অপূর্ব সবুজের শহর: ট্রাবজোন

ট্রাবজোন শহরের প্রাণকেন্দ্র খ্যাত মেয়দান
ছবি: লেখক

ইরাসমাস প্লাস এক্সচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় তুরস্কে এসেছি। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁদের প্রায় সবাই ইরাসমাস প্লাস এক্সচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের সঙ্গে পরিচিত। এটি হচ্ছে একধরনের মোবিলিটি প্রোগ্রাম, যেখানে কোনো একজন শিক্ষার্থী তাঁর নিজস্ব ইউনিভার্সিটির সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড এমন কোনো ইউনিভার্সিটিতে একটি নির্দিষ্ট সেমিস্টার কিংবা একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাবর্ষ সম্পন্ন করতে পারেন। এটি একটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম, তাই যখন কোনো শিক্ষার্থী ইরাসমাস প্লাস এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান, তখন তাঁকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ প্রদান করা হয় স্টাইপেন্ড হিসেবে।
ইরাসমাস প্লাস স্টাডি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের জন্য ইউরোপের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পছন্দ স্পেন, পর্তুগাল ও হাঙ্গেরি। তবে আমার পছন্দের দেশ ছিল তুরস্ক।

সেই ২০১৭ সালের কথা, বাংলাদেশ থেকে প্রথম ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। টার্কিশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটের সুবাদে ইস্তাম্বুলে যাত্রাবিরতির সুযোগ হয়। ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে আমাদের ট্রানজিট ছিল প্রায় আট ঘণ্টার। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ফ্লাইটটি ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে ল্যান্ডিংয়ের সময় প্লেনের জানালা দিয়ে ইস্তাম্বুলের যতটুকু রূপ দেখতে পেরেছিলাম, সেটাই যেন অন্তরে চিরজীবনের জন্য গেঁথে গিয়েছিল। কল্পনায় ঘুরেফিরে তাই বারবার ফিরে আসত ক্ষণিকের স্বাদ পাওয়া সেই সুন্দর মুহূর্তটির।

ট্রাবজোন ওয়ালের সামনে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

এর পর থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। কবে ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করতে পারব। বিমান থেকে সামান্য সময়ের জন্য ইস্তাম্বুলের যতটুকু দৃশ্য চোখে ধরা দিয়েছিল বারবার যেন মনে হচ্ছিল সেটি ছিল জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ইউরোপের অনেক দেশ এবং অনেক নগর ঘুরলেও তুরস্ক ও ইস্তাম্বুলের প্রতি ছিল আলাদা ক্ষুধা। তাই ইরাসমাস প্লাস এক্সচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় যখন তুরস্কের কুথাহইয়া ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিস্টার পড়াশোনার সুযোগ আসে, আমি সেটিকে লুফে নিতে ভুল করিনি।

বাংলাদেশ থেকে যাঁরা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের কোনো দেশে ভ্রমণে যান, তাঁদের অনেকে তুরস্ককে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করেন। টার্কিশ এয়ারলাইনের প্রধান হাব আধুনিক তুরস্কের সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত ইস্তাম্বুলে। একসময় সমগ্র মুসলিম জাহানের খেলাফত পরিচালিত হতো এ শহর ঘিরে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা সাধারণত যাত্রাবিরতির সময়টিকে বেছে নেন তুরস্ক ভ্রমণের জন্য।

ওইসিডিভুক্ত যেকোনো দেশের ভিসা থাকলে তুরস্কের ই-ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। এ কারণে যাঁরা ই-ভিসা নিয়ে তুরস্ক ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন, তাঁদের বেশির ভাগই মূলত ইস্তাম্বুল ভ্রমণের উদ্দেশে তুরস্কের ই-ভিসার আবেদন করেন, কেননা যাত্রাবিরতির এ সময়ে কেবল ইস্তাম্বুল ছাড়া তুরস্কের অন্য কোনো দর্শনীয় স্থান সেভাবে উপভোগ করা যায় না। পরিপূর্ণভাবে ইস্তাম্বুলের স্বাদ পেতে হলে আপনাকে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ দিন সময় হাতে রাখতে হবে। কিন্তু এ সময়টুকুও তাঁদের হাতে থাকে না।

ইস্তাম্বুলের পাশাপাশি তুরস্কের অন্যান্য জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে ইজমির, আনতালিয়া, চানাক্কেলে, বুরসা, ডেনিজলি, কাপাদোকিয়া, গাজিআনতেপ ও মুলা। এ কারণে খুব বেশি মানুষ ‘ট্রাবজোন’ নামটির সঙ্গে পরিচিত নয়। তবে কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, তুরস্কে ইস্তাম্বুলের পর আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি? আমি একবাক্যে সবার আগে ট্রাবজোনের কথা বলব।

ট্রাবজোন যাওয়ার পথে সামসুন থেকে শুরু করে অরদু, গিরেসুন এবং রিজে পর্যন্ত পুরো অংশ জুড়ে কৃষ্ণসাগরের তীরে এরকম দৃশের দেখা পাওয়া যায়
ছবি: লেখক

তুরস্কে আমার এক বন্ধু রয়েছে, তার নাম মুরাত আকতায়। ইরাসমাস প্লাস এক্সচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় সে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল এক সেমিস্টারের জন্য। মুরাত তুরস্কের সবচেয়ে সেক্যুলার শহর হিসেবে পরিচিত ইজমিরের অধিবাসী। মুরাতের মাধ্যমে আমি প্রথম ট্রাবজোন সম্পর্কে জানতে পারি। তুরস্কের সবচেয়ে সবুজ অঞ্চল হিসেবে ট্রাবজোনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উত্তর-পূর্ব তুরস্কে কৃষ্ণসাগরের কোল ঘেঁষে ছোট অথচ ছবির মতো সুন্দর এ শহরটির অবস্থান। যদিও ট্রাবজোন শহর হিসেবে সে অর্থে পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি, বিশেষ করে ট্রাবজোনের অনেক জায়গায় আপনি পুরোনো ঢাকা কিংবা পুরোনো দিল্লির একটা ছাপ খুঁজে পাবেন।

ট্রাবজোনের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি এ ধরণের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত
ছবি: লেখক

এ শহরের জীর্ণশীর্ণ রাস্তাঘাট, পুরোনো দালানকোঠা, উপমহাদেশের আদলে গড়ে ওঠা ছোট ছোট হাটবাজার কিংবা মাছের আড়ত দেখলে আপনি খানিক সময়ের জন্য নস্টালজিক হয়ে উঠতে পারেন। বৃষ্টির দিনে ট্রাবজোনের এসব জীর্ণশীর্ণ রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে, তাই ট্রাবজোনে পা রাখতে না রাখতে আমার চোখের সামনে শান্তিনগরের চেহারা ভেসে আসছিল, যদিও শান্তিনগরের মতো ট্রাবজোনে সে রকম জলাবদ্ধতা দেখা যায় না।

ইউরোপের কোথাও সরাসরি কোনো পশু কিংবা পাখিকে জবাই হতে দেখা যায় না। অথচ ট্রাবজোনের এসব হাটবাজারে আমি সরাসরি কসাইকে মুরগি জবাই করতে দেখেছি। আমাদের দেশের কাঁচাবাজারের মতো ট্রাবজোন শহরের বিভিন্ন জায়গায় দোকানিরা শাকসবজি ও তরিতরকারির পসরা সাজিয়ে বসেন। কারওয়ান বাজার কিংবা সোয়ারী ঘাটের মতো মাছের আড়ত দেখতে পাবেন এ শহরে। কারণ, মৎস্য উৎপাদনে গোটা তুরস্কের মধ্যে ট্রাবজোন অত্যন্ত প্রসিদ্ধ এক অঞ্চল। মোটকথা ট্রাবজোনে আসলে আপনি অনেকটা বাংলাদেশের মতো অনুভূতি পাবেন, হাজার মাইল দূর থেকেও নিজ দেশের স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।

ট্রাবজোন শহর। বজটেপে থেকে তোলা ছবি
ছবি: লেখক

মধ্যযুগে ইউরোপ ও এশিয়া এই দুই মহাদেশের মধ্যে বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সিল্ক রোড ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাতায়াত সড়ক। সিল্ক রোডের একটি অংশ এ ট্রাবজোন শহরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। বিশেষ করে তৎকালীন দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় পারস্যের সঙ্গে উত্তর–পূর্বের ককেশাস অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল এ ট্রাবজোন শহরের মধ্য দিয়ে। ট্রাবজোনে উৎপাদিত সিল্ক, লিনেন এবং উলের তৈরি বিভিন্ন বস্ত্রজাতীয় দ্রব্য একসময় ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিল বিলাসিতার প্রতীক।

শীতের দিনে উজুনগোল যেন রূপকথার স্নো হোয়াইট হিসেবে আবির্ভূত হয়
ছবি: লেখক

ধারণা করা হয়, বারো বা তেরো শতকের কোনো একসময় ট্রেবিজোন্ড সাম্রাজ্যের শাসকদের হাত ধরে গোড়াপত্তন হয় এ ট্রাবজোন শহরের। ট্রাবজোন নামটি ট্রেবিজোন্ড শব্দটির অপভ্রংশ। সে সময় গ্রিসসহ পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বাইজেন্টাইনদের শাসন প্রচলিত ছিল। এ কারণে প্রথম দিকে গ্রিক কিংবা রোমান স্থাপত্যকলার অনুকরণে এ শহরের বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলী গড়ে ওঠে, যার নিদর্শন আজও খুঁজে পাওয়া যায় ট্রাবজোনে অবস্থিত আয়া সোফিয়া কিংবা সুমেলা মনাস্টেরির মধ্য দিয়ে। আয়া সোফিয়া এবং সুমেলা মনাস্টেরি ইউনেসকো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত।

বর্তমান ট্রাবজোনের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে আয়া সোফিয়া এবং সুমেলা মনাস্টেরি অন্যতম। দুই বছর আগে যখন আমি ট্রাবজোন ভ্রমণে যাই তখন সুমেলা মনাস্টেরির সংস্কারকাজ চলছিল। তাই সাময়িকভাবে সেটিকে পর্যটকদের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। গ্রিক পুরাণে ‘সোফিয়া’ হচ্ছেন জ্ঞানের দেবী এবং প্রাচীনকালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী ধর্মযাজককে সোফিয়া উপাধিতে ভূষিত করা হতো। বাইজেন্টাইনদের সমাজব্যবস্থায় তিনি ছিলেন রাজার মতোই একজন গুরুত্বপূর্ণ পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

ট্রাবজোনের আয়া সোফিয়া। ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়ার সঙ্গে এর সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়
ছবি: লেখক

ইস্তাম্বুলে অবস্থিত আয়া সোফিয়ার সঙ্গে ট্রাবজোনের এ আয়া সোফিয়ার সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়, তবে ট্রাবজোনের এ আয়া সোফিয়া আয়তনে অনেক ক্ষুদ্র এবং ইস্তাম্বুলে অবস্থিত আয়া সোফিয়ার তুলনায় বেশ পুরোনো। আনুমানিক ১২৬৩ সালে এ আয়া সোফিয়াটি নির্মাণ করা হয়। মূলত ট্রাবজোন ও এর আশপাশের অঞ্চলের প্রধান অর্থোডক্স চার্চ হিসেবে আয়া সোফিয়া নির্মাণ করা হয়েছিল।

ক্যাথলিক চার্চের মতো অর্থোডক্স চার্চগুলো পোপ প্রথায় বিশ্বাস করে না। তবে যিনি সোফিয়ার প্রধান পুরোহিত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তাঁকে সেকালে সমাজের প্রভাবশালী জ্ঞানসাধক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৪৫৩ সালে অটোমানরা ট্রাবজোনের অধিকার লাভ করে। সে সময় এ আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা হয় এবং বাইজেন্টাইন শাসনামলের সব নিদর্শনকে পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ট্রাবজোনের আয়া সোফিয়াটি আজকের দিনেও নামাজের জন্য উন্মুক্ত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের জনক মোস্তফা কামালের হাত ধরে সমগ্র তুরস্কে সেক্যুলারিজম মুভমেন্ট শুরু হয়। তবে তুরস্কের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী শহরগুলোতে সেক্যুলারিজমের প্রভাব অনেক কম। তুলনামূলকভাবে তাই বলা চলে, তুরস্কের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলের মানুষ অধিকমাত্রায় ধর্মভীরু। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের পৈতৃক নিবাস ট্রাবজোন শহরের নিকটবর্তী একটি ছোট উপশহর রিজেতে।

ঐতিহ্যগতভাবে ট্রাবজোনে এভাবে বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ছবিটি ছেরাগোল থেকে তোলা
ছবি: লেখক

বাণিজ্যিক কেন্দ্র কিংবা সমুদ্রবন্দর যেভাবে হোক না কেন, এ শহরটি প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তুর্কি ভাষায় কৃষ্ণসাগরকে ‘কারা দেনিজ’ বলা হয়। ট্রাবজোন থেকে কারা দেনিজের মধ্য দিয়ে ক্রিমিয়া এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশ কিছু অঞ্চলের মধ্যে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের এক দ্বার সূচিত হয়েছিল, যা আজও চলমান। তবে এটা দুঃখজনক যে এ শহরটি আশানুরূপভাবে পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে ওঠেনি। এখনো কিছু জায়গায় অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট দেখা যায়, খোলা বাজারেরও দেখা মেলে এবং রাস্তায় সরাসরি মুরগি জবাই করতে দেখা যায়।
কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী এ অঞ্চলকে তুরস্কের মধ্যে সবচেয়ে সবুজ অংশ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। চোখজুড়ানো সবুজের অপার্থিব সৌন্দর্যের জন্য তাই ট্রাবজোন সব সময় বিখ্যাত এবং সবুজাভ এ স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে আরব দেশগুলো থেকে প্রচুর মানুষ প্রতিবছর ট্রাবজোন, রিজে এবং উজুনগোলে বেড়াতে আসেন।

উজুনগোলে আসলে আপনি অস্ট্রিয়া কিংবা সুইজারল্যান্ডের একটা অনুভূতি পাবেন—শীতকালে সমগ্র উজুনগোল এলাকাটি বরফে ঢেকে যায়। সে সময় এখানে বেড়াতে এলে আপনার কাছে মনে হবে আপনি যেন রূপকথার স্নো হোয়াইটের রাজত্বে হারিয়ে গিয়েছেন। ভেড়ার লোমের মতো শুভ্র তুষার এবং আশপাশের বিভিন্ন পর্বতমালা ও কাঠের তৈরি নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ছোট বাড়িঘরগুলো একীভূত হয়ে আপনার হৃদয়ে আলাদা এক অনুভূতি সৃষ্টি করবে। আবার গ্রীষ্মের দিনে ধরা দেবে চোখধাঁধানো এক সবুজের অপার্থিব সৌন্দর্য।

আমাদের দেশের সাহিত্য অনুযায়ী, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশও চিরসবুজের দেশ। তবে ট্রাবজোন ও উজুনগোলের সবুজ প্রকৃতি সবকিছুর থেকে আলাদা। সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া কিংবা লিকটেনস্টেইন অথবা বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে ট্রাবজোনের সবুজ প্রকৃতির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। শরতের উজুনগোল আরও সুন্দর। গাছের সবুজ পাতা এ সময় হলুদ কিংবা লালচে বর্ণ ধারণ করে, এরপর ধীরে ধীরে সেগুলো মাটিতে খসে পড়ে। শীতের আগমন সামনে রেখে প্রকৃতিতে যেন বিষাদের সুর ভেসে ওঠে। তবে সে বিষাদের মধ্যেও আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। কাশ্মীরের মতো উজুনগোলকেও এ পৃথিবীর ভূস্বর্গ বললে ভুল হবে না।

ট্রাবজোনের জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট পয়েন্ট ছেরাগোলে লেখক। বারবিকিউ স্পট হিসেবে এ জায়গাটি বেশ জনপ্রিয়
ছবি: সংগৃহীত

ছেরাগোল হচ্ছে ট্রাবজোন শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটি হ্রদের নাম। বারবিকিউ স্পট হিসেবে এবং বিয়ে অনুষ্ঠানের ফটোগ্রাফির জন্য এলাকাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। চারদিকে সবুজ পাহাড়বেষ্টিত এ হ্রদটিও সৌন্দর্যের দিক থেকে অপূর্ব।

দৈনন্দিন জীবনে যাতায়াতের জন্য ট্রাবজোনের বেশির ভাগ মানুষ মাইক্রোবাসের ওপর নির্ভরশীল। এসব মাইক্রোবাস অন্যান্য গণপরিবহনের মতো যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। স্থানীয়রা এসব মাইক্রোবাসকে দলমুজ বলেন। ট্রাবজোন থেকে উজুনগোলে কিংবা ছেরাগোলে আসতে হলে আপনাকে এ দলমুজের মুখাপেক্ষী হতে হবে। তবে গণপরিবহনের মতো দলমুজের নির্দিষ্ট কোনো স্টপেজ নেই।

যাতায়াতের জন্য ট্রাবজোনে এসব মাইক্রোবাস খুবই জনপ্রিয়। তুর্কি ভাষায় এ মাইক্রোবাসগুলোকে ‘দলমুজ’ বলা হয়
ছবি: লেখক

আধুনিক তুরস্কের রূপকার মোস্তফা কামাল অবকাশযাপনের জন্য মাঝেমধ্যে ট্রাবজোনে আসতেন। তিনি অবকাশযাপনের জন্য ট্রাবজোনের যে রেস্টহাউসটি ব্যবহার করতেন, মোস্তফা কামালের মৃত্যুর পর সেটিকে তাঁর স্মৃতিস্বরূপ ‘আতাতুর্ক প্যাভিলিয়ন’–এ রূপান্তর করা হয়েছে। আতাতুর্ক প্যাভিলিয়ন মূলত একটি ছোট পরিসরের স্মৃতি সংরক্ষণাগার, সেখানে প্রবেশ করতে ৪ লিরার মতো খরচ করতে হবে।

মেয়দান পার্কে আধুনিক তুরস্কের রূপকার মোস্তফা কামালের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য। তুরস্কের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ ধরনের ভাস্কর্যের দেখা পাওয়া যায়
ছবি: লেখক

শহরের প্রাণকেন্দ্র, যাকে আমরা সিটি সেন্টার বলি, তুরস্কের ভাষায় তার নাম হচ্ছে মেয়দান। ট্রাবজোনের মেয়দানেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তবে আমার কাছে তেমন একটা আহামরি মনে হয়নি। এ মেয়দান অনেকটা ঢাকা শহরের নিউমার্কেটের মতো লেগেছে। চারদিকে দোকান ছাড়া তেমন কিছুই আর সেভাবে চোখে পড়ল না।

নিউমার্কেটের থেকে একটু সামনে ঢাকা কলেজের উল্টো দিকে আমরা অনেকে যাই বিভিন্ন ধরনের প্যান্ট কিনতে। ট্রাবজোনের মেয়দানেও এ রকম বেশ কিছু দোকান দেখলাম, যেখানে আমাদের দেশের মতো জামাকাপড় বিক্রি করা হয়। ট্রাবজোনের সেন্ট্রাল পার্কটি মেয়দান পার্ক নামে পরিচিত। এর অবস্থান সিটি সেন্টারের একদম কাছে। তুরস্কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোস্তফা কামালের প্রতিকৃতি দেখা যায়। মেয়দান পার্কেও মোস্তফা কামালের প্রতিকৃতি রয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।