যেভাবে তৈরি হলো হরিপ্রভা তাকেদার প্রামাণ্যচিত্র

হরিপ্রভা তাকেদা ছিলেন ঢাকার মেয়ে। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জাপানি নাগরিক উয়েমন তাকেদার। বিয়ের কয়েক বছর পর ১৯১২ সালে তাঁরা জাপান ভ্রমণে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসে হরিপ্রভা লিখেন বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা নামে একটি বই। সম্প্রতি হরিপ্রভা তাকেদা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন পর্যটক এলিজা বিনতে এলাহী। শত বছর আগের একজন আধুনিক নারীকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকছে এখানে

প্রামাণ্যচিত্রে উয়েমন তাকেদা ও হরিপ্রভার চরিত্রে এলিজা বিনতে এলাহী ও শফিকুল ইসলাম। প্রামাণ্যচিত্রের পোস্টার

দেশের ৬৪ জেলার ঐতিহ্য দর্শনের এক অভিযানে নেমেছিলাম ২০১৬ সালে। সে যাত্রায় ইতিহাসের বেশ কয়েকজন হারিয়ে যাওয়া নারীকে আমি খুঁজে পেয়েছি, যাঁরা ছিলেন সময়ের তুলনায় আধুনিক। তাঁদের কাজ সব সময়ের, নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার। তাঁদেরই একজন হরিপ্রভা তাকেদা।

হরিপ্রভা তাকেদার সঙ্গে পরিচয় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইটি পড়ার সময়। আচমকাই ‘ঢাকার প্রথম আধুনিক মহিলা’ শিরোনামের প্রবন্ধে দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল। সেখানেই হরিপ্রভা তাকেদা এবং উনিশ শতকের ব্রাহ্মসমাজের কথা জানা হয়। হরিপ্রভা মল্লিক জাপানের এক নাগরিককে বিয়ে করে কীভাবে হরিপ্রভা তাকেদা হলেন, তাঁর জাপান ভ্রমণ, দেশে ফিরে বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা নামে বই লিখলেন—সব মিলিয়ে প্রবন্ধটি পড়ার সময় একটা ঘোর লাগে। তখনই হরিপ্রভা তাকেদা নামটি মনে গেঁথে যায়।

হরিপ্রভা নামটির সঙ্গে পরিচয়ের পর দুই বছর পেরিয়ে যায়। ২০১৮ সালে শাহবাগের একটি বইয়ের দোকানে আচমকাই চোখে পড়ে বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা বইটি। জেনে অবাক হই, হরিপ্রভার বইটি নতুন করে ছাপা হয়েছে। সংগ্রহ করি। বাসায় ফিরতে ফিরতে বইটির পাতা ওলটাতে থাকি।

হরিপ্রভা তাঁর জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এভাবে শুরু করেছেন, ‘আমার যখন বিবাহ হয় তখন কেহ মনে করে নাই যে আমি জাপান যাইব। কাহারও ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু আমার বড়ই ইচ্ছা হইত আমি একবার যাই। সে ইচ্ছা স্বপ্নেও পর্যবসিত হইত।...কারণ চারদিকের অবস্থা কত প্রতিকূল। অর্থবল সামান্য, শরীর অপটু, সম্মুখে শীতকাল, আত্মীয়গণের অনিচ্ছা, অনেকের নানা ভয়প্রদর্শন’।

হরিপ্রভা আর কোনো দেশ ভ্রমণ করেছেন কি না, সেটি জানা যায়নি, আর কোনো ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন কি না, সেটিও জানি না। কিন্তু তাঁর বইয়ের শুরুতে যে ভ্রমণস্পৃহা এবং পড়তে পড়তে যে বর্ণনা, আমার দৃষ্টিতে হরিপ্রভাকে একজন পর্যটক হিসেবে হাজির করে। ভ্রমণকাহিনি পড়ার পর হরিপ্রভার নামের স্মৃতিতে যতটুকু ধুলো জমেছিল, সেটি সরে গিয়ে হীরকখণ্ডের মতো চকচক করতে লাগল।

হরিপ্রভা তাকেদা সম্পর্কে জেনে আরও তিনটি বিষয় আমাকে আলোড়িত করে। তিনি প্রথম বাঙালি নারী, যিনি জাপান ভ্রমণ করেছেন, প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে জাপান সম্পর্কে বই লিখেছেন, প্রথম বাঙালি নারী, যিনি জাপানের এক নাগরিককে বিয়ে করেছেন। উনিশ শতকের গোড়ায় একজন বাঙালি নারী কতটা আধুনিক হতে পারেন, তার প্রমাণ হরিপ্রভা তাকেদা। তাই ভ্রমণপ্রিয় একজন মানুষ হিসেবে, একজন নারী হিসেবে হরিপ্রভাকে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। তারই পথ ধরে শুরু করি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজ।

হরিপ্রভার একটি ছবি আর তাঁর বইটি আমার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সম্বল। গবেষণা করতে গিয়ে জানি, চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল জাপান ফাউন্ডেশনের অনুদানে দ্য জাপানিজ ওয়াইফ নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। আর আমি ২০-২৫ মিনিট নিয়ে ভাবনায় ডুবে আছি।

ডুবে থাকার কারণ অর্থ। আমি ব্যক্তিগতভাবে কাজটি এগিয়ে নিয়েছি। আমার মনে হয়, একেকজনের গল্প বলার ভাষা একেক রকম। সুতরাং সময়ের তারতম্য হতেই পারে। ধীরে ধীরে চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু করলাম। আমার দলের সঙ্গেও পরামর্শ চলতে থাকল। দল বলতে আমার দু-তিনজন বন্ধু।

চিত্রনাট্য লেখার কাজ বেশ খানিকটা এগোনোর পর অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমার ইচ্ছার কথা জানাই। তিনি সব রকম তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। নির্দেশনা দেন কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাতের (এখন প্রয়াত) সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে। কালি ও কলম পত্রিকার আর্কাইভে হরিপ্রভাকে নিয়ে পুরোনো লেখাগুলো খুঁজে বের করি। আবুল হাসনাত অত্যন্ত প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি আমার অনুরোধে ক্যামেরায় কথা বলতে রাজি হয়েছেন। হরিপ্রভাকে কী করে জানলেন সেই গল্প শুনেছি তাঁর কাছে।

আবুল হাসনাতের মাধ্যমে জাপানপ্রবাসী লেখক ও গবেষক মঞ্জুরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, কথা হয়। যোগাযোগ হয় জাপানি গবেষক কাজুহিরো ওয়াতানাবের সঙ্গেও। তাঁদের অভিজ্ঞতা জানি। ভিডিওতে তা ধারণ করা হয়। হরিপ্রভা তাকেদা: অ্যান আনসাং ট্রাভেলার অব বেঙ্গল নামের প্রামাণ্যচিত্রটি পূর্ণতা পেতে থাকে এভাবেই।

আমার তৈরি প্রামাণ্যচিত্রে হরিপ্রভা তাকেদাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁর মাধ্যমে সে সময়ের ব্রাহ্মসমাজ, জাপানি নাগরিক তাকেদার সঙ্গে দেখা হওয়া, তাঁদের বিয়ে, সে সময়ের পুরান ঢাকা, ঢাকায় তাকেদার কর্মক্ষেত্র, জাপানযাত্রার মুহূর্তও উঠে এসেছে। প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য ধারণ করেছি পুরান ঢাকায়, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরে। এসব দৃশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গবেষকদের অভিজ্ঞতা।

২৬ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র। শত বছর আগের ঢাকার একজন আধুনিক নারী হরিপ্রভা তাকেদাকে এ প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করানোর প্রচেষ্টা এটি। আর সেটা সফল হলে তা হয়ে উঠবে আমার আনন্দের উপলক্ষ।