ফাতিমা জাহান একাকী ভ্রমণ করে থাকেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। ইতিহাস এবং প্রকৃতি দুই তাঁকে সমানভাবে আকর্ষণ করে।
ফেথিয়ে। তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগে জায়গা করে নেওয়া এক রূপকথার রাজ্য। ছোট শহর, খুব বেশি জনসংখ্যাও নেই। আমি এসে পৌঁছুলাম দুপুরে, আমার দেখা সবচেয়ে ছিমছাম আর সুন্দর শহরে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় কোনো গাড়িঘোড়া থাকে না বললেই চলে। আর এখানে সন্ধ্যা হয় সাড়ে আটটার দিকে। সে সময় দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়। তখন রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর মতো আনন্দ আর হয় না। এ শহরের কাছাকাছি কায়াকোয় শহরটি কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস ধারণ করে আছে।
ফেথিয়ে এসেছি মূলত কায়াকোয় শহর দেখতে। কিন্তু ছোট এ শহরে প্রবেশ করে চোখ যেন আর ফেরাতে পারছিলাম না। এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে সমুদ্র, ভূমধ্যসাগর। অপরূপ সে সামঞ্জস্য। পথে পথে বাগানবিলাসের চকচকে গোলাপি ঝাড় নুয়ে আলো ছড়াচ্ছে। সবুজে সবুজে পাগলামি করে যেন গাছগুলো। আর মানুষের কথা কী বলব! সবাই যে পথে হেঁটে–চলে বেড়ানো একেকজন দেবতা।
ফেথিয়েকে তুরস্কের সবচেয়ে সুন্দর সৈকত শহরও বলা হয়ে থাকে। ফেথিয়ে আনাতোলিয়া শহর থেকে চার ঘণ্টার পথ। শহরে পৌঁছে হোটেল খুঁজে পেতে একটুও অসুবিধে হয়নি। বাসস্টেশনের কাছেই ছিল, ট্যাক্সিচালক নামিয়ে দিলেন। হোটেলে ঢুকেই দেখি অসাধারণ সুন্দর একজন ভদ্রমহিলা রিসেপশনে বসে আছেন। তাঁকে আমার ডিটেইল দেবার আগেই তিনি প্রথম বাক্যটি বললেন, ‘ইউ আর ব্রেভ অ্যান্ড বিউটিফুল।’
এরপর খুশি না হয়ে পারা যায়!
আমি বললাম, ‘তোমার মতো এত সুন্দর মানুষ আমি আগে দেখিনি। ভাগ্যিস, এ হোটেলে বুকিং দিয়েছিলাম।’
ভদ্রমহিলা হোটেলের মালিক। নাম এসিন। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমন মিষ্টভাষী। স্লিম, ধবধবে ফরসা ত্বক, মুখে মাধুর্য আর সে মাধুর্যের ঔজ্জ্বল্য বাড়াচ্ছে মোহনীয় হাসি। কাঁধ সমান সাদা চুল যেন তাঁর মনের শুভ্রতার প্রতীক। বয়স হবে ষাট। একাই হোটেল চালান। সকালে হাউসকিপার এসে সাহায্য করে যান, মাঝেমধ্যে তাঁর ছেলে এসে সাহায্য করেন। বাকি সময় একা একা হোটেলে বসে থাকেন। খুব বেশি ইংরেজি জানেন না। এতে আমার কোনোই অসুবিধে হয় না। একেবারে ইংরেজি না জানা মানুষজনের সঙ্গেও ঘণ্টাখানেক সময় আলাপ করার অভ্যেস আছে আমার।
সারা দিন ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় আমি এসিনের সঙ্গে আড্ডা মারতাম। যদিও ফেথিয়ে শহরে ছিলাম মাত্র দুদিন। কিন্তু এ দুটো দিন আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
এসিন একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘আমি খুব আনন্দিত যে তুমি শুধু ভ্রমণে মগ্ন। তোমার উচ্চাভিলাষ শুধু নতুনকে জানার। তুমি মেঘের মতো ভেসে বেড়াও। এ জীবন সবাই যাপন করতে পারে না। এ জীবনই তোমার। তোমার ইচ্ছাশক্তি অপরিসীম বন্ধু।’ বন্ধু তো এভাবেই হয়ে যায়, যে কিছু না বললেও সবকিছু বুঝে যায়। আমার মনে হয় বয়স বাড়লে আমি এসিনের মতো হব দেখতে এবং অবশ্যই আচরণে। কোথাও কোথাও নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় অনায়াসে।
ফেথিয়ে এসে কী কী কাণ্ড করলাম, সেসব একটু বলি।
পৌঁছোবার পর দেখি হোটেলের লবিতে দুটো বাচ্চা খেলছে। একজনের বয়স ১৩, আরেকজনের ৫। এসিনের নাতনি আর নাতি। লবিজুড়ে খেলনা ছড়িয়ে–ছটিয়ে আছে, এরা খেলছিল আর টিভিতে কার্টুন দেখছিল। আমি ব্যাকপ্যাক নিয়ে ওপরের দিকে উঠতে যাচ্ছিলাম, মেয়েটি টেনে আমার আরেকটি ব্যাগ নিজে বহন করল। সাধারণত তুরস্কে দেখেছি, হোটেলের চাবি রিসেপশনে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তারপর রুম খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব নিজ নিজ ব্যক্তির। এখানে যে দেখছি বাড়ির মতো আবহাওয়া!
রুমে ঢুকে অভিভূত হয়ে গেলাম। দেয়ালজুড়ে রাস্তামুখী জানালা আর সেখান থেকে দূরের কায়াকোয় শহর নজর দখল করে আছে অনায়াসে। আর ফেথিয়ে শহরটাই–বা কি কম সুন্দর! সব ভবন তিনতলা সমান উচ্চতার ধবধবে সাদা দেয়ালের চুনকাম, লাল টালির ছাদ৷ ইউরোপ বলে ভ্রম হয়। তুরস্কে তো গ্রিক রোমান সংস্কৃতির ছোঁয়া প্রকট।
এখানকার বিখ্যাত সমুদ্রসৈকত ‘ওলুদেনিয’ দেখতে বেরিয়ে পড়লাম সফরের প্রথম স্থান হিসেবে, ফেথিয়ে থেকে ১২/১৩ কিলোমিটার দূরে।
এসিন বলল, মিনিবাস যায় আমার হোটেলের কাছের মসজিদের সামনে থেকে। একটায় চড়ে বসলাম। পাহাড়ি এলাকা, দুপাশে সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড় আর মাঝখানে রাস্তা। এমনটা প্রায় সব রাজ্যেই। পথিমধ্যে পুলিশ বাস থামাল চেকিংয়ের জন্য। বাসের ভেতরে কয়েকজন পুলিশ অফিসার ঢুকলেন, আমি ভাবলাম সবার পরিচয়পত্র দেখবেন, কারও কিছুই দেখলেন না বা জিজ্ঞেস করলেন না, ড্রাইভারকে কাগজপত্র দেখাতে হলো। একজন অফিসারের হাতের ট্রেতে দেখি চকলেট। সবাইকে দিচ্ছেন, আমিও নিলাম। এমন সুদর্শন পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে চকলেট না নিলে পাপ হবে।
আধঘণ্টার মধ্যে বাস থেকে নেমে পড়লাম ওলুদেনিয বিচ দেখতে। সমুদ্রসৈকত পুরোটাই ছোট–বড় নুড়ি পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত। সফেদ সমুদ্রসৈকত আর অসাধারণ টারকোয়েজ জল চোখে ভ্রম এনে দেয়। সাগরপাড়ে সবুজ পাহাড়ের ছড়াছড়ি যেন জলকে দূরে চলে যেতে না হয়। পাহাড়ের আগলে রাখবেই সাগরকে।
বিশাল তট আর তটে বিভিন্ন ধরনের মানুষ। পিতা এসেছেন কন্যাকে নিয়ে সাঁতার কাটতে, বন্ধুরা একসঙ্গে এসেছেন কিংবা কেউ এসেছেন পরিবারের সবাই মিলে। সাঁতার চলছে। কেউ কেউ প্যারাগ্লাইডিং করছেন। কেউবা ছোট ছোট বোট নিয়ে চলেছেন মাঝ সমুদ্রে। বোটগুলোর বাহারি পাল, যেন পাল তুলে চলে যাবে রূপকথার কোনো রাজ্যে।
রমজান মাস, তবু ভ্রমণার্থীদের কমতি নেই। স্থানীয় ছেলেমেয়েরা সাঁতারের পোশাক পরে জলে নেমে গেছে। নেমেছে যুগল, আনন্দময় তাদের জলকেলি। খাওয়াদাওয়া যে যার ইচ্ছেমতো করছে।
বিচের এক মাথা থেকে আরেক মাথা ঘুরে বেরিয়ে আমি ফিরে গেলাম ফেথিয়ে শহরে। শহরটা যেন আমাকে ডাকছিল। বাসে স্থানীয় মানুষজনের চেয়ে ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট বেশি।
বাস নামিয়ে দিল এ শহরের প্রধান মসজিদের সামনে। আসরের নামাজ হয়ে গেছে, মসজিদ প্রাঙ্গণে কেউ নেই। মাগরিবের নামাজ সেই সোয়া আটটায়। মসজিদের সামনের একটা বেঞ্চে বসে মানুষজন দেখতে লাগলাম। মসজিদ প্রাঙ্গণের ভেতর দিয়ে কত ধরনের মানুষের আনাগোনা।
খুব অবাক হলাম শর্টস পরা দুজন স্থানীয় মেয়েকে মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে দুজন ছেলে হেঁটে গেল, যাদের একজন ছিল শর্টস পরিহিত। পোশাকের ওপর তেমন আরোপ নেই এ দেশে।
আধঘণ্টার মতো বসে চললাম হেঁটে শহর ভ্রমণে। এমন সুন্দর শহর তুরস্কে আর দেখিনি। হাঁটতে থাকলাম মূল মার্কেট এলাকা ধরে। নানা ধরনের দোকান আর নজরকাড়া সব পণ্য। ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে, দোকানগুলো বন্ধ হচ্ছে ধীরে ধীরে, ছোট শহর তাই। বড় বড় শহরে অনেক রাত অবধি সব দোকান খোলা থাকে। জামাকাপড়, জুতা, গয়না, ব্যাগ—কী নেই এ মার্কেটে।
একটা দোকানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম পার্টি গাউনের। দোকানের মালিক মেয়েটি এসে লাইট জ্বালিয়ে দিল, জিজ্ঞেস করল, আরও লাইট জ্বালিয়ে দেব? আমি লজ্জা পেলাম। এরা দোকান বন্ধ করছিল, আমি এসে বিরক্ত করলাম আর এরা এতই মহানুভব যে আমার জন্য এত মায়া করছে। তুর্কিদের অতিথিপরায়ণতার জুড়ি নেই, সে তো আগেই টের পেয়েছি।
আরও খানিক এগিয়ে দেখি একটা মাঠের মতো জায়গায় অনেক মানুষের জটলা। আসলে সেটা ইফতার অনুষ্ঠান। এক পাশে বিশাল বিশাল পাত্রে খাবার রাখা আছে, আর কমিউনিটির মানুষ সব একে অন্যের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা পেতে রাখা টেবিল-চেয়ারে বসে। নেহাতই অভদ্রতা হবে ভেবে ঢুকে পড়িনি, না হলে এই অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া, মানুষজনের সান্নিধ্য, তাদের হাসি গল্প দেখার অভিজ্ঞতা নেওয়াও কম আনন্দের নয়।
এতক্ষণে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। ইফতারের জন্য নয়, এ শহরে সন্ধ্যা নামলেই পরিরা সব মানুষদের রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যায়। বাইরের হাওয়া ফিসফিস করে বলছে, এখনই তো সময় এ শহরকে পরখ করার।
আমি ঠিক করেছি, ইফতার করব ফিশ মার্কেটে। খুব কাছেই, পথে দু–একটা গাড়ি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না, মানুষজন তো নাই।