চাঁদপুরে লঞ্চ থেকে নেমেই সাইকেলে চেপে বসলেন এক তরুণী, তারপর?

চাঁদপুরে লঞ্চ থেকে নেমেই সাইকেলে চেপে বসলেন সঞ্চিতা বর্মন। ঘুরতে থাকলেন পথে পথে। শুধু ঘোরা নয়, স্বাদ নিলেন তাজা ইলিশের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী খাবারের। তিনি লিখেছেন আরও গল্প...

ডাকাতিয়ার পাড়ে
ছবি: লেখক

২০১৬ সালের কথা। ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করতে করতে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল একদিন। অনেক পুরোনো একটা মঠের ছবি। পরিচিত একজন ছবিটি আপলোড দিয়েছেন। লোকেশন দেখে জানলাম, স্থাপনার নাম লোহাগড় মঠ, অবস্থান চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার লোহাগড় গ্রামে।

প্রাচীন স্থাপত্যের প্রতি আকর্ষণ থাকায় ঠিক করে ফেললাম, আমিও কোনো এক দিন লঞ্চে সাইকেল উঠিয়ে চাঁদপুর চলে যাব। সামনাসামনি প্রাণভরে দেখব অসম্ভব সুন্দর এই স্থাপনা।

তবে নানা কারণে অনেক সময় চলে গেলেও চাঁদপুর আর যাওয়া হচ্ছিল না। যখন তিন পার্বত্য জেলায় সাইকেল নিয়ে যাব ঠিক করলাম, তখন কথায় কথায় একজন বুদ্ধি দিল, মহাসড়ক এড়াতে চাইলে আমরা চাঁদপুর হয়ে সাইকেল চালানো শুরু করতে পারি। পরামর্শটা মনে ধরল, এক ঢিলে দুই পাখি শিকার। নতুন একটা শহরও দেখা হবে, আবার অনেকটা রাস্তা ঝুটঝামেলাহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারব।

ডিঙি নৌকায় ইলিশ ফেরি করেন তাঁরা
ছবি: লেখক

মেঘনার ইলিশের স্বাদ নাকি পদ্মার ইলিশের থেকে ভিন্ন, সেই ভিন্ন স্বাদের ইলিশ আর ‘ওয়ান মিনিট’ আইসক্রিমের স্বাদ নিতে ১২ নভেম্বর সকালে সদরঘাট থেকে সাইকেলে চেপে বসলাম এমভি বোগদাদিয়া–৭ লঞ্চে। এই প্রথম এত বড় লঞ্চে চড়ে আমার কোথাও যাওয়া।

লঞ্চ চাঁদপুরের ঘাটে ভিড়তে দেখি কিছু লোক নৌকায় করে ঘুরে ঘুরে ইলিশ বিক্রি করছে। সদ্য থামা লঞ্চের যাত্রীরা দরদামও করেছেন। বাজারে মাছ বিক্রি করতে দেখেছি, কিন্তু এভাবে জলের ওপরে মাছ বিক্রি করতে দেখিনি।

লঞ্চ থেকে নেমে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম বড় স্টেশন। এ দিকটায় নাকি ইলিশভাজা খাওয়ার মোক্ষম জায়গা। অবশ্য আমরা যখন গিয়েছি, তখন ইলিশের মৌসুম শেষ। যে মাছই ধরা পড়ছে, বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। শুনে মনটা খারাপ হলো। ভেবেছিলাম ইলিশের দেশে কম দামে পেটপুরে ইলিশ খাব; তা না, একটি মাছ কিনতেই পকেটের সব টাকা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু মাছ না খেলে তো এই ভ্রমণের সার্থকতাই থাকবে না। তাই ২২০ টাকা দিয়ে একটি মাছ নিলাম। বেশ ভালো করে ভেজে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে পরিবেশন করা হলো। ইলিশভাজার তেল আর ইলিশের ডিম দিয়ে মাখানো ভাত আমার কাছে সব সময় অমৃত। মাছ খাওয়া শেষে চলে গেলাম ‘ওয়ান মিনিটে’। চাঁদপুর শুনলেই ইলিশের পর প্রথম যে জিনিস মাথায় আসে, তা হচ্ছে ওয়ান মিনিটের আইসক্রিম। এই আইসক্রিমের সুনাম শোনেনি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু আইসক্রিমই নয়, এখানে তৈরি নানা পদের মিষ্টিও সবার কাছে বেশ সুপরিচিত। মিষ্টি খুব একটা পছন্দ নয়, আমরা এক কাপ আইসক্রিম নিলাম। এত দিন খেয়ে আসা আইসক্রিমের সঙ্গে এর যে বেশ তফাত, তা বুঝতে বাকি রইল না।

নদী পাড়ে জেলে নৌকা
ছবি: লেখক

চাঁদপুর শহর থেকে বের হতে হতে বেশ বেলা হয়ে গেল। ঠিক করেছিলাম, চাঁদপুর থেকে মতিরহাট পর্যন্ত যেতে আশপাশে যে কটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা পড়ে, সবই দেখব। কিন্তু দেখা গেল আমাদের হাতে একদমই সময় নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম, শুধু লোহাগড় মঠ ঘুরে দেখব। গুগল ম্যাপ আর স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। চাঁদপুরজুড়েই অনেক মাছের ঘের। গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার পাশে বড় বড় পুকুর। পাকা ধানের মাঠ, মাছের ঘের, দুই পাশে সবুজ নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম।

চোখে মঠের চূড়া ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে এল নানা পাখির আওয়াজ। টিয়া, শালিক, ঘুঘু সব দল বেঁধে ডেকে চলেছে। মঠের কাছে গিয়ে দেখি, অন্য কোথাও নয়, মঠের কোটরে আর মঠে বেড়ে ওঠা পাকুড়গাছে বসে পাখিগুলো ডেকে যাচ্ছে প্রাণপণে। ছবিতে দেখা এই মঠ সামনাসামনি আরও বেশি সুন্দর। দেয়ালজুড়ে সুনিপুণ নকশা। কয়েক শতাব্দীর পুরোনো মঠটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সৌন্দর্য হারাচ্ছে দিন দিন। ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও স্থানটি সংরক্ষণের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবহেলায় থাকা এ মঠই এখন শত শত টিয়া, শালিক, ঘুঘু ও নাম না জানা অনেক পাখির আবাস। এগুলোর কলতানেই মুখর হয়ে থাকে এখানকার পরিবেশ। একসঙ্গে এত পাখির ডাক শুনে এত আনন্দ হচ্ছিল, মনে ভর করেছিল রাজ্যের শান্তি।

লোহাগড়া মঠে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

এই মঠের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদী। সেখানেও চলছে মাছ চাষ, কিছুক্ষণ পরপর বিশাল আকারের মাছ ঘাই দিয়ে উঠছিল। কয়েকটা পানকৌড়িও সাঁতার কাটছিল আপনমনে।

এমন প্রশান্ত পরিবেশ ছেড়ে উঠে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু গন্তব্য যে এখনো অনেক দূর। রাত হয়ে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই উঠতে হলো। গুগল ম্যাপের ওপর ভরসা করে রওনা হলাম লক্ষ্মীপুরের মতিরহাটের উদ্দেশে। এই রাস্তা আমাদের অচেনা, সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় দ্রুত পৌঁছাতে ম্যাপ অনুসারে বিকল্প পথ ধরলাম। এই বিকল্প পথে চলতে গিয়ে যে ভুল করেছি, বুঝতে বেশি সময় লাগল না। রাস্তার কাজ চলছে, ধুলায় একাকার অবস্থা, কোথাও কোথাও গর্ত। রাতের অন্ধকারে একটু দূরের কিছুই দেখার উপায় নেই। এর ওপর মানুষের কাছে রাস্তার কথা জিজ্ঞেস করতেই এমন এক রাস্তা দেখিয়ে দিল, যা আসলে রাস্তাই নয়, বাঁধ। এবড়োখেবড়ো বাঁধের ওপর দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছি খুব সাবধানে, সাইকেল থেকে পড়লেই একদম খাদে চলে যাব। সাইকেল চালাতে চালাতে দেখলাম জোনাকির মতো কিছু একটা জ্বলছে। একটু পরই বুঝতে পারলাম ওগুলো আসলে জোনাকি নয়, গরুর চোখ। অন্ধকারে এগুলোর চোখ জ্বলজ্বল করছে। একটি–দুটি নয়, যতক্ষণ বাঁধের ওপর ছিলাম, প্রায় পুরোটা সময় এমন শ খানেক গরু, ছাগল, এমনকি কুকুর-বিড়ালও দেখেছি। প্রথমে ভয় পেলেও কিছুক্ষণ পর আর ভয় লাগেনি।

মেঘনা নদীর পারেই মতিরহাট, প্রায় প্রতিবছরই এখানে নদীভাঙন হয়, বর্ষার সময় পানিতে আটকা পড়ে মানুষজন। এই নদীভাঙন আর জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে এই বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদীভাঙনের ফলে স্থানীয় লোকজন ঘরবাড়ি হারানোর ফলে তাঁদের বাসস্থানও তেমন পাকাপোক্ত নয়, যেন তাঁরা জেনেই গেছেন, বর্ষা এলেই ঘর সরাতে হবে। এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম, তখন ক্লান্তির শেষ নেই। কিন্তু কিছু অচেনা মানুষ যখন একেবারে অল্প সময়েই আপন করে নিলেন, তখন এই ক্লান্তিও যেন কোথায় পালাল।

শুধু এক রাত থেকেই যেখানে বিদায় নেওয়ার কথা, সেখানে আরও একটা দিন থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। আশপাশটাও তো ঘুরে দেখতে হবে, নাকি? এখানকার বেশির ভাগ মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। মাছের মৌসুম শেষ হওয়ায় এখন চলছে নৌকা, ট্রলার ও জাল মেরামতের কাজ। কেউ কেউ আবার যাচ্ছেন মাছ ধরতে। কিন্তু দিন শেষে যে পরিমাণ মাছ নিয়ে ফিরছেন, তা খুবই সামান্য। মাছের সময়টা মতিরহাটে মাছের আড়তে নিলাম চলে।

সকালে গেলাম মাছের আড়তে। দেখি একটা টেবিল ঘিরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে হাঁকানো হচ্ছে একটা ইলিশ মাছের দাম। ১ কেজি ১০০ গ্রাম ওজনের কাছাকাছি একটা ইলিশ মাছের দাম ৩০০ টাকা থেকে হাঁকানো শুরু করে ১ হাজার ৩০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়াল। এখানে আড়তদারদের সবার আলাদা আলাদা টেবিল আছে। যাঁর যখন মাছ আসে, সেই মাছ তাঁর টেবিলে রাখা হয়, এরপর শুরু হয় দর হাঁকা। সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয় এই দাম হাঁকানোর কাজ। পানির সঙ্গে বসবাস করা এই লোকজনের জীবন খুব একটা সহজ নয়। জলাবদ্ধতার সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে পানীয় জলের সমস্যা। নদীর পাশে হওয়ায় টিউবওয়েলের পানি ঘোলা। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বছরের পর বছর দিব্যি পার করে দিচ্ছে এখানকার মানুষ। নতুন কিছুর প্রতি তাদের বেশ কৌতূহল। এই যে দুজন মানুষ সাইকেলে চেপে এত দূর এসেছে, এই দেখতে তাদের ভিড়।

বিদায়ের দিন সকালবেলায় আমাদের জন্য পিঠা বানালেন একজন। নারকেল–পিঠা। আমাদের স্থানীয় পিঠার মতো হলেও নকশায় রয়েছে ভিন্নতা। আমরা যেমন ছাঁচে ফেলে ছোট ছোট করে নারকেল–পুলি বানিয়ে ফেলি, তাঁরা আগে চালের আটার রুটি বেলেন, তাতে নকশানুসারে আগে নারিকেল সাজান, তার ওপর আরেকটা রুটি রেখে সেই নকশা অনুসারে কেটে ফেলেন। তারপর সেটি তেলে ভাজা হয়।

বাড়ি থেকে এত দূরের এক গ্রামে এমন আপ্যায়ন পাওয়া যে কী সৌভাগ্যের! অবশ্য নিজেদের এই ভাগ্য পরীক্ষা করার লোভেই বোধ হয় আমাদের সাইকেলে ছুটে চলা। অজানার উদ্দেশে এই ভ্রমণ আমাকে কখনো খালি হাতে ফেরায়নি।