আরু নদীর তীরে সোনালি দিন

আরু ভ্যালিছবি: লেখক

শ্রীনগর শহরটা পার হলে হাইওয়ের দুই পাশে শুধু ধানখেত। যদিও খেত এখন খালি। আগস্ট মাসে সবুজ হয়ে থাকে দুই ধার। শীতকাল এসে পড়ল বলে। এখন আর চাষাবাদ হবে না, ফসল কাটা হয়ে গেছে। বরফের মৌসুমে চাষি ঘরে বসে থাকেন, পশুপালন করেন। খেতের মধ্যেই সারিবদ্ধভাবে দেবদারু বা সিলভারগাছ। আর বিশাল বিশাল চিনার গাছ পিচঢালা পথকে ছায়া দিচ্ছে।

প্যাহেলগামের চিনার গাছ
ছবি: লেখক

অনন্তনাগ পার হয়ে যেতে হয় প্যাহেলগাম। সাধারণত এখানেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বেশি। অনন্তনাগ এখানকার রেড জোন।

অনন্তনাগের আশপাশে খালি খেতে জাফরানের চাষ করা হয়। ছোট একটা বেগুনি ফুল শুধু মাথা উঁচু করে আছে আঙুলসমান গাছের সঙ্গে। এই ফুলের ভেতরে থাকে জাফরান। ফুল তুলে জাফরান বা স্যাফরন আলাদা করে শুকিয়ে বিক্রি করা হয়। তখন দাম তার যেকোনো মণিমুক্তার সমান।

জাফরান ফুল। ফুল তুলে জাফরান আলাদা করে শুকিয়ে বিক্রি করা হয়
ছবি: লেখক

জাফরানখেত পার করে প্যাহেলগামের কাছাকাছি পড়বে সারি সারি আপেলবাগান। সাধারণত আপেলের মৌসুম জুন থেকে অক্টোবর মাস। এই নভেম্বর মাসে এখনো বছরের শেষ কয়েকটা আপেল গাছে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বাগানে রাশি রাশি আপেল জড়ো করা। যে কেউ পেড়ে খেতে পারে। আবার কিনেও নিয়ে যেতে পারে। কর্মীরা ব্যস্ত আপেল বাছাইয়ে। এই আপেল রপ্তানি হবে বিদেশে। প্যাহেলগামে যারা সাধারণ পর্যটক, তারা আপেলবাগান দেখলে আনন্দিত হওয়ারই কথা। ভারতের অন্য কোথাও আপেলের এত বড় বড় বাগান নেই।

আমি সময় নষ্ট না করে বাইরে মনোযোগ দিলাম।

কর্মীরা ব্যস্ত আপেল বাছাইয়ে। এই আপেল রপ্তানি হবে বিদেশে
ছবি: লেখক

গাড়ি আস্তে আস্তে পাহাড়ের ওপরে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে চলছে। নিচে আরু নদী আর তার চারপাশজুড়ে পাইন, দেবদারু আর চিনারের বন। পাইনগাছ সারা বছর সবুজ থাকে, একই রকম। চিনার সবুজ থেকে হলুদ, হলুদ থেকে কমলা হয়ে ঝরে পড়ে। আমার কাছে চিনারের পাতাকে মনে হয় বেহেশতি ফুল। অদ্ভুত তার রূপ, একেক মৌসুমে একেক রং তার।

অরু নদী
ছবি: লেখক

থাকার জন্য আরু গ্রামে এমন একটা জায়গা খুঁজছিলাম, যেখানে আশপাশে অনেক দূর অবধি কোনো প্রতিবেশী নেই। হুসেইন আংকেলের এক বন্ধুর এমন একটা কটেজ আছে। কটেজটা সারা বছর খালিই পড়ে থাকে। মাঝেমধ্যে গ্রামের একটি ছেলে এসে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে দিয়ে যায়। জায়গাটা মূল শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে।

প্যাহেলগামের কটেজ। জায়গাটা মূল শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে
ছবি: লেখক

কটেজে গিয়ে দেখি, সামনে পাহাড়ের ছড়াছড়ি আর দূরের পাহাড় সাদা বরফের টুপি পরে চুপটি করে বসে আছে। এত শান্ত, এত নিরিবিলি আর কোনো জায়গা হয় না।

বরফগলা জল দিয়ে তৈরি হয়েছে আরু নদীর স্রোত
ছবি: লেখক

বরফগলা জল দিয়ে তৈরি হয়েছে আরু নদীর স্রোত। আর কয়েকটি দিন পরে নদী জমে বরফ হয়ে যাবে। যেমন করে কান্না জমে বরফ হয় কারও চোখে বা যেমন করে কাশ্মীরের মানুষের হাহাকার জমে আছে পাইন, ওক, চিনারগাছের ডালে ডালে।

এই অসীম নির্জন জায়গাটা কটেজের পেছন দিক থেকে বের হয়ে একটু হাঁটলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। নদীর ওপারে দু–তিনটি ঘর। একটা বাচ্চা ছাড়া বিকেল অবধি আর কাউকে দেখিনি এখনো। বাইরে চকচকে রোদ কিন্তু এখন বরফ পড়ার মৌসুম কাশ্মীরে। আজকালের মধ্যে বরফ পড়বে, বছরের প্রথম তুষারপাত হবে। মিহি মিহি বরফ এরপর ঢেকে দেবে পাহাড়, ঘরবাড়ি, পথঘাট। কারও নির্বাক বেদনা ঢাকার সবচেয়ে কাছের জায়গা হচ্ছে এই নদী। কখনো স্বচ্ছ স্ফটিক সবুজ, কখনো বরফে সাদা, তবু থেমে নেই।

আরু ভ্যালিতে ঘোড়ার পিঠে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

কটেজটার মালিক থাকেন দূরে। ভাড়া দিতে চান না কাউকে। সারা বছর খালি পড়ে থাকে কটেজ। লকডাউনের পর প্যাহেলগামে কোনো ভ্রমণকারী এখন অবধি আসেনি। তাই প্রকৃতি এখনো বিরক্ত নয়। খাবার বা দরকারি কিছুর প্রয়োজন পড়লে আধা মাইল হেঁটে তবেই মিলবে দোকান। আমি ঠিক এমন জায়গাই খুঁজছিলাম। প্রত্যন্ত গ্রাম, দূরদূরান্ত অবধি কোনো মানুষজন নেই। একটি বাড়ি আরেকটি থেকে বেশ দূরে। বিদ্যুৎ থাকে না দিনের বেশির ভাগ সময়। রাতে বিদ্যুৎ না থাকলে জঙ্গল তখন তারা ঝরিয়ে দেয় উদারভাবে।

প্যাহেলগামের অধিবাসী
ছবি: লেখক

পাতাঝরার দিন শুরু হয়েছে এখন। চিনারগাছের পাতা সবুজ থেকে হলুদ, হলুদ থেকে কমলা হয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে। এ রকম ঋতুতে গাছের নিচে শুয়ে সারা দিন পাতাঝরার কারসাজি দেখা যায়। পাতা দেবে শীতের আবরণ আর আমার প্রিয় চিনারগাছ দেবে মায়া।

বরফ গলা জলের আরু নদী
ছবি: লেখক

ঘরের পেছনে আরু নদী কলকলিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। পাথরে আছড়ে পড়ছে অভিমানে। কাউকে না কাউকে তো বলতে হয় মনের কথা। আরু যদি কাউকে না পেত তাহলে কি এভাবেই কথা জমে বরফ হতো!

এ বছর তার কাছে কেউ আসেনি দূর থেকে। দূরের কোনো এক পরদেশির জন্য অকারণ অপেক্ষা তার। আরু একা একা গান গায়, পাখিদের বকে, আমার সঙ্গে গল্প করে সবই নিশ্চুপ থেকে। মৌনতা ভেঙে গেলে এই আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে যাবে। এই যে বেদনায় জমে যাওয়ার আগমুহূর্তের উষ্ণতার রেশ, তা কেটে যাবে।

আরু ভ্যালি
ছবি: লেখক

কটেজটা আরু ভ্যালির একপাশে।
পাইন বনের গন্ধ আর আরুর গন্ধ মিললে মাঝেমধ্যে ধূপকাঠি বলে ভুল হয়।

কেউ বিরক্ত করার নেই। কোনো মানুষ নেই, কয়েকটা ভেড়া আর ঘোড়া ছাড়া সামনের রাস্তায় আর কিছুই নেই। সারা দিনে ফেরান পরা দু–একজন ভেড়া চরাচ্ছেন। মানুষ বলতে এই। বেলা চারটার মধ্যেই সব সুনসান আর তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে একা একা। যেমন করে একা পথিক ফেরে নিজের ঘরে।

আরু ভ্যালি
ছবি: লেখক

সন্ধ্যার পর প্রকৃতির যখন ইচ্ছে হলো তখন সামান্য বরফ ঝরিয়ে ঝুড়ি ভরে গল্প নিয়ে যাওয়ার কথা বলল। তবুও এত নীরবতা! জগতের সব মৌনতাকে বশ করে এখানে জড়ো করা হয়েছে।

পরদিন সকালে পিপাসার্ত সূর্য আবার আসে আরুর কাছে। বলে, আমি তোমাকে উষ্ণতা দেব, বেদনায় জমাট বাঁধতে দেব না, তোমার বয়ে যাওয়ায় ফুলের পাপড়ি ছিটাব। কিন্তু আজ অবধি আরু খোঁজে ক্ষণিক দেখা পথিকের।

সূর্য ঘুম থেকে উঠে প্রথমে বন্দনা করে নীল স্বচ্ছ নদীর। চোখ খুলে যাকে দেখে, তার সঙ্গেই ভালোবাসা হয় প্রগাঢ়। সূর্য এদিক থেকে উঁকি মারে, ওদিক থেকে ইশারা দেয় কিন্তু নদী একটুও দেখে না তাকে। সূর্য তখন এক ফন্দি আঁটে, ছটা ছড়ায় বিদ্যুতের মতো। পাহাড়ের সবুজকে বশ করতে চায় সমান্তরালে। সেই জাদুর ছোঁয়ায় নদীর পথের পাথর হয়ে যায় পরশপাথর। আর আমি ছুটে গিয়ে সেই অদ্ভুত দীপ্তি জড়িয়ে ধরতে গিয়ে জড়িয়ে ধরি নদীকে। ভিজে যাই শীতলতায়, বয়ে চলি বহমানতায়।

রাতে তুষারপাতের পর
ছবি: লেখক

নদী জীবন পালনের বাসনায় আরু হাতছানি দেয় পাহাড়কে শক্ত বেড়ার মতো ঘিরে রাখার নিপুণতায়।

আরু তখন সকাল পেরোনো আভা, আরু তখন বরফের লাভা। এত অনায়াসে ছুঁয়ে যাওয়ার সাধ্যি কার!

আরুর গলায় তখন রুপালি হার।
তবুও সকাল রং খেলে আরুর দুই ধারে। মানুষ যাকে বলে হেমন্তকাল; আমি তাকে বলি জলপ্রপাত। আরুর কথার ছলাৎ ছলাৎ।

প্যাহেলগাম
ছবি: লেখক

সকাল দেখে কাব্য করলে তো হবে না৷ নাশতা করতে হবে। গতকাল যখন এসেছিলাম, তখন মালিক নিজেই এসেছিলেন দেখা করতে। ১৮–১৯ বছর বয়সী একটি ছেলেকে বলে গিয়েছিলেন আমার জন্য রান্না করে দিতে। ছেলেটার নাম মুদাসসির, থাকে তিনটি বাড়ি পরে। দুপুরে খেয়েছিলাম শহরের রেস্তোরাঁয়। রাতের খাবার বাড়ি থেকে মুদাসসির এনে দিয়েছিল। এখন এই সাতসকালে মুদাসসিরকে কোথায় পাই। জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ডাকলে এসে পড়বে বলেছে। কটেজে রান্নাঘর আছে। কফি, ব্রেড ইত্যাদি সেখানে আছে। আমার মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। কাশ্মীরে বাইরের রাজ্যের প্রিপেইড মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না, পোস্টপেইড কাজ করে। ইচ্ছে করেই ভ্রমণের সময় পুরো পৃথিবী থেকে দূরে থাকি।

নাশতার জন্য আর কাউকে ডাকলাম না। নিজেই তৈরি করে নিলাম।

আরু ভ্যালি বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে হাঁটা, ট্র্যাক করা এবং হাঁটা। এখন করোনার কারণে বাইরের দেশ বা রাজ্য থেকে কোনো ট্যুরিস্ট আসে না। তাই পুরো ভ্যালি যেভাবে ইচ্ছে চড়ে বেড়ানো যায়। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে হেঁটে, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ট্র্যাক করা যায় অনায়াসে। মাঝেমধ্যে দু–একজন গ্রামবাসীর দেখা মেলে, যাঁরা ভেড়া বা ঘোড়া চরান। নারীরা সবজি খেতে কদাচিৎ হাত বাড়ান তাজা সবজি তুলতে।

আরু ভ্যালি বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে হাঁটা, ট্র্যাক করা এবং হাঁটা
ছবি: লেখক

চারপাশের পাহাড়ের সবুজ ধীরে ধীরে হলুদ হচ্ছে চোখের সামনে, এরপর গনগনে সূর্যের মতো কমলা। হেমন্ত ঋতু মানেই প্রকৃতির রং ছোপ ছোপ। আমার কাছে বসন্ত বলে মনে হয়।

কয়েক মাইল হেঁটে এসেছি কটেজ থেকে, সন্ধ্যা অবধি কোনো তাড়া নেই। সন্ধ্যার আগে ফিরলেই হবে। কারণ দুপুরের পর থেকে বাইরে কনকনে ঠান্ডা পড়বে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে বিকেলে তুষারপাত হবে। এখন অবশ্য তাপমাত্রা সহনীয়, মাত্র ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন