বাগানের বাগানে

‘তোমার বাস কোথা যে পথিক, ওগো, দেশে কি বিদেশে’—কোথাও হয়তো বাস থাকে। কিন্তু চির উচাটন মন বারে বারে পথে নামায়, পায়ের নিচে শর্ষে গুঁজে দেয়। তারপর ঘুরে ফেরে আত্মার শান্তি বিধানে। এভাবে ভরে ওঠে জীবনপাত্র।

শোয়েযিগন প্যাগোডাছবি: লেখক

ভোর তিনটায় উঠে তৈরি হয়ে বেরোতে বেরোতে পৌনে চারটা বাজল। এখনো রাতের আকাশ মেখে রয়েছে প্রকৃতি নিজ গায়ে। এখনো ভোরের গন্ধে মনের গহীন দুয়ার খুলতে বলেনি। এখনো আকাশের কপালের টিপ হয়ে রয়ে গেছে চাঁদ।

স্কুটি হাঁকিয়ে চললাম থাটবাইন্যু মন্দিরের দিকে। দিনে যেমন গরম থাকে বাগানে, রাতে ঠিক তার উল্টা। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা একটা আবহাওয়া। জ্যাকেট পরে না এলে ঠান্ডা লাগত। পথে টিলোমিনলো মন্দিরকে মনে হলো একটুকরো সোনার মোহর, পথের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে, পথ চেনাচ্ছে।

থাটবাইন্যু টেম্পল ও পাশে প্যাগোডা
ছবি: লেখক

আমার আগেই থাটবাইন্যুর সিঁড়ির ধাপের সামনে জুতার লাইন দেখে বুঝলাম, এখানে যারা আসে, তারা আসলে রাতে ঘুমায় না। সূর্যের আগমনের অপেক্ষায় থাকে।
এক দিকে চাঁদ চেয়ে আছে একদল ভ্রমণার্থীর দিকে, আর ছেলেমেয়ের দল অন্য দিকে ফিরে অপেক্ষা করছে সূর্যের। চাঁদের এমন অবহেলা আগে কখনো দেখিনি। চাঁদও কেমন যেন মিইয়ে, ঝিমিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

আর দিনভর প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করতে তখন সূর্য আসেন পুবের হাওয়ায় দোল খেতে খেতে। আকাশ তার দোলনা, যেমন ইচ্ছা তেমন দোল খেয়ে যান। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে রং ছড়ান। পুব থেকে পশ্চিমে অন্ধকারের মধ্যে দিনের আলো ফুলের মতো ফুটিয়ে তোলেন।

সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে ছলকে ছলকে গোলাপি, কমলা রংও আকাশের গা বেয়ে বাঁয়ে ঝরে যাচ্ছে।

গাছের সারির ফোকর গলে উঁকি দিলেন তিনি। একটা ঝলমলে কাঁসার থালা যেন নিজ হাতে ফুল সাজাচ্ছে আকাশদেবতার পায়ে।

বাঁয়ে টেট ও ডানে পিসো
ছবি: লেখক

সকালের সুগন্ধি গায়ে মাখতে মাখতে বেশ বেলা হলো। একে একে সঙ্গী–সাথিরা উধাও হচ্ছে। আমি কী মায়ায় যে এই মন্দিরের ছাদে চড়ে বসে আছি, কে জানে। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, একা হয়ে গেলে প্রকৃতি আমাকে তার নিজের সিন্দুকে লুকিয়ে রাখা গল্প শোনাবে। মন্দির নিঝুম হয়ে গেলে আমি ধীরে ধীরে নিচে নামি।

মাঠে পিসোর সাথে দেখা। ডাকলাম নাম ধরে, শুনলই না। রাগী চেহারা করে চলে গেল। আহা রে কৈশোর, নানা রঙের কৈশোর!

এবার হোটেল গিয়ে স্নান–নাশতা সেরে পরবর্তী অভিযানে বেরোতে হবে।
দেরি যখন হয়েছেই, তখন ব্রাঞ্চ মানে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসঙ্গে করব বলে ঠিক করলাম। আমার হোটেলের পাশে একটা রেস্তোরাঁয় বসলাম। খাবার আগেই ঠিক করে রেখেছি, সেই পরিচিত মাছ-ভাত।

আনন্দ টেম্পল
ছবি: লেখক

আজ বেলা করে বেরিয়েছি। দুপুরের কড়া রোদে এখন পথে একটা মানুষও নেই। আমি আজ আরও কয়েকটি মন্দির দেখব। একদম কাছাকাছি আছে আনান্দা মন্দির।
পালি ভাষায় আনান্দা শব্দের অর্থ অপরিসীম জ্ঞান। আর আমার বাংলাভাষায় আনন্দ মানে তো আনন্দই। এই উপাসনালয় পাগান রাজবংশের রাজত্বকালে ১১০৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছিল। ধবধবে সাদা এই মন্দিরের চূড়া গোলাকার, সোনালি রং করা। নিচের গঠন চৌকোনা এবং কয়েক তলা ধাপে কয়েকটি ছাদ পেরিয়ে মন্দিরের একদম ওপরের তলায় পৌঁছানো যায়। বাইরে থেকে দেখতে আমাদের দেশের আটচালা টিনের ঘরের মতো দেখতে। তবে মন্দিরটি পাথর, ইট ও বালি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

স্থাপত্যশৈলী কিছুটা ধার করা হয়েছে মন আদিবাসী গোষ্ঠী থেকে আর কিছুটা ভারতীয়।
ফাগুনের (যদিও এখন অবধি পুষ্পহীন তরুলতা আর লু হাওয়া ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি) নীল আকাশ আর তার নিচে সফেদরঙা দেবতার ঘর, মাথায় সোনার চূড়ার মুকুট পরে এক অপার্থিব ঢেউ তুলে যাচ্ছে। মন্দিরের ভেতর চার দিকে চার বুদ্ধ, আগাগোড়া সোনায় নেয়ে একাকার হয়ে জ্বলজ্বল করছে। আর এই চার বেশে দাঁড়িয়ে থাকা বুদ্ধের কাছে যেতে হলে লম্বা প্যাসেজ পেরোতে হয়। প্যাসেজটির দেয়ালে পোড়ামাটির কারুকাজে কুলুঙ্গি। সেখানে কোনোটায় রাখা প্রদীপ, কোনোটায় ছোট ছোট বুদ্ধ।

ফুল আর আগরবাতির সুবাসে ফাগুনবেলায় বাইরের শুষ্ক মৌসুমকেও এখন রঙিন মনে হচ্ছে। বাইরের দেয়ালের জানালা আর দরজার চূড়ায় রাজকীয় কারুকাজের সমারোহ। মন্দিরের পেছনে ঘুর ঘুর করতে গিয়ে দেখি, এক ভিক্ষু আপনমনে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছেন। ভিক্ষুরা সাধারণত নিজেদের কাজ নিজেরাই করেন, মন্দিরের সেবামূলক অন্যান্য কাজের সঙ্গে।

সুলামানি টেম্পল
ছবি: লেখক

এরপর স্কুটি চালিয়ে ভোঁ–দৌড় দিলাম সুলামানি টেম্পলের দিকে। একে তো পথ অজানা, তার ওপর পথটা দেখতে হয়েছে এখন ভূতের শহরের মতো। যেন সবই আছে, তবে অদৃশ্য। ম্যাপের আন্দাজে শহরের অপর প্রান্তে যেখানে গিয়ে পৌঁছলাম, সেটা সুলামানি না হয়ে আর যাবে কোথায়! কারণ, এখানে আমি আগে আসিনি।

বাগানের সর্বাধিক আলোচিত ও দর্শনীয় উপাসনালয় হলো সুলামানি টেম্পল। রাজা নরপতিসিথু ১১৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এ উপাসনালয় নির্মাণ করেন। বস্তুত বাগানের অন্যান্য বিখ্যাত মন্দির সুলামানি টেম্পলের অনুকরণেই নির্মাণ করা হয়েছে। পাথর, ইটের সমন্বয়ে নির্মিত তামাটে এই লাল মন্দির ভেতরে আঁকা ফ্রেসকোর জন্যও বিখ্যাত। আর পিরামিড আকারের মন্দিরের প্রতি তলার কোণে কোণে ক্ষুদে শৃঙ্গ আকারে নকশা করা।

ভেতরে তিনতলা অবধি আরোহণের অনুমতি পেয়ে চড়ে বসলাম সম্ভাব্য চূড়ায়।
এখানে আগেভাগেই এক ইংরেজ নারী এসে বসেছেন। গরমে কেই–বা মাথার ওপরের ছাউনি হারাতে চায়! মেয়েটির নাম ক্যারোল। গাড়ির কারিগর, মানে ইঞ্জিনিয়ার। আমার মতোই সোলো ট্রাভেলার। যখনই ছুটি পায়, তখনই ছুটে বেড়ায়। আমি খুব অহং ভরে বললাম, ‘আমিও ইঞ্জিনিয়ার, তবে যন্ত্রপাতির কাজ করি না এখন। কাজ করতে ভালোও লাগে না। বরং সারা বছর টই টই করতেই বেশি ভালো লাগে।’

ক্যারোল আমাকে আপাদমস্তক দেখে পেশার কথা কিছুই না বলে বলল, ‘তুমি মিডি পরে এত উঁচু উঁচু সিঁড়ি ডিঙালে কীভাবে?’

আমার মুখে তখন গর্বের হাসি আরও চওড়া হয়ে গেছে। বললাম, ‘আমাদের দেশে শাড়ি পরে নারীরা সাঁতার কাটে, গাছে চড়ে, সাঁকো পার হয়। আর আমি তো স্রেফ একখানা মিডিই নাহয় পরেছি।’ আমার উদ্ভট পোশাককে একটু রং না চড়ালেই নয়, বুঝলাম। আর এই খাঁটি বাঙালের পোশাকজ্ঞানকে গুলতানি মারার সুযোগ কেনই–বা হারাব!
এদিকে মন্দিরের ভেতর চুনকাম করা দেয়ালে আঁকা হাজার বছরের পুরোনো ছবি। সাদা ক্যানভাসে খয়েরি বসনে বুদ্ধ; কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বসে আর তাঁর পাশে অনেক অনেক ভিক্ষু অনুসারী একই বসনে। এ ধরনের ছবি দেখলে আমার নিজেরই ভিক্ষু হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি তো জন্মেছিই ঘুরে বেড়ানোর জন্য। এক জায়গায় মন বেশি দিন টেকে না। নতুন দেশ, নতুন মানুষ না দেখলে আমার আত্মার ভেতরের আত্মা শান্তি পায় না, নিজস্ব প্রার্থনা পূর্ণতা পায় না। তাই হুটহাট সাধু হওয়াটা এই মুহূর্তে জরুরি নয়।

সূর্য পশ্চিমের দিকে ভিড়তে সবে শুরু করেছে, তাপও কমছে। মন্দিরের ফোকর থেকে কবুতর সবে বের হচ্ছে, হাওয়া খাচ্ছে, একে অন্যের গলা খুঁটে দিচ্ছে, গলায় গলায় ভাব করছে। আর আমারও সময় হলো শোয়েজিগন প্যাগোডায় যাওয়ার।

শোয়েজিগন প্যাগোডা শহরের আরেক মাথা জুড়ে আছে। রাস্তা একটাই। যেতে হবে আমার হোটেল পার হয়ে।

ততক্ষণে ফিকে হচ্ছে আকাশ, চারদিকে একটা ছায়া জড়িয়ে লম্বা পা ফেলে পশ্চিমের দিকে যাচ্ছে সুয্যিমামা।

শোয়েজিগন প্যাগোডার সামনে লেখক
Picasa

প্যাগোডার বাইরের দিকটা খুবই সাদামাটা দেয়ালে ঘেরা, ভেতরটাও সে রকমই হতে পারে আর এখন অবধি দেখা প্রায় সব প্যাগোডার আকার একই রকম।
প্যাগোডা নামকরণ করলেও এটি আসলে স্তুপ। ধর্মগুরুদের মৃত্যুর পর দেহাবশেষ রাখা হয় যে স্থানে, তাকে বলা হয় স্তুপ; আকারে বড় ঘণ্টার মতো। দীর্ঘ ৪০ বছর লাগে এই উপাসনালয় নির্মাণ করতে। ১১০২ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। রাজা আনোরাতা এ প্যাগোডা নির্মাণ করেন। এরপর কয়েকবার ভূমিকম্পে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পুনর্নির্মাণ করা হয়।
এসবই আমার পুঁথিগত বিদ্যা।

তবে ভেতরে গিয়ে আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কোথায় এসে পড়েছি। আগের মন্দিরের মতো এটি একেবারেই নয়। না রঙে, না সৌন্দর্যে, না প্রকাশের আঙ্গিকে।

প্যাগোডাটি যে আগাগোড়া সোনায় মোড়া, বেলা শেষের স্বর্ণালি আলোয় এটি সোনা বিলাচ্ছে। পরিমাপ করলে হয়তোবা কয়েক মণ সোনা ইতিমধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে এই পাঁচ মিনিটে। আমি বিমোহিত, বাকরুদ্ধ, বিস্মিত।

শোয়েজিগন প্যাগোডার সামনে
ছবি: লেখক

পিরামিড আকারের উপাসনালয়টি তামার পাত দিয়ে আবৃত, তাই দেখতে স্বর্ণমন্দির বলে মনে হয়। উপাসনালয়ের ভেতরে গৌতম বুদ্ধের দাঁত, শরীরের একটি হাড় আর পায়ের ছাপ সংরক্ষিত আছে। এ কারণে মন্দিরটি ততোধিক আদরনীয়।
ভেতরে অন্যান্য মন্দিরের মতোই চার দেয়ালে চার ভঙ্গিতে ভগবান গৌতম বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, সোনালি আভা ঠিকরে পড়ছে তাঁর গা থেকে। মূর্তিগুলোও তাম্রনির্মিত। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে বাইরে, সোনার মন্দিরে। এই সোনার মন্দির এবার আমার হৃদয়মন্দিরে বেশ আসন গেড়ে বসে পড়েছে।