দ্বিতীয় ভ্রমণ, প্রথম হানিমুন

অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

লতিফ নাম না হলেও ‘লেট’ শব্দটির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আজন্মের। আমার জন্ম দেরিতে। কারণ, বাবার লেট ম্যারেজ। কলেজ পাস করতে লেট হয়েছে। কারণ, ফেল করেছি দুবার। প্রেম? এতটাই লেট যে তার আগেই আমার বিয়ে হয়ে গেল! এমন ‘লেটময়’ জীবনে হানিমুন লেটে হবে, সে আর এমন কী বিচিত্র।

কিন্তু হ্যাঁ। হানিমুনের আগেই আমি একবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম। সেটাও লেটে। আমার বন্ধুরা তত দিনে একাধিকবার কক্সবাজার ঘুরে এসে গল্প বলেছে রসিয়ে রসিয়ে। আর আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে বলেছি, দেখিস একদিন আমিও...। গিয়েছিলাম। কক্স সাহেবের তৈরি করা বা নামে পরিচিত কক্সবাজার গিয়েছিলাম। তখন আমার বিয়ে হয়নি অবশ্য। সেটা কাজের জন্য যাওয়া। সে কী উত্তেজনা! প্রেমিকার সঙ্গে প্রথমবার দেখা করতে যাওয়ার একটা উত্তেজনা আছে; প্রথম কক্সবাজার যাওয়ার উত্তেজনাটাও ছিল সে রকমই।

চট্টগ্রামে আড়াই দিন থাকার পর বলা হলো বান্দরবান নাকি কক্সবাজার। চোখ–কান বুজে কক্সবাজার বেছে নিলাম সমুদ্রের গর্জন শোনার জন্য। প্রথমবার সাগরে স্নান করে পবিত্র হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট দিনে আমরা দুই কলিগ রওনা দিলাম কক্স সাহেবের বাজারের দিকে। কোথায় থাকব, কী করব, কিছুই জানি না। শুধু জানি, কক্সবাজার যাচ্ছি সাগরসঙ্গমে।

কলাতলী বিচ
ছবি: প্রথম আলো

কলাতলীতে যখন নামলাম, তখন বিকেল প্রায়। এপ্রিল মাসের ঠা ঠা গরমে কক্সবাজার তখন প্রায় ফাঁকা। নেমেই একটি হোটেল জোগাড় করার বন্দোবস্ত করে ফেললাম বন্ধু ইমতিয়াজের সহায়তায়। সে তখন কক্সবাজার আর মহেশখালী মিলিয়ে মার্কেটিংয়ের কাজ করে। আমরা হোটেলে উঠে শাওয়ারের পানিতে ক্লান্তি ধুয়ে ফেললাম। তারপর সৈকতে। সন্ধ্যার ঠিক মুখে, আমরা যাকে গোধূলি বলি, তার চুরিয়ে যাওয়া আলোর লাল আভা তখন ছড়িয়ে পড়েছে সাগরের ঘোলা জলের ওপর। বালিয়াড়ি পেরিয়ে যখন সে আবিররঙা সাগর আমার চোখে ধরা দিল, মাথার নিউরনে কেমন রিনিঝিনি করে উঠল সাতটি তারের বীণা। কেমন একটা বিহ্বলতায় পেয়ে বসল সাগরের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে। মনে হলো, মিছে গর্ব করা মানুষ কত তুচ্ছ প্রকৃতির কাছে।

ধীরে সন্ধ্যা নামল। বাতাসের প্রবল তোড়ে সাগরের বুকে তখন অভ্রচূর্ণ ঢেউ, সফেদ। মনে হলো, সাগরের এই শব্দ, ঢেউয়ের এই কলতান কাউকে শোনানো দরকার। মোবাইল ফোন বের করে নম্বর খুঁজে ডায়াল করলাম। ওপার থেকে ভেসে এল, কী রে, কক্সবাজার গেছিস নাকি?

মহেশখালী জেটিঘাট, মহেশখালী
ছবি: লেখক

-বুঝলি কীভাবে?
-শব্দ শুনে। ঢেউয়ের শব্দ বোঝা যায়।

তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে নীরবতায়। চরাচর তখন ঢেউয়ের শব্দময়। চিনচিন করছে পেট। সংবিৎ ফিরল। সৈকত ছেড়ে রেস্তোরাঁর দিকে হাঁটা দিলাম।

মহেশখালীর খুরুশকুল গ্রামের একটি রাখাই বাড়ি
ছবি: লেখক

পরদিন ফিশারিঘাট থেকে মহেশখালী যাব আমরা। ঘাটে কেউ একজন বুদ্ধি দিলেন ট্রলারে না গিয়ে স্পিডবোটে যেতে। রক্ত নেচে উঠল। লোকজন উঠে পড়ল অল্প সময়েই। ভরা জোয়ারে ছোট্ট স্পিডবোট যাত্রা শুরু করতেই বুঝলাম, সব সময় অ্যাডভেঞ্চার করতে নেই। উত্তরের সমতল ভূমির মানুষ আমি। মহেশখালী চ্যানেলের জোয়ারে স্পিডবোটে চাপা মোটেই উচিত হয়নি। কিন্তু কিছু করার নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। স্পিডবোট তীর ছেড়ে বেশ খানিক দূরে চলে এসেছে। ফিশারিঘাট ক্রমে আবছা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, ভরা জোয়ারের এই সময়ে বিশাল সাগরে এক ঝরাপাতা ভেসে চলেছে কূলের সন্ধানে।

একবার মনে হলো, যা–ই ঘটুক না কেন, সাঁতরে কূলে উঠতে পারব। মনে একটু বল এল। বুকের ভেতর থেকে বোঝা নেমে যেতেই কূলে চলে এলাম। মাটিতে পা ঠেকতেই মনে হলো, যা হওয়ার হয়েছে। আর উঠব না স্পিডবোটে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার কী হবে? আবার বুক শুকিয়ে গেল। ঢোঁক গিলে বন্ধুকে বললাম, অন্য রাস্তা নেই ফিরে যাওয়ার? সে হেসে বলল, এক দিন সময় লাগবে। অগত্যা মহেশখালীর দিকেই পা বাড়ালাম সবাই।

খুরুশকুলে সমুদ্রগামী ট্রলার
ছবি: লেখক

বাঁশ দেখেছি; কিন্তু মহেশখালীর এত বড় মোটা বাঁশ এর আগে দেখা হয়নি। পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির, বড় রাখাইনপাড়ার প্যাগোডা, পাহাড়ের খাঁজে পানের বরজ, পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা সাগর, লবণের খেত! সাগরের বুকে থাকা এই একটুখানি দ্বীপের কত নামই না শুনেছি আগে। এবার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হলো। ফেরার পথে আবার সেই উত্তাল মহেশখালী চ্যানেল। মুখ শুকিয়ে চুন।

২.
চাকরি ছেড়েছি। নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য মাসখানেক সময় আছে। ভাবলাম হানিমুনটা সেরেই ফেলা যাক এবেলা। বউ–বাচ্চা নিয়ে হানিমুনে চললাম কক্সবাজার। ও হ্যাঁ, তত দিনে আমার বিয়ে হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছরের ব্যবধানে দুটি সন্তানও আছে। কিন্তু হানিমুনের স্মৃতি নেই। বড় সন্তান গেছে সুন্দরবন। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে। সেই সুযোগে চার মাস বয়সী ছেলেকে বগলদাবা করে কক্সবাজার বেরিয়ে পরলাম।

বালিয়াড়ি দিয়ে চলেছে গাড়ি
ছবি: লেখক

চট্টগ্রামের বন্ধুকে বললাম, আসছি। ছুটি নাও। সে বলল, চলে আয়। ছুটি নিয়েই রেখেছি। কত দিন কক্সবাজার যাওয়া হয় না!

তিথিতে মিলে গেল সব। আমরা চট্টগ্রামে এক দিন জিরিয়ে রাঙামাটি ঘুরে চলে গেলাম কক্সবাজার। বন্ধুকে বললাম, হানিমুনে আছি। ডিস্টার্ব নট। সে বলল, ম্যাও ধরারও লোক লাগে তো। আমি আছি। টেনশন নট।

অবশেষে কক্সবাজারে দ্বিতীয় ভ্রমণ। প্রথম হানিমুন।

বাস থেকে নেমে সেই হোটেল খুঁজে নেওয়া। লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ার আগে ভাবলাম, এত ঝক্কিতে কেন গেলাম। কোনো একটা ট্রাভেল এজেন্সিকে বললেই তো সব করে দিত। আমি শুধু দিনরাত হানিমুন করতাম। এখন জীবন কত সহজ হানিমুন আর ভ্রমণের জন্য।

লাবনী পয়েন্ট
ছবি: লেখক

দুপুরের পর বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে সৈকতের বালু ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের পায়ের নিচে। সামনে অসীম সাগর। সূর্য তখন অস্তাচলে। শত শত মানুষের সামনে এই প্রথম বউয়ের কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়ালাম। সাগরের নোনা বাতাসে গভীর নিশ্বাস টেনে ছেড়ে দিলাম অসীম অন্তরিক্ষে। মনে মনে বললাম, স্বাতি নক্ষত্রের জল পড়ুক আমাদের মাথায়। সাক্ষী থাক সাগর। সাক্ষী থাক অভ্রচূর্ণ ঢেউ। কে যেন ধাক্কা মারল পাশ থেকে। হানিমুন করতে এসে মানুষের ধাক্কা খাওয়াটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। ঘনায়মান অন্ধকারে বন্ধুকে খুঁজতে থাকলাম। সে বুঝতে পেরে কাছে এল। আমরা হাঁটতে থাকলাম সৈকতের নোনা বাতাস গায়ে মেখে।

সৈকতে গিজগিজ করছে মানুষ। ভাগ্যিস, তখন করোনা আসেনি পৃথিবীতে। কখন যেন একটা সাউন্ডপ্রুফ ভ্যানে ঢুকে পড়লাম লাইন ধরে। উদ্দেশ্য থ্রিডি মুভি দেখা। আহা উত্তেজনা! ভৌতিক সে মুভি দেখার একপর্যায়ে আমার ডান দিকে কেউ একজন কাঁধ খামচে ধরল। বাঁয়ে বসা আমার স্ত্রী। মনে মনে বললাম, ডিস্টার্ব নট। হানিমুনে আছি।

মুভি দেখে বেরিয়ে সৈকতের দোকানগুলোয় অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি হলো। টুকটাক এটা-সেটা কিনে বেশ রাত করে সৈকত থেকে ফিরলাম। পথেই সিদ্ধান্ত হলো, রাতে শুধু ফিশ ফ্রাই খাওয়া হবে। সি ফিশ। সৈকতের কাছেই একটি দোকান বেছে দাঁড়িয়ে গেলাম। বন্ধু সোহেল মাছ বেছে দোকানির হাতে দিল। দোকানি ভেজে দিলেন কড়কড়ে করে। ভরপুর খাওয়া। মাছ খেয়েই যে একটা রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়, সেটা বইয়ে পড়েছি, চলচ্চিত্রে দেখেছি। নিজে কাটাইনি আগে। এবার সেটা করা হলো। মাছ ভাজা খেয়ে ধীরেসুস্থে ফিরে এলাম হোটেলে। বসলাম, পরদিন কী করা হবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে, সেই জটিল হিসাব নিয়ে।

ইনানি বিচ
ছবি: লেখক

ঘুম ভেঙেছে খুব ভোরে। ভোর মানে ভোর। তখনো সূর্য ওঠেনি। সবাই বেরিয়ে পড়লাম সৈকতের দিকে। স্বাস্থ্যসচেতন কিছু বিদেশিকে দেখলাম সৈকত ধরে দৌড়াচ্ছে। বুঝলাম, তারাই রোহিঙ্গা প্রকল্পের কনসালট্যান্ট। বেশ খানিক হাঁটা হলো সৈকতে। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকল। আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম হিমছড়ির দিকে।

বাঁয়ে পাহাড়, ডানে সাগর, মাঝখানে ফিতের মতো কালো রাস্তায় জিপ ছুটছে ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে। এদিকে আমি আসিনি এর আগে। যতই সামনে এগিয়ে চলেছি, ততই অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। ঝাউ আর নারকেলগাছটাই শুধু চিনতে পারছি। আর কিছু না। সব অপরিচিত। অনেক রিসোর্ট হয়েছে এদিকে। খোঁজ নিতে হবে—মনে মনে ভাবলাম। আমরা থামলাম হিমছড়ি সৈকতে। সৈকত তখন নির্জন। লোকজন আসি আসি করছে। সূর্য বেশ খানিকটা ওপরে উঠে গেছে। এখানকার পানি কিছুটা স্বচ্ছ দেখলাম। এগিয়ে গেলাম পানির কাছে। আমার স্ত্রী ঝিনুক কুড়াতে গেলেন। সকালের নির্মল বাতাসে আমার চার মাস বয়সের ছেলে হেসে উঠল খানিক। বুকভরে তাজা নিশ্বাস নিল গভীরভাবে। আমরা বাপ–ছেলেতে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। দম নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে সোজা তাকালাম। সেখানে পানি ছাড়া আর কিছু নেই।

ফিরতি পথে হিমছড়ি পাহাড়ে ওঠা হলো সেই সকালবেলা। কত ক্যালরি যে ক্ষয় হলো! পাহাড়ের এ–মাথা থেকে সে–মাথা হাঁটলাম আমরা সবাই। শেষে ক্লান্ত হয়ে নেমে এলাম। গেলাম ঝরনার কাছে। ক্ষীণকায়া ঝরনা দেখে আমার বেশ মায়াই লাগল। ফিরে চললাম হোটেলে।

সকালে বড্ড ঘোরাঘুরি হয়ে গেছে। নাশতাটা হতে হবে ঠিকঠাক। মোটামুটি মানের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে অর্ডার করা হলো একরাশ খাবার। হিমছড়ি পাহাড়ে উঠে শরীরের অনেক ক্যালরি খরচ হয়েছে। সেটা পুষিয়ে নিয়ে গেলাম অ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে কক্সবাজার শহরের ঝাউতলায়।

রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড, সাগর তলের আশ্চর্য জগৎ
ছবি: লেখক

যে দুটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে কক্সবাজার ভ্রমণ, তার একটি হলো ঝাউতলার এ মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম। কে জানত, বাগদা, গলদা, হরিণা আর লবস্টারের বাইরেও সমুদ্রের নিচে এত জাতের চিংড়ি আর কাঁকড়া ঘুরে বেড়ায়! এত প্রজাতির জীবন্ত মাছ আমি আগে দেখিনি। আমার স্ত্রী অভিভূত। সন্তানের কথা বলতে পারছি না। সে কোলে অযথাই লাফঝাঁপ করছে অবশ্য। ভ্রমণকারীদের কক্সবাজার ভ্রমণের পূর্ণতা দিয়েছে মাছের এ অ্যাকুয়ারিয়াম।

কক্সবাজার শহর ঘুরেফিরে এলাম আবার হোটেলে, তখন প্রায় দুপুর। ভরদুপুরের তপ্ত গরমে আর কোথাও বের হতে মন চাইল না। একটু পরেই চট্টগ্রামের বাস। সেন্ট মার্টিন যাওয়ার প্যাকেজগুলোর খোঁজ নিলাম খানিক আগবাড়িয়েই। রুমে ঢুকে লাগেজ গোছাতে শুরু করলাম। ফিরতি পথের চট্টগ্রামের বাস অপেক্ষা করছে তখন।

কক্সবাজার একটা আবেশ তৈরি করে মনের ভেতর। সাগরের সামনে দাঁড়ানো, ঘোলা জলের ওপর অভ্রচূর্ণ ঢেউ, আদিগন্ত জলরাশি—এসবই দু-এক দিনের ভ্রমণে তৈরি হওয়া স্মৃতির চেয়ে চেয়ে অনেক বেশি কিছু দেয় জীবনে।