সাক্ষাৎকার
যে দেশেই যাই, বাংলাদেশকেই তুলে ধরি: নাজমুন নাহার
১৫০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশি নাজমুন নাহার। ৬ অক্টোবর মধ্য আফ্রিকার দ্বীপদেশ সাও টোমে অ্যান্ড প্রিন্সিপে পৌঁছে তিনি এই ব্যক্তিগত রেকর্ড গড়েন। তাঁর পরিব্রাজক জীবনের শুরু, বিশ্বভ্রমণের অনুপ্রেরণা আর লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেছেন ছুটির দিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজীব মিয়া
প্রশ্ন :
১৫০তম দেশ ভ্রমণ করে আপনার অনুভূতি কী?
নাজমুন নাহার: আমি ভীষণ আপ্লুত, আনন্দিত। সাও টোমে অ্যান্ড প্রিন্সিপেতে পা রেখে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। অনেক কষ্টের পর এ অর্জন। ২১ বছর ধরে আমি ভ্রমণ করছি। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের ৫০তম বছরে বিশ্বের ১৫০টি দেশ ভ্রমণ সম্পন্ন করব। লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে আমি সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি, নিঃসন্দেহে এটি আমার জন্য গর্বের ব্যাপার।
প্রশ্ন :
বিশ্বের এত দেশ থাকতে ১৫০তম দেশ হিসেবে সাও টোমে ও প্রিন্সিপেকে বেছে নিলেন কেন?
নাজমুন: আফ্রিকার দেশগুলোতে অনেক অদেখা প্রকৃতি লুকিয়ে আছে। সেটা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই ১০০তম দেশ হিসেবে আমি আফ্রিকার জিম্বাবুয়ে ভ্রমণ করেছি। ১৫০তম দেশ হিসেবে সাও টোমে ও প্রিন্সিপে বেছে নিয়েছি দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। বিশ্বের ঠিক মাঝামাঝি বিষুবরেখার মধ্যে দেশটির অবস্থান। আফ্রিকার ক্ষুদ্রতম দেশ, সমুদ্রের মাঝখানে। এসে মনে হচ্ছে ‘অদেখা স্বর্গ’।
প্রশ্ন :
এখানে কত দিন থাকবেন?
নাজমুন: অক্টোবরের শেষ দিকে সুইডেনে ফিরব। নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।
প্রশ্ন :
আফ্রিকায় কোভিড পরিস্থিতি কেমন?
নাজমুন: আফ্রিকার দেশগুলোতে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ পর্যায়ে নেই, শহরাঞ্চলের যেখানেই গিয়েছি, দেখেছি মানুষ করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে।
প্রশ্ন :
এবারের ভ্রমণযাত্রা শুরু করেছিলেন কবে?
নাজমুন: গত ৬ আগস্ট সুইডেন থেকে বুরুন্ডিতে পৌঁছাই। বুরুন্ডি ছিল আমার ভ্রমণের ১৪৫তম দেশ। সেখান থেকে সড়কপথে যাই প্রতিবেশী দেশ কঙ্গোতে। এরপর একে একে গত দুই মাসে দক্ষিণ সুদান, নামিবিয়া ও অ্যাঙ্গোলায় গিয়েছি। অ্যাঙ্গোলা থেকে ৬ অক্টোবর বিকেল পাঁচটায় পৌঁছাই সাও টোমে ও প্রিন্সিপে।
প্রশ্ন :
ভ্রমণের সময় কী কী করলেন?
নাজমুন: আমার লক্ষ্য ভ্রমণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়া। বাংলাদেশ সম্পর্কে মানুষকে জানানো। এ জন্য স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সব সময় মিশে যাই। এবারও তাই করেছি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেখা করেছি। কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে আসা বাংলাদেশি সদস্যদের আমন্ত্রণে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তাঁদের সঙ্গে ভালো সময় কেটেছে। এই দেশগুলোতে আমার ভ্রমণের খবর স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন :
বিশ্বশান্তির বার্তার বিষয়টি যদি বুঝিয়ে বলেন?
নাজমুন: প্রতিটি দেশে গিয়ে আমি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাই। বেসরকারি সংস্থার সম্মেলনে হাজির হই। শিক্ষার্থীদের সমাবেশে বলি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ আমরা মানুষ। পৃথিবীটাই আমাদের ঘর। যুদ্ধ করা যাবে না। পরিবেশ রক্ষা করতে হবে—এসবই।
প্রশ্ন :
শুধুই মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ, প্রকৃতি দেখা হলো না?
নাজমুন: প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া ভ্রমণ তো অসম্পূর্ণ। দেশে দেশে প্রকৃতির প্রেমেই তো ছুটে চলা। এই অভিযাত্রায় সবচেয়ে ভালো লেগেছে নামিবিয়ার নামিব মরুভূমি। সমুদ্র আর মরুভূমি এখানে এক হয়ে গেছে। কী দারুণ স্মৃতি! বুরুন্ডির বুজুম্বুরা পোতাশ্রয়, কঙ্গোর উভিরা হ্রদ, দক্ষিণ সুদানের নীল নদ, অ্যাঙ্গোলার মুসোলো দ্বীপের কথাও মনে থাকবে।
প্রশ্ন :
আপনার বিশ্বভ্রমণের শুরু তো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে?
নাজমুন: ২০০০ সালের কথা সেটা। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশ নিতে গেলাম ভারতের মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারিতে। সে এক রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল। সেটাই ছিল প্রথম বিদেশযাত্রা।
প্রশ্ন :
তারপর?
নাজমুন: স্নাতকোত্তর শেষে ঢাকায় চলে আসি। একটি বিনোদন সাময়িকীতে কিছুদিন কাজ করেছি। ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে চলে আসি সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছি। পড়াশোনার ফাঁকে খণ্ডকালীন কাজ করতাম। কয়েক মাসের জমানো টাকায় বেরিয়ে পড়তাম। সুইডেনে এসে প্রথম ভ্রমণ করি ফিনল্যান্ড। তারপর তো বিভিন্ন দেশে।
প্রশ্ন :
২১ বছরের ভ্রমণজীবন আপনার...
নাজমুন: জি, ঠিক তাই। ২১ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তবে আমার গল্প মানুষ জেনেছে ২০১৮ সালে, প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ছুটির দিনের মাধ্যমে। আমার বিশ্বভ্রমণ নিয়ে সেটাই ছিল প্রথম প্রতিবেদন। ছুটির দিনের সেই প্রতিবেদন আমার ভ্রমণতৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন :
দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো তো অনেক খরচের ব্যাপার...
নাজমুন: খরচের ব্যাপার তো নিশ্চয়। তবে পরিকল্পিত ভ্রমণে খরচ কমানো সম্ভব। সুইডেনে পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করতাম। গরমকালে ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টাও কাজ করেছি। পরিশ্রম করেই অর্থ রোজগার করতাম, ভ্রমণের জন্য জমাতাম। এখন স্বল্পকালীন গবেষণা প্রকল্পে কাজ করি। কোথাও ভ্রমণে গেলে কম খরচে থাকি। আকাশপথ ছেড়ে সড়কপথে ভ্রমণ করি। এ জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ভাগ করে করে টানা ভ্রমণ করছি।
প্রশ্ন :
নতুন যাঁরা ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের জন্য কী বলবেন?
নাজমুন: স্বপ্নবান হতে হবে। পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। নিজেকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে। বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনার সময় পৃথিবীর মানচিত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। অঞ্চল ভাগ করে করে সীমান্ত পারাপারে সড়ক সুবিধা আছে এমন দেশগুলো আগে ভ্রমণ করতে হবে। এতে কম খরচে বেশি দেশ ভ্রমণ করা যাবে।
প্রশ্ন :
অনেকে আপনার দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধার কথা বলেন...
নাজমুন: আমি যে দেশেই যাই, বাংলাদেশকেই তুলে ধরি। লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে ঘুরি। বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে আমাকে বাংলাদেশি হিসেবেই প্রচার করে। সম্মাননা জানায়। আমি ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পাসপোর্টে ভ্রমণ করেছি। আসলে যে দেশের পাসপোর্টেই হোক না কেন, বিশ্বের অনেক দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে ভ্রমণ করার সময় ভিসার প্রয়োজন এবং সেটা অনেক কঠিন।
প্রশ্ন :
আপনার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
নাজমুন: আমার জন্ম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার গঙ্গাপুরে। স্কুল-কলেজও সেখানেই। বাবা মোহাম্মদ আমিন একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মা তাহেরা আমিন। তাঁরা আমার ভ্রমণজীবনকে সহজ করেছেন। মা আমার সঙ্গে অনেক দেশ ঘুরেছেন। এই তো!
প্রশ্ন :
১৫০ দেশ তো হলো, এরপর?
নাজমুন: বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন দেশ ভ্রমণের চেষ্টা করব। বিশ্বশান্তির বার্তা পৌঁছানোর প্রচারণায় আরও বেশি করে সক্রিয় হব। বিশ্বভ্রমণের ওপর বই লিখছি, দ্রুত শেষ করব।
প্রশ্ন :
আপনাকে ধন্যবাদ।
নাজমুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।