নিজেরও উৎসাহ-আবেগ অপরিসীম। তাকেই বললাম, ভালোবাসা দিবসে গোলাপ বিনিময়ের বিষয়টি না হয় বুঝলাম, তবে ভালোবাসার সঙ্গে তোমরা বইয়ের সংযোগ ঘটালে কীভাবে? মারিয়া বলল, ‘এ জন্য আমরা লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেলের কাছে চিরঋণী।’ ক্লাভেলই প্রথম বলেছিলেন যে শুধু সেন্ট হর্দির ড্রাগন বধের দিবস হিসেবে নয়, ২৩ এপ্রিলের আছে আরও তাৎপর্য। ইংরেজি সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার ও স্প্যানিশ সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক মিগুয়েল দে সেরভান্তেস—উভয়েরই প্রয়াণদিবস ২৩ এপ্রিল! বিশ্বসাহিত্যের এই দুই বরপুত্রের স্মরণে তাই ক্লাভেলের উদ্যোগেই প্রথম ভালোবাসার মানুষকে বই দেওয়ার প্রথা চালু হয় কাতালুনিয়ায়।

ইউনেসকো বার্সেলোনাকে দিয়েছে ‘সিটি অব লিটারেচার’ বা ‘সাহিত্যের শহর’ সম্মাননা। এ শহরের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন, জর্জ অরওয়েল, মারিয়ো বার্গাস ইয়োসার মতো বিশ্ববরেণ্য বহু লেখকের কল্পতরু। এ শহরেই জন্মেছেন হুয়ান মারসে, জে ভি ফয়েক্সের মতো বিশ্বখ্যাত কবি-সাহিত্যিক। শুধু তা–ই নয়, কাতালান ও স্প্যানিশ ভাষায় সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশিতও হয় এ শহর থেকেই। আদর করে স্থানীয় বাসিন্দারা বার্সেলোনাকে তাই বলে ‘বুক ক্যাপিটাল’ বা ‘বইয়ের রাজধানী’।

তেমন ভুল কিছু স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য বলেন না। শহরজুড়েই তো দেখছি অসংখ্য বইয়ের দোকান, বুক ক্যাফে আর লাইব্রেরি। যে গলিতে একটা দোতলা বিল্ডিং আর পাকুড়গাছ ছাড়া কিচ্ছু নেই, সে গলির মোড়েও সগৌরব দাঁড়িয়ে আছে বইয়ের দোকান। বুঝতেই পারছেন, ভালোবাসা দিবসে তাই এই শহরে বই বিনিময় হওয়ার বিষয়টি এক্কেবারে সোনায় সোহাগা। ইতিহাস অবশ্য বলছে, সেন্ট হর্দিস ডেতে নাকি বই দেওয়া হতো শুধুই ছেলেদের, আর মেয়েরা পেত গোলাপ। কালের পরিক্রমায় পুরুষতান্ত্রিক সেই নিয়ম উঠে গেছে, ছেলে–মেয়ে উভয়ই বই বিনিময় করে এখন।

বার্সেলোনা সিটি কাউন্সিলের উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল সেদিন। রাস্তার দুই পাশে সাদা তাঁবুতে ঘেরা স্টল বসিয়ে বিক্রি হচ্ছিল বই আর লাল গোলাপ। রাস্তায় নেমে এসেছিল বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সে এক দেখার মতো দৃশ্য! লাল গোলাপ আর রঙিন মলাটের বই আঁকড়ে ধরে কোথাও খিলখিল করে হাসছে বাবার কাঁধে বসা ছোট্ট মেয়ে। কোথাও স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি মায়ের কাছে বায়না ধরেছে আরেকটি বই কিনে দিতে। স্টেশনের কাছে দেখলাম প্রেমিকের হাতের মুঠোয় ধরা প্রেমিকার হাত থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা নীলচে গোলাপ—লাল গোলাপের পর এখন হয়তো ভালোবাসার নতুন প্রতীক হবে সে-ই! রাস্তায় পেয়ে গেলাম হোসে কাস্তেলো আর মারিয়া ভার্গেসোর মতো এমন অনেক যুগল, যাঁরা জানালেন ভালোবাসার সুন্দরতম প্রতীক হলো বই আর ফুল!

যে শহরের বাতাসে মিলেমিশে যায় বইয়ের পাতার ঘ্রাণ আর ফুলের ঘ্রাণ, সেখানে তো ভালোবাসার ফুরফুরে হাওয়া বইবেই। তা–ই তো হওয়ার কথা!