লাংলুক ঝরনার মুগ্ধতা

সাঙ্গুর বুকে ছুটে চলা

ডিসকভারি টিভি চ্যানেলে সেইলর মাছের ওপর প্রামাণ্যচিত্র দেখেছিলাম। এই জাতের মাছ শিরদাঁড়া পানির ওপর তুলে পালতোলা নাওয়ের মতো সাঁতার কাটে। আবার ফ্লাইং ফিশ বা উড়ুক্কু মাছের কথা তো অনেকের জানা, পানির ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে উড়ে চলে। সাঙ্গু নদের উত্তাল স্রোতে আমাদের নৌকা যেভাবে ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে লাফিয়ে ছুটে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম না কার তুলনা কার সঙ্গে করব—সেইলর নাকি ফ্লাইং ফিশ!

করোনার কারণে দীর্ঘদিন পর গণ্ডির বাইরে বের হওয়া। গন্তব্য বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম লাংলুক ঝরনা। বান্দরবান থেকে ভোরে আমাদের বহনকারী চান্দের গাড়ি পাহাড়ের পেটের ভেতর দিয়ে ছুটে চলল। ওয়াই জংশন পার হয়ে যেতে যেতে চান্দের গাড়ি ছুটে চলল চিম্বুক রেঞ্জের গা বেয়ে। পাহাড়ি পথের একপাশে মেঘের সমুদ্র, অন্যপাশে একবিন্দুও মেঘ নেই, চকচকে সবুজ। এভাবেই থানচি বাজারে পৌঁছাই।

দুটি ঝিরি মাড়ানোর পর সামনে পড়ল জুমখেত। ধানের শিষে সোনালি রং ধরেছে যেন

সকালের নাশতা সেরে চেপে বসি ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। এসব পাহাড়ি নৌকা বিশেষভাবে তৈরি। প্রবল স্রোতস্বিনী সাঙ্গুর পাথুরে নৌপথ বেয়ে চলতে হয় বলে কাঠামো যেমন শক্তপোক্ত, তেমনি একহারা গড়ন। উজানের দিকে যেতে যেতে নদ ক্রমশ সরু হয়ে এসেছে। পাথরের স্তর ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে প্রবল ঢেউ। নদের দুই ধারে খাড়া পাথুরে দেয়াল। অরণ্যের গহিন দঙ্গল গায়ে নিয়ে সেই পাহাড়ি দেয়াল ক্রমশ উঠে গেছে ওপরে। গায়ে রঙিন ফুল।

নৌকা তিন্দুতে পৌঁছায়। সাঙ্গুতীরের অপূর্ব সুন্দর ভূখণ্ড তিন্দু। ছবির মতো সবুজ পাহাড়। তিন্দু ছাড়ার পর স্রোতের গতিবেগ বাড়তে থাকে। দলনেতা সাগর জানালেন, সামনেই বড় পাথর। আমরা টান টান উত্তেজনা নিয়ে বসি। দূর থেকে দেখা চৌকো পাথরগুলো ক্রমশ বড় হয়ে দৃশ্যমান হতে থাকে। তারপর আমরা ঢুকি সাঙ্গুর বুকে মহিরুহ আকৃতির বড় পাথরগুলোর আস্তানায়। পাথরগুলোর ওপরের দিকের কিছুটা অংশ ভেসে আছে পানির ওপর। বাকিটা পানির নিচে। পাথরে বাধা পেয়ে স্রোত যেন এখানে ফুঁসছে। মাঝিকে এখানে তাই নিপুণ দক্ষতায় এগোতে হয়।

লাংলুক ঝরনার সৌন্দর্য

মাঝির দক্ষতায় নৌকা রেমাক্রিতে এসে নোঙর করল। আমরা লাংলুক ঝরনার উদ্দেশে ট্রেকিংয়ের জন্য নেমে পড়ি। নদীর পাড়ে ঘাসবনের ওপর প্রজাপতির মেলা বসেছে যেন! হলুদ-কমলা রঙে মাখামাখি শরীর। ঝিরিপথ ডিঙিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে চলতে থাকি। পথে পড়ে খুমিপাড়া। তারপর পাহাড়ের একদম খাড়া ঢাল বেয়ে ওঠা। দলের অন্যরা পেছনে থাকায় গাছের ছায়ায় বসে গাইডের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিই। গাইডের নাম ইদ্রিস আলী। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বাড়ি। কৈশোরেই নাকি বাড়ি পালিয়ে চলে এসেছেন পাহাড়ে। সেই পাহাড়প্রেম আর ছাড়েননি।

স্বচ্ছ পানির দুটি ঝিরি মাড়ানোর পর সামনে পড়ে জুমখেত। ধানের শিষে সোনালি রং ধরেছে। জুমের পর ঝোপজঙ্গলে ঘেরা ট্রেইল। পাথর গাছপালা শেওলায় ঢাকা। পিচ্ছিল স্যাঁতসেঁতে। বিশাল একটি পাথরখণ্ডের পাশ দিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতেই যেন খুলে গেল কোনো কল্পরাজ্যের দুয়ার! অনেকে বলেন, দেশের উঁচুতম ঝরনা এটাই—লাংলুক। প্রবল, উন্মত্ত, পাগলাটে কানফাটানো শব্দে আছড়ে পড়ছে পাথুরে পাহাড়ের চূড়া থেকে। ঝরনার পতনস্থল থেকে ছুটে আসছে জলবিন্দুমাখা প্রবল বাতাস। দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না। দ্রুতই পুরো শরীর জলবিন্দুতে ভিজে একশা!

ঝরনার পতনস্থল

আমরা ডুবে যাই মোহনীয় লাংলুকের মুগ্ধতায়। এ যেন এক অন্য জগৎ! ঝরনার সামনের পাথরখণ্ডে ওঠার জন্য গাছের টুকরো বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার, ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তারপর দলের সবাই নেমে পড়ি ঝরনার নিচের অংশে। সেখানে জলবিন্দু আর বাতাস আরও প্রবল। ঝরনার দিকে মুখ করে তাকানোই কঠিন। প্রবল শব্দে কেউ কারও কথা শুনছিলাম না। ভেজা পাথরের গায়ে হেলান দিই। মুগ্ধতায় মৌনতায় বেলা গড়ায়। আকাশ কালো করে একসময় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে...।