কলোসিয়ামের ভেতরে যেতে টিকিট নিতে হয়। সব জায়গাতেই বিশাল লাইন; টিকিট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলাম। প্রত্যাশা তেমন ছিল না; তবে পুরাকালের স্থাপত্যশৈলী টানে আমায়। অসাধারণ! গেটে নম্বর, সেপারেট সিঁড়ি, বসার সিট! ছোটবেলায় দেখা ঢাকা স্টেডিয়ামকে মনে করিয়ে দেয়, তবে এটি হাজার বছরের পুরোনো। ভেতরে কলোসিয়ামের মধ্যে নামারও সিঁড়ি আছে। অনেক খোপ আছে তার মধ্যে। পুরোটা ঘুরে দেখতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। আসলেই এত দিন আগের এই স্থাপত্য নকশায় কোনো কিছু ভাবতে বাদ রাখেনি। কয়েক ঘণ্টা মন ভরে ভেতরে ঘুরে বেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেছনেই আবারও সেই আগের দিনের বাগানে ঢুকে পড়লাম পেছন দিক দিয়ে।
সারা দিন ঘোরাঘুরি করে লাঞ্চ সেরে বিকেলে গেলাম প্যানথিয়নে; রাস্তায় বিয়ের অনুষ্ঠানে মিউজিক, নাচ-গানে সবার সঙ্গে শরিক হয়ে নবদম্পতির নবজীবনের শুভকামনা শেষে ঘোরাঘুরি, রাতের খাবার খেয়ে ফিরে এলাম।
এবার ফ্লোরেন্স!
বিকেলে ট্রেনে ফ্লোরেন্স যাব, সকালটা ফ্রি বলে ঠিক করলাম পিজাতে যাব। লোকাল ট্রেনের টিকিট করে ট্রেনে চড়ে বসলাম। এটা আমাদের আইটেনারিতে ছিল না। বাকি সব টিকিট, টাইমটেবল আগেই করা।
ইউরোপে মানুষ ধূমপান করে প্রকাশ্যে। আমি সেটা দেখে অভ্যস্ত নই। সবাই দেখি ধূমপান করছে। পিজা গ্যালিলিও গ্যালারির জন্মস্থান। পিজাতে ট্রেন থেকে নেমে আবারও বাস নিতে হয় পিজার পথে। বাস নামিয়ে দিল সুভ্যেনিরের দোকানের মধ্যে। সব দেখি বাঙালি দোকানি।
ভিনদেশে দেশি মানুষ দেখে মনটাই ভালো হয়ে যায়। তাদের মধ্য দিয়ে যেতেই সেই লিনিং টাওয়ার অফ পিজা! সপ্তম আশ্চর্যের একটি আমার চোখের সামনে। হাজার হাজার মানুষ।
পিজার টাওয়ার ছাড়াও এখানে আছে ক্যাথেড্রাল, ব্যাপটিস্ট্রি, পবিত্রস্থান—সব মিলিয়ে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
পিজার টাওয়ারের ওপরে যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। তবে যে বড় লাইন! আর পুরোটা এরিয়া ঘুরে দেখতে দেখতে, ছবি তুলতে তুলতে সময় যে কীভাবে চলে গেল! ফিরে গিয়ে ফ্লোরেন্সের ট্রেন ধরতে হবে। মিস করা যাবে না। আমরা মনভরে ঘোরাঘুরি শেষে আবার বাস আর ট্রেনে করে ফিরে এলাম হোটেলে। চেকআউট করেই ফ্লোরেন্সের ট্রেন ধরতে হবে। রোমে ফিরে আসা হবে। বাকি যা দেখা হয়নি, সব তখন দেখা হবে।
আমার ইউরোপের ট্রেন সিস্টেম খুবই এক্সাইটিং লেগেছে। হাজারো লোক ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। স্টেশনগুলো সুন্দর মলের মত; শপিং সেন্টারের মধ্যে। হাজারো লোক তাদের ট্রেন ধরতে অপেক্ষা করছে, আর তারা উঠে গেলেই স্টেশন খালি! আমরা এত লোক একসঙ্গে দেখি না। ট্রেনেই রেস্টুরেন্ট, পরিস্কার রেস্টরুম। উপরি পাওনা মনিটরে চোখ রাখা—গতির ওপর চোখ রাখা! কত দ্রুত নম্বর শূন্য থেকে ৩০০ মাইল পেরিয়ে যাচ্ছে!
ফ্লোরেন্সের পথে ট্রেন রাইডের আকর্ষণ ট্রেনলাইনের পাশে সূর্যমুখী খেত। আরও যা চোখে পড়ে, ছোট ছোট প্লাস্টিকের বস্তি, যা ঝোপঝাড়ের পেছনে লুকানো। জানিনা, সেগুলোতে অবৈধ অভিবাসী থাকে কি না! আমরা যখন গেলাম, তখন সিরিয়ান মাইগ্রেশন হচ্ছিল বেশ জোরেশোরে, আর্মড অফিসারদের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
ফ্লোরেন্স স্বপ্নের শহর!
ইউরোপে গেলে একটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে—শহরগুলো হাজার বছরের পুরোনো। বিল্ডিংগুলোও পুরোনো, সরু পাথর বিছানো রাস্তা। রাস্তার ওপরেই দোকান। পুরান ঢাকার মতো। তবে পরিষ্কার।
ফ্লোরেন্সে আমার প্রধান আকর্ষণ উফিজ্জি মিউজিয়াম। উফিজ্জির পথে পড়ে নদীর দেখা। আরনো নদী; রঙিন রঙিন সুন্দর সুন্দর বাড়ি নদীর ওপারে। চোখ আপনা-আপনিই চলে যায়। মন কেড়ে নেয়। নদীর ওপর বিখ্যাত সেতু ভিক্কো। গয়নার দোকানে চকমক করে। সেসব হাঁটতে হাঁটতে ছাড়িয়ে যাচ্ছি উফিজ্জি গ্যালারিতে। সেই লাইন। টিকিট নিয়েও ঘণ্টাখানেকের ওপরে লাইনে দাঁড়িয়ে শেষমেশ ভেতরে গেলাম। অপেক্ষা সার্থক। কয়েক তলার শত শত রুমে পেইন্টিং, হাঁটার পথের ভাস্কর্য দেখতে দেখতে কখন যে তিন-চার ঘণ্টা চলে যায় —বোঝাই যায় না। জীবন সার্থক!
ছেলেবেলায় জাদুঘর দেখার নেশা ছিল, এ মিউজিয়াম যেন তা আরও উস্কে দেয়। অসাধারণ। ইউরোপের জীবনযাত্রা আমার কাছে লেইডব্যাক লেগেছে। ট্রেন ছাড়া কোনো কিছুই ছুটে চলে বলে মনে হয়নি।
মিউজিয়াম থেকে বের হতেই চোখে পড়ে রাস্তার পাশের ভাস্কর্য। সুন্দর সুন্দর স্কয়ার। মাথা তুললেই আকাশপানে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন অসাধারণ স্থাপনা, বেল টাওয়ার, সান্তা মারিয়া ক্যাথেড্রাল, যা স্থানীয় মানুষ বলে ডুওমো (ডোম থেকেই হয়তো)। হাঁটতে হাঁটতে এতটুকু জায়গাতেই দিন চলে যায়।
দোকানপাটের লোকজন সব বাঙালি। চামড়ার সুভ্যেনিরের হাজারো দোকান! দিন কীভাবে চলে গেল সব ঘুরে ঘুরে দেখতে, বুঝতেই পারলাম না। ডিনার করে হোটেলে ঘুমানোর জন্য ফিরে এলাম।
এবার গন্তব্য ফ্রান্স
ফ্রান্স যেতে হবে সুইজ্যারল্যান্ডের মধ্য দিয়ে। আর এই ল্যান্ডস্কেপ অসাধারণ! ভাষায় প্রকাশ করা যায় না সে সৌন্দর্য! সবুজ জঙ্গল কখন যে পাহাড়ে গিয়ে শেষ হয়। সে পাহাড়ের চূড়া দেখতে অপেক্ষা করতে হয় সেই দ্রুতগতির ট্রেনেও। সেসব ছাড়িয়ে যায় পাশে বহমান নদী আর রংচঙে বিল্ডিং। ভীষণ গরমেও পাহাড়চূড়ায় বরফের দেখা পাওয়া যায়। ট্রেনেই পরিচয় হয় এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে, তারা সৌদি আরবে থাকে কয়েক দশক ধরে। কথায় কথায় নিজেদের ঠিকানা দিল; বলল, যদি কখনো যাই, যেন দেখা করি। কে জানে, হয়তো কোনো দিন দেখা হবে। ট্রেনলাইনের পাশে বর্ণিল বিল্ডিং, নদী, নদীর ওপর সূর্যালোকের খেলা, মাইলের পর মাইল ফলের বাগান, আঙুরের বাগিচা—সব পেরিয়ে ট্রেন থামল সুইজ্যারল্যান্ড। লাঞ্চব্রেক, আর সেই সঙ্গে ট্রেনও বদলাতে হবে।
লাঞ্চ হলো সুইজ্যারল্যান্ডের মেডিটেরেনিয়ান খাবারের দোকানে। হাঁটতে গেলাম আশপাশের স্ট্রিপমলের দোকানগুলো পার হয়ে নদীর পাড় পর্যন্ত। ফিরে এসে নতুন ট্রেন—প্যারিসের পথে। সন্ধ্যায় প্যারিসে পৌঁছাবো।
ব্রেকফাস্ট ইতালিতে, লাঞ্চ সুইজ্যারল্যান্ডে আর ডিনার ফ্রান্সে—আমার দিনলিপিতে যোগ হলো এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। লাইফ ইজ বিউটিফুল!
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হিসেবে কর্মরত, সাবেক রেসিডেন্ট, ইমোরি ইউনিভার্সিটি, আটলান্টা, জর্জিয়া এবং প্রাক্তন ছাত্র, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ