হোটেলটা আর খুঁজে পাচ্ছি না

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ সপ্তম পর্ব

সেদিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিলছবি: লেখকের সৌজন্যে

সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। এখন একটু থামলেও মেঘের ডাকাডাকি অব্যাহত আছে। কিন্তু আর দেরি করা যাবে না। সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে সাইকেল চালাতে হবে আজ। সাইকেল দুটি নিয়ে চারজন বেরিয়ে পড়ি।

শুরুতেই হালকা চড়াই। উঠতে গিয়ে গরমে জ্যাকেট খুলতে হলো। উঠে প্রায় সমতলে আমরা। চঞ্চলদের দেখা যাচ্ছে। ভালো চালাচ্ছি দুই দল। সাড়ে সাতটার দিকে বৃষ্টি বাড়ল। সামনে আবার ঢাল। বৃষ্টি বেশ। জ্যাকেট জড়িয়ে ব্রেক ধরে নামা। এ–ও ক্লান্তি আনে। একঘেয়েমি আসে। খুব সাবধানে বসে থাকা। নড়চড় হলেই মনে হয় এই রাস্তা থেকে পিছলে যাব। আমরা এগিয়ে গেলাম। ঘণ্টাখানেক বাদে ঝুপড়ির মতো একটা ঘর দেখে থামলাম। বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ নেই। আমাদের সঙ্গী দুজনকে দেখছি না।

পথের পাশের দোকানে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

রাস্তার বাঁয়ে ঝুপড়িটা। সামনে বাঁশের আড় দেওয়া সাঁকো। ১০ কি ১২ ফুট দৈর্ঘ্যের মাচাং ঘর। দরজাটা এঁকেবেঁকে যাওয়া কাঠের। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ভেতরে প্রবেশ করলাম। খুব বাড়িয়ে বললে চার বাই চার ফুটের খালি জায়গা। আমার মতো কয়েকজন দাঁড়াতে পারবে। দরজার বাঁ পাশে ঝাঁপ খোলা জানালা, যা দিয়ে মুদির সদাইপাতির ব্যবসা চলে। দোকানে খাবার বলতে বোতলজাত পানীয় বেশি। দু–একটা বিস্কুটের প্যাকেট আছে। স্বল্প আয়ের মানুষেরাই এই দোকানে আসেন। আশপাশে আর কোনো দোকান নেই।

বৃষ্টি কমতে কমতে দিনের মধ্যভাগ। আকাশে সূর্য উঠে এল। এবার তাতিয়ে দিচ্ছে সব। এদিকে বৃষ্টি হয়েছে, তবে পশ্চিমে—যেদিক থেকে আমরা আসছি—বেশি হয়েছে। এখন আমরা পূর্বমুখী। চারপাশ ভেজা ভেজা কিন্তু একেবারে বানের জলে ভেসে যাওয়ার মতো নয়। তাই রোদটা তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পানি পানের বিরতির পর থামা হয়নি সেভাবে। আজ সবাই একসঙ্গে। কয়েকটা ছোট লোকালয় পড়েছিল কিন্তু বিরতি দেওয়া হয়নি। সামনে বাস থামে, এমন একটা জায়গার কথা জেনেছিলাম। হিসাব অনুযায়ী, আর ২০ কিলোমিটার পর পাওয়ার কথা। আমরা আজ আসলেই ভালো চালিয়েছি। ৫০ পার হয়ে গেছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই। কিন্তু সব কৃতিত্ব রাস্তার। নামা না হলে এতটা পারা যেত না। যে ভয় আমরা করছিলাম, তা থেকে বাঁচা গেছে আপাতত। সামনে কী আছে, বলা যাচ্ছে না। কিন্তু হয়ে যাবে বাকিটা। এ পর্যন্ত দারুণ হলো।

রাস্তা থেকে লাল রঙের দালানটা চোখে এল। এটাই বাসের বিরতির জায়গা হবে। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বাসগুলোকে ওখানেই ঢুকে যেতে দেখছি। বলে রাখা ভালো, এই বাসগুলো আমাদের বাসের মতো বড় না। সবচেয়ে বড়টা আমাদের মিনিবাসের সমান। এর সংখ্যা কম। বেশি হলো মাইক্রোবাস। কিন্তু সব কটি ঝাঁ-চকচকে। হয় একেবারে নতুন, নয়তো দারুণ যত্ন নেওয়া। ইউরোপিয়ান গাড়ি বেশি, যেমন মার্সিডিজ, রেনোঁর মাইক্রোবাস বেশি। জাপানি গাড়ি আছে, তবে কার-জাতীয়। কংক্রিটের খোলা চত্বর। অনেক গাড়ি। প্রথমবারের মতো এত গাড়ি আর মানুষ একসঙ্গে দেখা হচ্ছে মাদাগাস্কারে। একটা বড় রেস্তরাঁ, তার সঙ্গে লাগানো থাকার হোটেল। আমরা যখন খুঁজছিলাম, গুগল আমাদের এই হোটেলের কথা বলেনি। যদি বলত, তবে হয়তো আমাদের পরিকল্পনা অন্য রকম হতে পারত। গতকাল আমরা এখানে আসতে পারতাম বা চেষ্টা করা যেত।

গরমের ভয়াবহতা টের পাওয়া যাচ্ছে। সাইকেল রেখে রেস্তরাঁয় যাওয়ার সাহস হলো না। গাছের নিচে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। খাবার কিনতে গেল চঞ্চল। এক টুকরি কলা নিয়ে বসে আছে একজন। নেওয়া হলো। সঙ্গে চঞ্চলের কিনে আনা কেক। পথে ‘বাংলো মোটিফ লজ’ বলে একটা থাকার জায়গা পড়বে। বিবরণ দেওয়ায় জানা গেল, আর ছয় থেকে সাত কিলোমিটার হবে। নামা পথ। খুশিই হলাম। এখানে সময় নিয়ে কার্পণ্য করার কিছু নেই আর। গন্তব্যে চলেই এসেছি। হেলাফেলায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিয়ে যখন শুরু করলাম, তখন তিনটার বেশি বাজে। রোদের তেজ কমেছে। আয়েশ করে শেষ পথটুকু চলে এলাম আধঘণ্টায়। কিন্তু হোটেল খুঁজে পাচ্ছি না, হোটেলটা কোথায়? (চলবে)