‘বিয়ের পরদিনই আমি বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি’
‘রক্ষণশীল ইরানের এক মুক্তমনা পরিবারে আমার জন্ম। আমার আশপাশের অন্য মেয়েদের জীবন ছিল নানা বিধিনিষেধের বেড়ায় বন্দী। অন্যদিকে আমি বড় হতে লাগলাম নানান খেলাধুলাকে সঙ্গী করে। আমার বয়স যখন ২০, তখন আমি স্নাতকোত্তরের জন্য ভারত চলে আসি।’
‘ভারতে এসে দেখি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু মেয়ে বাইক চালায়। দেখে বেশ লাগল। আমিও আমার একটা বন্ধুকে অনুরোধ করলাম আমাকে দুই চাকার এই বাহন চালানো শেখাতে। বাইক চালানোর সময় যখন বাতাসে আমার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যেত, আমি যেন স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ পেতাম। বাইকের সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে গেল। পরবর্তী এক বছরে টাকা জমিয়ে আমি নিজেই নিজেকে একটা বাইক উপহার দিলাম।’
‘অন্য যে নারীরা বাইক চালাত, আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। এভাবে আমি ভারতের নারী বাইকারদের কমিউনিটির একজন হয়ে গেলাম। আমরা সবাই মিলে বাইকে করে সারা ভারত ঘুরে বেড়াতাম। এরপর আমি আমার পিএইচডির কথা ভুলে গিয়ে বাইক নিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। এখন আমার বয়স ৩২। আর আমি নিজের বাইকে চড়ে সাতটি মহাদেশ ঘুরে দেখার স্বপ্ন দেখি।’
‘এসবের মধ্যে আমি অ্যালেক্স নামের একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াই। জানতাম, আমার যাযাবর মন সম্পর্কটাকে ভোগাবে। তাই আমি ওকে বিদায় বলে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সেই মুহূর্তে জানতাম না যে কোথায় যাচ্ছি। আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে সবকিছুই ছিল অনিশ্চিত। কিন্তু আমি যেমন আমার স্বপ্নকে অনুসরণ করেছি, ছাড়িনি, অ্যালেক্সও আমাকে ছাড়েনি। আমি যেখানে যেখানে গিয়েছি, অ্যালেক্সও সেখানে সেখানে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছে। মাসে একবার সে আমার সঙ্গে দেখা করত। আমিও বুঝে গেলাম, এই মানুষই আমার জীবনসঙ্গী।
‘এক বছরের মাথায় আমরা বিয়ে করে ফেলি। আমার জীবনসঙ্গীকে পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু জানালার বাইরে থেকে বাইকে চড়ে বিশ্বভ্রমণের ইচ্ছাটাও বড্ড টানছিল। তাই বিয়ের এক দিন পরই আবার বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আগের মতোই অ্যালেক্স আমার সঙ্গে বিভিন্ন শহরে দেখা করত। আর আমি আমার বাকেট লিস্ট থেকে একের পর এক শহরের নাম কাটতাম। বাইকে চড়ে আমি অ্যান্টার্কটিকায়ও গিয়েছি। তখন আমি ষষ্ঠ মহাদেশে, আফ্রিকায়। সেখানেই জানতে পারলাম, আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছি।
‘আমি সন্তান চেয়েছি। আর সাত মহাদেশ ঘুরে দেখার স্বপ্নটাও ছাড়তে চাইনি। তাই আমি সেই অবস্থায়ও ঘুরে বেড়িয়েছি। মাঝেমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে থামতাম। আর পারতাম না। একটু থেমে সঙ্গে থাকা বোতলের পানি খেয়ে পেটে হাত দিয়ে বলতাম, “আমরা পারব, আমরা পারব।” আমি চিকিৎসক দেখাই। ওষুধপত্র শুরু করি। আমার গতি কমিয়ে আনি। রাস্তা বদলাই। ছোট, তুলনামূলকভাবে মসৃণ পথ ধরি। কিন্তু থামি না। যখন যে শহরে থাকতাম, সেই শহরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখত অ্যালেক্স। আমরা চিকিৎসক দেখাতাম। এভাবেই কেটে গেল গর্ভকালীন প্রথম ছয় মাস।’
‘এরপর আমি দিল্লিতে ফিরে আসি। আমার মনে হলো, নতুন জীবনের স্বাদ নেওয়ার জন্য এবার আমি তৈরি। ২০১৮ সালের নভেম্বরে আমার আর অ্যালেক্সের জীবনে এল নাফাস। নাফাসকে কোলে নিয়ে বহুদিন পর আমি কাঁদলাম। ওর বয়স এখন তিন। এই বয়সেই ও আমার বাইক ভালোবাসে। আর আমরা ঠিক করেছি যে আমরা মা-মেয়ে দুজনে মিলে আমার স্বপ্নটা পূরণ করব। আর তারপর আবার বাইকে চড়ে বিশ্ব ঘুরে বেড়াব। আমি যা যা দেখেছি, এবার ওকে সব দেখাব। ওকে সঙ্গে নিয়ে আবার দেখব। ও বড় হবে এমন এক মায়ের সঙ্গে, যে জীবনে কখনো কোথাও থিতু হয় না। আমার বিশ্বাস, আমার মতোই ও কোনো এক চার রাস্তার মোড়ে বা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিস্তৃর্ণ খেত দেখতে দেখতে অথবা মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পাবে। নিজের সুখ খুঁজে পাবে।’
সূত্র: অফিশিয়াল হিউম্যানস অব বোম্বে থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত। যে নারীর গল্প, তাঁর নাম উল্লেখ নেই।