হামিংবার্ড, নাকি কাকের ডাক, অথবা ঠান্ডায়—ঠিক কিসে ঘুম ভাঙল বোঝা গেল না। তাঁবু থেকে বের হয়ে মাথা উঁচু করতেই চোখে পড়ে কুয়াশা। সবুজ ঘাসের ডগায় মুক্তার মতো লেগে আছে শিশির। খালি পায়ে শিশির মায়া ছড়াতেই গায়ের ভেতর দিয়ে হুড়মুড় করে বয়ে গেল একটা হিমশীতল নদী। ভোরের আলো ফুটিয়ে তুলছে প্রকৃতির অমলিন সৌন্দর্য। পাহাড়চূড়া থেকে ৭০০ ফুট নিচের ভূমি এক বিস্তীর্ণ সবুজ ঢেউ। তার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে সাদা রঙের বাড়ি। বাড়ির সামনে শান্ত জলের হ্রদ। চোখের সামনে খোলা আকাশ, অবারিত সবুজ আর প্রসন্ন হ্রদ আমাদের সম্মোহিত করে। কাকের ডাকে ভাঙে সেই ঘোর।
তাঁবুর সামনের গাড়ির ভেতরে বন্ধু সাদি চোখে রোদচশমা পরে ঘুমিয়ে আছে। এর মধ্যে আমাদের দলের অনেকে জেগে উঠতে শুরু করেছে। ঠান্ডায় রাতেই ঘুম ভেঙেছে সাদি খানের। আরও কয়েকজনের একই দশা। আমাদের এবারের ক্যাম্পিংয়ের উদ্যোক্তা সুপন চৌধুরী। এখানে রাতে কেমন শীত পড়বে, সে ধারণা তিনি যথাসময়ে দিয়েছিলেন।
তারপরও কেউ কেউ শীতের কাপড় আনেনি। কারণ, এখানে আসার আগে নিউইয়র্ক শহরে তাপমাত্রা ছিল ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। মাত্র ৩০০ মাইল দূরে এই নিউপোর্ট এলাকায় এত ব্যবধান হবে, তা অনেকেই বুঝতে পারেনি। তাই এ বিড়ম্বনা। আমাদের চারটি তাঁবু। সে জন্য পাহাড়ের একটি বিরাট অংশ আমাদের দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫০ ডলারে। পাহাড়ের নিচে অফিস। ওখানে গেলে এক ডলারে গোসলের ব্যবস্থা। সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে মানসম্মত টয়লেট।
তাঁবুর ওপর ছোট ছোট গাছে খেলা করছে ভোমরার চেয়ে একটু বড় আকৃতির হামিংবার্ড। শীতের সকালের সূর্যের আলোয় তাদের মধ্যেও দেখা গেল চঞ্চলতা। রাতের দুটি মশাল এখানো জ্বলছে। গোল হয়ে বসে আমরা রাতের বারবিকিউ চুলার জেগে থাকা কয়লার অল্প আঁচে শরীর উষ্ণ করি। নতুন করে আগুন জ্বেলে রাতে বেঁচে যাওয়া ল্যাম্ব চপ আর চিকেন গ্রিল করা হচ্ছে। আদনান বের করল স্থানীয় আমিশ জাতিগোষ্ঠীর তৈরি কেক। আমিশ এমন এক জাতি, যারা সভ্য সমাজে বাস করছে কোনো ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই। থাকা–খাওয়া বলুন, কি রোগবালাই, সবকিছুর জন্য ওরা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। দূরে কোথাও যেতে কিংবা ভারী জিনিস বহন করতে হলে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে।
আমিশদের সবাই চিনুক বা না চিনুক, আদনাদের ডেজার্টের ওপর সবাই আস্থাবান। রাতে সে আমাদের মার্শমেলো নামের একটি মিষ্টান্ন খাইয়েছে। মার্শমেলো আগুনে গ্রিল করে একধরনের বিস্কুটের ভেতর পুরে চকলেট দিয়ে স্যান্ডউইচের মতো করে খেয়েছি সবাই। আমাদের জিহ্বায় তখন অমৃতের স্বাদ। এখানে জীবনে প্রথমবার ডেজার্ট খেলাম। সকালের নাশতা শেষে অনীক সওদাগর আগের রাতের মতোই ধূমায়িত কফি আর চায়ের ব্যবস্থা করে ফেলল। নাশতা করতে করতে তাঁবু গোটানো শুরু করেছেন সুপন ভাই। তাঁর তাঁবুতে অনায়াসে চারজন থাকতে পারে। ভালো মানের সেই তাঁবু তিনি ওয়ালমার্ট থেকে কিনেছেন ২০০ ডলারে। সামিউল শানের তাঁবুটি সবচেয়ে বড়। সহজে টাঙানো ও গোটানো যায়। ছয়জনে থাকার মতো এই তাঁবুর দাম প্রায় ৩০০ ডলার। সাদি কিনেছে তিনজন থাকার মতো একটা তাঁবু, ৮৭ ডলারে।
এবার আমাদের ফিরতে হবে। জহির খান পিয়ার ভাই তুলে নিচ্ছেন সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে থাকা নানান প্যাকেট, যাকে আদর করে নাগরিক জঞ্জাল ডাকা চলে। আমরা সবাই হাত লাগাই, এই সবুজ পাহাড়চূড়া আমরা নাগরিক জঞ্জালে মলিন করতে চাই না। নতুন দিনের জন্য মানুষ তাঁবু নিয়ে আসতে শুরু করেছে। আমাদের চেয়ে খানিক দূরে আছে ওরা। কেউ কেউ হাতুড়ি–শাবল দিয়ে বড় পাথর ভেঙে হীরে, অ্যামাজনিট, রুবি, প্লরিট ও ক্রিস্টাল পয়েন্টের মতো মূল্যবান পাথর খুঁজছে। আমাদের মধ্যে পিয়ার ভাই ছোট একটি হীরের টুকরো পেয়েছেন। ক্রিস্টাল হীরা। হীরা পেয়ে জানিয়েছেন, স্ত্রীকে সঙ্গে করে আনতে পারেননি। তবে স্ত্রীর জন্য সঙ্গে করে কিছু একটা নিয়ে যেতে পারছেন। এতে তিনি মহানন্দিত। অ্যাচ অব ডায়মন্ড মাইন নামের এই পাহাড়চূড়ায় তাঁবুতে বাস করার পাশাপাশি দামি পাথর খুঁজে নেওয়ারও সুযোগ আছে!
সূর্যের আলো তীব্র হতে শুরু করেছে। আমরা চলে যাচ্ছি পাহাড় ছেড়ে। একটি দিন আর রাত যেন প্রকৃতির সন্তান হয়ে তার কোলে কাটিয়েছি। রাতে প্রাণভরে দেখেছি আকাশভরা তারা, নিউইয়র্ক শহরে যা খালি চোখে দেখা যায় না। নিউইয়র্ক শহর থেকে ৩০০ মাইল দূরে ৭০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে বসে আমরা গলা ছেড়ে গেয়েছি লালন ফকির, আবদুল করিম আর জেমসের গান। এ তল্লাট যেন আমাদেরই। আমার সঙ্গে গেয়েছে সাইফুর সানি, স্বপন আহমেদ, মাহি মান্না আর সাদি।
শীতের রাতের মতো নির্জন হিমেল রাত। সুগন্ধি চেরি কাঠের আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে আমরা গল্পে মেতেছি। আমাদের সঙ্গে আছে সুপন ভাইয়ের ছেলে সারিম, নবীন কিশোর। একদিন সে আমাদের এই তাঁবুতে থাকার গল্প শোনাবে তার অনুজদের কাছে। শোনাবে দিনের বেলা খরগোশ শিকার অথবা আদিম মানুষের মতো মাংস পুড়িয়ে খাবার কথা। আজ যদিও অনেক কিশোরকে দড়ি বেঁধেও এখানে আনা যাবে না। ওদের দিন কাটে যন্ত্রে যন্ত্রে, নতুন পৃথিবীর নতুন মন্ত্রে।
লেখক: নাট্যকার ও সাংবাদিক।