ট্যাক্সি সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে। যেখানে পৌঁছানোর কথা সে জায়গার নাম–নিশানা কিছুই পাচ্ছি না। উত্তর প্রদেশের ন্যাশনাল হাইওয়ে এনএইচ ৭৩১ দিয়ে চলছে ট্যাক্সি এখন। কারণ, ট্যাক্সিচালক পথ চেনেন না। আমি এসেছি লখনউ শহর থেকে। ফ্যায়জাবাদে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেখি হাতে কিছু সময় আছে। অযোধ্যা হয়ে না গেলে পাপ হবে এখন আমার। ট্যাক্সিচালকের নাম আসলাম। বিশাল বিশাল বুলি ছোটাতে ওস্তাদ, ‘হামে সব রাস্তা মালুম হ্যায়’, হ্যান ত্যান। ফ্যায়জাবাদ থেকে অযোধ্যা বেশি হলে ১৫ কিলোমিটার। আমি আসলামের বুলিকে গুলি মেরে উড়িয়ে গুগল ম্যাপের হাত ধরলাম। ফ্যায়জাবাদ থেকে অযোধ্যায় যেতে হলে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরতেই হবে।
হাইওয়ে শেষ হয়ে পথ ধীরে ধীরে একটা ছোট শহরের দিকে এগোতে থাকে। নিশ্চিত হতে এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, রামের জন্মভূমি কি এটাই? তাঁর ইতিবাচক উত্তর শুনে আসলামের ওপর রাগ ঝাড়লাম খামাখা।
পথের দুই ধারের বাড়িগুলোর বাউন্ডারি দেয়াল সব হলুদ রং করা৷ যেন হলুদ ফুল ফুটিয়েছে কেউ। এই হলুদ জলোচ্ছ্বাসের কারণ, কয়েক মাস আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন।
ভারতের যেকোনো সাধারণ মফস্বল শহর যেন। পথের পাশে শিঙাড়া, কচুরি, জিলাপির দোকান, রাস্তায় ফুটপাতে পা–মেশিন চালিয়ে সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে একমনে সেলাই করে যাচ্ছেন। তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন রামভক্তরা। কারও কপালে তিলক, কারও পরনে গেরুয়া। কোনো হইচই নেই, কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে এখন কোনো বিরোধ নেই।
বলা হয়ে থাকে, পাশে বহমান সরজু বা সরয়্যু নদীর তীরে ভগবান শ্রীরাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নদীর দিকে ঘাট বাঁধানো। অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে তবেই রাস্তার দেখা মেলে। ঘাটের কাছে কম করে হলেও ৩০০–৪০০ বছরের পুরোনো বাড়ি অটল দাঁড়িয়ে নদীর দুলে দুলে ওঠা দেখছে।
সন্ধ্যার আরতি হতে এখনো ঢের বাকি, তবুও পূজার সামগ্রী হাতে ভক্তদের ভিড় বেশিই মনে হলো। এর সঙ্গে সঙ্গে পূজারিদের ভিড়ও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই, বেশির ভাগই মাস্ক পরে নেই। লকডাউনের পর সবে মন্দির, মসজিদ, দর্শনীয় স্থান সরকার থেকে খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নদীতট থেকে চললাম রামমন্দিরের দিকে, যা একসময় ছিল বাবরি মসজিদ।
গাড়ি এক কিলোমিটার দূরে পার্ক করে রেখে পদব্রজে যেতে হবে রামমন্দিরে৷ মূল সড়ক থেকে ভেতরে পথ চলে গিয়েছে। পথের মুখে একদল পুলিশ পাহারা দিচ্ছেন। পথ শুরুই হয়েছে দুই ধারে পূজাসামগ্রীর দোকান দিয়ে। এসব দোকান আগে ছিল না। গেরুয়া ত্রিকোণ পতাকা থেকে শুরু করে সনাতন ধর্মীয় পুস্তক, রুদ্রাক্ষ, ধূপ-ধুনো, নকুলদানা, বাতাসা, লাড্ডু, মুড়ি–মুড়কি, প্লাস্টিকের খেলনা, সিঁদুর, পুজোর ঘটি, কাঁসা ও পিতলের পুজোর সামগ্রী, বিভিন্ন আকারের পিতলের প্রতিমা, তাবিজ-কবচ, এমনকি গণক পাখি কী নেই এখানে!
পথের দুপাশে অগুনতি ছোট–বড় পুরোনো মন্দির। মন্দিরের গায়ে হিন্দিতে নাম লেখা আর মন্দিরের সামনে সেবক পায়জামা–পাঞ্জাবি পরে গলায় গেরুয়া রঙের কাপড় ঝুলিয়ে ভক্তদের ডাকছে মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য। সেবকের গলার কাপড়ে হিন্দিতে লেখ ‘জয় শ্রীরাম’। মন্দিরের সদর দরজার ওপরের কারুকাজ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বিভিন্ন রঙে রাঙানো।
আমাকে পা চালিয়ে যেতে হবে রামমন্দিরে সন্ধ্যা হওয়ার আগে। তাই অন্য কোনো মন্দিরে প্রবেশ করলাম না। সামনেই একটি দোকানে এক যোগী বাবা দোলনায় বসে থাকা লাইফ সাইজের রাম ও সীতার প্রতিমাকে হাতে ধরে থাকা দড়ি টেনে দোল দিচ্ছেন। দোলনার পাশে লক্ষ্মণ দাঁড়িয়ে। একেবারে জীবন্ত মনে হচ্ছে। কোনো কোনো ছাউনিতে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ দাঁড়িয়ে আছেন। কোথাও আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে পাশে বসিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছেন। কোথাও শিব ঠাকুরের পাশে পার্বতী দেবী। যাকেই দেখি তাকেই আসল বলে ভ্রম হয়। ভক্তরাও এঁদের সঙ্গে বেশ সেলফি তুলছেন।
দেবতাদের সামনে স্বচ্ছ চৌকোণা কাচের বিশালাকৃতির দানবাক্স। যাঁর যা খুশি দান করে যাচ্ছেন। বাক্সগুলো বেশ দান পেয়েছে। পূজারি আর যোগী বাবাদের উপার্জন।
একটা থামের গায়ে হিন্দিতে লেখা আছে, জয় শ্রীরাম। বিনা মাস্ক প্রবেশ নেহি।
দোকানদারদের কাউকে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় দেখলাম না। ভক্তরা কেউ কেউ মাস্ক পরেছেন, কেউ পরেননি। যাঁরা পরেছেন, তাঁদের মাস্ক কারওটা থুতনিতে ঝুলছে, কারও নাকের নিচে, কারও এক কানে।
এখানে সব জায়গায় সবকিছু হিন্দিতে লেখা। স্কুল ও কলেজজীবন কাটিয়েছি ভারতে, তাই হিন্দি পড়তে অসুবিধা হয় না।
সামনেই হনুমান গঢ়ী মন্দির। সামনের অংশ আগাগোড়া কমলা আর হলুদ রং করা। এমনিতেই এই গলির সরু পথের দুই ধারের দেয়াল হলুদে ডোবানো, শীতকালেও বসন্তের আভা। বলা হয়ে থাকে, ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা জয় করার পর যখন এখানে আসেন, তখন রামভক্ত সহচর হনুমানের আবাসস্থল এখানে স্থাপন করা হয়েছিল। এখান থেকেই হনুমান শ্রীরাম ও রামের জন্মভূমি রক্ষা করতেন। এই মন্দির এখন বেশ উঁচু জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে। অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে আচানক মনে হবে কোনো রাজবাড়িতে এসে পড়েছি। রাজা রামচন্দ্রের সহচরের বাড়ি বলে কথা। মন্দিরের ভেতর হনুমানজির মূর্তি মাত্র ছয় ইঞ্চি উচ্চতার।
অবশ্য পথে নেমে আসল হনুমানের দেখা মেলাও স্বাভাবিক। দলে দলে মানুষের মতোই মনুষ্য জাতির সঙ্গে হেঁটে–চলে বেড়াচ্ছেন রামভক্ত সহচর।
হনুমান গঢ়ী থেকে খানিকটা এগিয়ে দেখি, পাখি দিয়ে ভাগ্যগণনা চলছে খোলা আকাশের নিচে। গণক একটা ছোট আকারের চৌকির ওপর বসে আছেন। তাঁর বাম পাশে একটা কমলা রঙের খাঁচা, খাঁচার ওপর বিভিন্ন দেব–দেবীর ছবি এবং তার ওপর লেখা, শ্যামা পক্ষী কা শগুন বিচার।
শ্যামা পক্ষীকে খাঁচায় খুঁজে পাওয়া গেল না। গেল কোথায়?
দেখি গণকের সামনে শুইয়ে রাখা সাদা থেকে ময়লা হয়ে যাওয়া সারি সারি কার্ডের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছেন তিনি। গণকের পাশে একটা টুলে কাস্টমার ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর জন্য আসন গ্রহণ করেছেন। এই গ্রহ, নক্ষত্র, পশু, পক্ষী জড়ো করা তারই জন্য। ভাগ্য ইতিমধ্যে পক্ষী তুলে ধরেছেন। গণকের হাতে একটা কার্ড, যাতে ভাগ্য লেখা আছে সারা জীবনের।
গণকের দক্ষিণ পাশে কলম, শলতে, ম্যাচ বাক্স, তার সামনে কমলা রঙের ছোট টিনের বাক্স একসময় স্কুলের শিশুরা যেমন নিয়ে যেত। অবশ্য সেগুলো হতো রুপালি রঙের। এটা প্রতীকীকরণের জন্য গেরুয়া। তার সামনে ফ্রেমে বাঁধানো দুর্গা মায়ের ছবি। কাস্টমারের ভাগ্য কত দূর এগোল জানার জন্য সামনে বসে পড়েছিলামই, আরেকটু হলে নিজের ভাগ্যই গণনা করতাম বা গণক হওয়ার দীক্ষা নিতাম। আমি বেকার মানুষ। পেশা–টেশা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এই পেশাও খারাপ বলে মনে হলো না।
কিন্তু তার আগে ভীষণ খিদে পেয়ে গেল। সকালে নাশতা করে বেরিয়েছি আর এখন বাজে বিকেল পাঁচটা, মাঝখানে ফ্যায়জাবাদ ঘোরার নেশায় কিছুই পেটে পড়েনি।
আশপাশে ঘুরেফিরে কোনো খাবারের দোকান পেলাম না। সবই পূজার উপকরণ, প্রসাদ, স্যুভেনিয়র আর দানবাক্সের দোকান। প্রসাদ হিসেবে সবাই লাড্ডু কিনছে। আমিও প্রসাদ নিলাম এবং নিজেকে বললাম, রামমন্দিরের ভেতর থেকে ঘুরে এসে তারপর তো প্রসাদ খাওয়াই যাবে। ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ। কিন্তু বেয়াড়া, নচ্ছার মন হলে যা হয়। একটা একটা করে বাক্স থেকে লাড্ডু নিয়ে চিবাতে লাগলাম আর বাইরের মাইকের সঙ্গে সঙ্গে তাল মেলালাম, শ্রীরাম, সীতারাম।
আশপাশে নয়নজুড়ানো কারুকাজ করা পুরোনো সব মন্দির। বেশির ভাগ ভক্তই এসেছেন গেরুয়া বসনে, মন-প্রাণ সব ভগবান শ্রীরামকে উৎসর্গ করে দেওয়ার জন্য।
এরই মধ্যে পড়ল এক বিশাল প্রাসাদ। রংবেরঙের কারুকাজখচিত। প্রাসাদের নাম শ্রীচক্রবর্তী দশরথ মহল। রামচন্দ্রের পিতা রাজা দশরথের প্রাসাদ। মহলের বিশাল গেট পার হলে মার্বেল পাথরের সাদা-কালো বরফিকাটা মেঝের আঙিনা। এরপর মহলের শোভা বাড়িয়ে চলেছে এক আকাশি নীল রঙের প্রাসাদ, যার দরজা-জানালা সব সোনালি রঙের, দেয়ালের গায়ে সূক্ষ্ম কারুকাজ। মনে হয় যেন স্বর্গের কোনো মহল। একটু সুবাসও আসছে চারিধার থেকে তাজা ফুল আর আগরবাতির। সব মিলিয়ে এক মোহনীয়, আচ্ছন্ন করা পরিবেশ। ভেতরে মন্দির। চারদিকে ঘুরেফিরে মনে হলো, এখানকার সব ভবন কম করে হলেও ৪০০–৫০০ বছরের পুরোনো। যদিও বলা হয়ে থাকে, দশরথ মহল নাকি আদিকাল থেকেই বিরাজমান, তবে ভবনের আকার ও কারুকাজ ৫০০ বছর আগেকার ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের দিকেই ইশারা দেয়। হয়তো বা আগে এখানে আসল প্রসাদ ছিল, যা কালে কালে বিলীন হয়েছে, পরে একই জায়গায় নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
রাজা দশরথ এ এলাকার রাজা ছিলেন। প্রধান স্ত্রী কৌশল্যা। দশরথের চার পুত্র রাম, লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন ও ভরত।