বুলগেরিয়ায় কয়েক দিন

পূর্ব ইউরোপের এ দেশের নবীন প্রজন্মই কেবল ইংরেজিতে কিছুটা দক্ষ। ফলে রাশান আর বুলগেরিয়ান ভাষা না জানা থাকলে ঝামেলায় পড়তে হয়। এর সঙ্গে আছে উপমহাদেশ থেকে যাওয়ার বিড়ম্বনা।

সোফিয়া বিমানবন্দরছবি: উইকিপিডিয়া

ইউরোপে পা রাখার পর থেকেই বুলগেরিয়া আর রোমানিয়া—এ দুই দেশকে নিয়ে সব সময় আগ্রহ কাজ করত। অবশ্য কেন আচমকা বুলগেরিয়া ও রোমানিয়াকে নিয়ে আমার এ আগ্রহ, তা নিজেই জানি না। হতে পারে বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া নাম দুটিই আমার কাছে একটু আলাদা মনে হতো।

সোফিয়া বিমানবন্দরের অ্যারাভাইল লাউঞ্জ
ছবি: লেখক

ইউরোপে আসার পর তাই আমার প্রথম সফর শুরু হয় বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া দিয়ে। এর আগে অবশ্য আলবেনিয়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তবে সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের কোনো সফর ছিল না। আইজেক কর্তৃক আয়োজিত এক গ্লোবাল ভলান্টিয়ারিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে আলবেনিয়া গিয়েছিলাম।

যাহোক, ইউরোপে আসার পর প্রথম যে দেশে গিয়েছিলাম, সেটি ছিল বলকান উপদ্বীপের একটি দেশ। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রিসে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এ মুহূর্তে বলতে গেলে এটি আমার সর্বশেষ কোনো দেশ ভ্রমণ। ভৌগোলিকভাবে গ্রিসও বলকান উপদ্বীপের সবচেয়ে দক্ষিণের অংশ। আশা করি, ইউরোপ ট্যুরের ইতিও টানব বলকান কোনো দেশে গিয়ে।

আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগের ঘটনা। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মাঝামাঝি কোনো একটি সময়। রিক্ত শীতকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতিতে বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে। কয়েক দিন আগেও রাস্তার ধারে প্রাণহীনভাবে যে গাছগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, এপ্রিল আসতে না আসতে একেবারে অবিশ্বাস্যভাবে গাছগুলো ভরে গেছে সবুজ কচি পাতায়। পত্রপল্লবে ভরে উঠছে নতুন ফুলে। চারদিকে কেবল সবুজের সমারোহ। ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী মানুষেরা এ সময় ইস্টার উৎসবে মেতে ওঠেন। বলা হয়ে থাকে, বড়দিনের পর ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ‘ইস্টার’।

ইস্টার উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি সাত দিনের ছুটি দেয়। আমি সময় নষ্ট না করে বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া ভ্রমণের জন্য এই সময়কেই বেছে নিই।

স্লোভেনিয়া থেকে সরাসরি বুলগেরিয়া যাওয়ার ফ্লাইট নেই। বাসের জার্নিটাও অনেক লম্বা। তবে উইজ এয়ারের মাধ্যমে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে মাত্র ১৫ ইউরোতে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় পৌঁছানোর ফ্লাইটের টিকিটও পেয়ে যাই।

২০০৭ সালে বুলগেরিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা সেনজেনভুক্ত যেকোনো দেশের ভিসা থাকলে বুলগেরিয়াতে ভ্রমণ করা যায়। আলাদাভাবে ভিসার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, কেবল ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পাসপোর্টে অ্যারাইভাল এবং ডিপার্চার সিল দিয়ে দেন।

সোফিয়া বিমানবন্দরের ভিতরে
ছবি: উইকিপিডিয়া

তবে সোফিয়ায় পা রাখার পর আচমকা বেশ কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। একমুহূর্তে যেন বুলগেরিয়া ভ্রমণের সব আনন্দ পানসে হয়ে ওঠে।
শুরুটা হয় এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে। অন্য যাত্রীদের মতো আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ এক অফিসার এসে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন মনে হলো তিনি জীবনে আমার মতো শ্যামবর্ণের কোনো মানুষকে দেখেননি। আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট ও রেসিডেন্ট পারমিট দেখতে চাইলেন, আমি তাঁকে আমার পাসপোর্ট ও রেসিডেন্ট পারমিটের কপি দেখালাম। মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে হইচই পড়ে গেল।

এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের বেশির ভাগ অফিসার ছিলেন বয়স্ক। বুলগেরিয়ান ও রাশান—এ দুই ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় তাঁরা পারদর্শী নন। আমাকে আলাদা একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্যাগ থেকে শুরু করে আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে একাধিকবার তল্লাশি চালানো হলো। এক জুনিয়র অফিসার এসে আমার সঙ্গে থাকা মুঠোফোনটি ছিনিয়ে নিলেন। আমার কছে তিনি পাসওয়ার্ড চাইলেন। দেওয়ামাত্র তিনি আমার ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবার অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ফোনের গ্যালারি পর্যন্ত সব চেক করলেন।

সোফিয়া বিমানবন্দরের ভিতরে
ছবি: উইকিপিডিয়া

কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রমহিলা এসে আমাকে বেশ কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। কেন আমি বুলগেরিয়ায় এসেছি, স্লোভেনিয়ায় আমি কী করি, আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে কি না, কোন ধরনের অ্যালকোহল ব্র্যান্ড আমার সবচেয়ে পছন্দ, আমার মা–বাবা কী করেন ইত্যাদি কোনো প্রশ্ন বাদ গেল না। ভদ্রমহিলা যখন জানতে পারলেন আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমার কাছে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস জানতে চাইলেন। বালাকোটে সৈয়দ আহমেদ বেরলভীর আন্দোলন থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন—কোনো কিছু বাদ গেল না, প্রতিটি বিষয় নিয়ে তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন। আমিও যথারীতি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বাংলাদেশ সম্পর্কেও দেখলাম তাঁর যথেষ্ট ধারণা রয়েছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কখনো ভারত কিংবা পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন কি না। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, ভারত ভাগের ওপর তিনি পিএইচডি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা পরবর্তী সময়ে আর হয়ে ওঠেনি। যাহোক, প্রায় দুই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাকে ছাড়া হলো।

যে অফিসার আমার থেকে মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে প্রশ্ন করলাম, কেন আমার সঙ্গে এমন আচরণ করা হলো? আমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে আসা অন্য যাত্রীদের তো কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। তিনি জানালেন, অতীতে তাঁরা বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অসংখ্য নাগরিককে পাসপোর্ট, রেসিডেন্ট পারমিটসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট জালিয়াতির অভিযোগে আটক করেছেন। বিশেষত বুলগেরিয়ার অনেক নাগরিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বিয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেকে সেনজেনের দেশগুলোতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছেন বলেও তিনি জানালেন।

তিনি বলেন, অনেকে এত সূক্ষ্মভাবে পাসপোর্ট, রেসিডেন্ট কার্ড ও বিয়ের কাগজের নকল প্রতিলিপি তৈরি করেন যে সেটা আসল না নকল, তা তাঁদের পক্ষে নিরূপণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই বাধ্য হয়ে তাঁদের এখন কঠোর হতে হচ্ছে।

সোফিয়ার এয়ারপোর্টটি খুব একটা বড় নয়, এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বের হওয়ার পর সিটি সেন্টারের দিকে যাওয়ার জন্য বাসের সন্ধান করতে লাগলাম। সিটি সেন্টারের কাছে হোস্টেল ওয়ান-টু-থ্রি নামের একটা হোস্টেল আছে। বুকিং ডটকমের মাধ্যমে আগে থেকে তিন রাত থাকার জন্য সেখানে বুক করে রেখেছিলাম। সাত ইউরোয় বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট।

এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের সেই ভদ্রমহিলা আমাকে বিশেষ কিছু বিষয়ে আগে থেকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রথমত, বুলগেরিয়ায় পকেটমারের উপদ্রব অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, বুলগেরিয়ায় চলাচলের ক্ষেত্রে ট্যাক্সির ওপর নির্ভর না করা।

ইউরোপের অন্যান্য শহরের মতো সোফিয়ার রাস্তায় দেখা যায় বিদ্যুৎচালিত বাস
ছবি: লেখক

বুলগেরিয়ায় তরুণ প্রজন্মেরা ছাড়া অন্য কেউ সেভাবে ইংরেজিতে পারদর্শী নন। তাই একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার দক্ষভাবে ইংরেজি বলতে পারেন না। তা ছাড়া বুলগেরিয়ায় ট্যাক্সি ড্রাইভারদের রয়েছে সিন্ডিকেট। ভদ্রমহিলা আমাকে জানালেন, এয়ারপোর্ট থেকে সিটি সেন্টারের ন্যায্য ভাড়া ৫ ইউরো, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, ট্যাক্সি ড্রাইভার বিভিন্ন কূটকৌশলে ট্যুরিস্টদের থেকে ২০ ইউরোও ভাড়া আদায় করে নেন।

আর সর্বশেষ যে বিষয় তিনি বারবার উল্লেখ করছিলেন সেটা হলো, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বুলগেরিয়া সেক্স ইন্ডাস্ট্রির জন্য বেশ পরিচিত। থাইল্যান্ড কিংবা ফিলিপাইনের মতো এটা নাকি সেদেশর পর্যটন খাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ কারণে বুলগেরিয়ার পথে পথে হরহামেশা যৌনকর্মীর দেখা মেলে। মাঝেমধ্যে সচেতন না থাকার ফলে অন্য দেশের পর্যটকই নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন।