নিঃসঙ্গতাকে আরও উপভোগ্য করে যে সৌন্দর্য

তুষারঢাকা পর্বতচূড়াছবি: লেখক

ভোরের আলো ফোটার আগেই কাঠমান্ডু থেকে বেসিসাহারের বাসে চেপে বসি। গন্তব্য—হিমালয়ের কোলের ছোট্ট গ্রাম মানাং। জানালায় একটু পরই উঁকি দেয় হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বতচূড়া।

আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে বাস চলছে। যেদিকে তাকাই, বিশাল সবুজ পাহাড়ে দৃষ্টি আটকে যায়। আর সেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে ভেসে বেড়ায় সাদা সাদা মেঘ। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নীল জলের পাহাড়ি নদী ত্রিশূলী।

বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাই বেসিসাহার। সেখানে রাতটা কাটিয়ে সকালে উঠেই আসল গন্তব্য মানাংয়ের পথে রওনা হতে হবে। সন্ধ্যায় হোটেলের ছাদে উঠে দেখি, সেখানেও চারদিকে বিশাল বিশাল পাহাড়। চূড়া এতটা উঁচু যে মেঘ ফুঁড়ে আর দেখা যায় না। এসব পাহাড়ের গায়ে বিন্দু বিন্দু আলো। হয়তো দূরের কোনো বাড়িঘর বা গ্রাম। ঘুরতে আসার সময় চিন্তা ছিল যে একা আসায় খারাপ লাগবে। কিন্তু এসে বুঝলাম, এখানকার সৌন্দর্য নিঃসঙ্গতাকে আরও উপভোগ্য করে।

শ্বেতশুভ্র পর্বতের পাশেই মানুষের বসতি
ছবি: লেখক

পরদিন ভোরবেলা উঠে রওনা হই। সারা দিনে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পাহাড়ি অফরোড। পুরোটা পথের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ত্রিশূলীর উপনদী মারসিয়ান্দি, গণ্ডকী। এই পথে কিছু দূর যেতেই দেখি, মাথা উঁচু করে স্বাগত জানাচ্ছে হিমালয়ের পর্বতশ্রেণি। পথের দুই ধারের পাহাড় থেকে ঝরনার পানি এসে পড়ছে রাস্তার ওপরে। তার মধ্য দিয়েই গাড়ি চলছে। কখনো পাহাড়ের গা ঘেঁষে একেবারে সরু রাস্তায়ও চলছে। মনে কখনো রোমাঞ্চ, কখনো আবার এই দুর্গম পথ দেখে ভয়ও উঁকি দিচ্ছিল।

প্রথমবার পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতগুলো দেখার বিস্ময় নিয়ে সন্ধ্যায় পৌঁছাই মানাং। কিন্তু আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। লজের উঠান থেকে উপত্যকার ওপাশেই দেখা যাচ্ছে অন্নপূর্ণা আর গঙ্গাপূর্ণার চূড়া।

পরদিন সকালে ট্রেকিংয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লজ থেকে বের হয়ে মারসিয়ান্দি পার হয়ে দেড় ঘণ্টা পাহাড়ে উঠলেই চোংকর। এই ভিউ পয়েন্ট থেকে পুরো মানাং উপত্যকা, গ্রাম, আশপাশের অনেক পর্বতচূড়া আর গঙ্গাপূর্ণা হিমবাহ দেখা যায়। শীতকাল তাই পর্যটক খুবই কম। প্রায় এক ঘণ্টা একা হাঁটার পর দেখি, নিচ থেকে আরও দুজন পর্যটক আসছেন। তাঁদের জন্য অপেক্ষা করি। কাছাকাছি এলে কিছুক্ষণ কথা বলে তাঁদের দেশ আর ঘোরাঘুরির গল্প শুনলাম, জানালাম আমার দেশের কথা। নেইস আর এলসা নামের এই দুই ডাচ পর্যটকের সঙ্গে বেশ একটা আড্ডা দিয়ে আবার এগোলাম নিজের পথে।

মানাংয়ের সৌন্দর্য নিঃসঙ্গতাকে আরও উপভোগ্য করে
ছবি: লেখক

চোংকর ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে পেলাম একটি চায়ের দোকান। কিন্তু পর্যটক তেমন নেই বলে বন্ধ। না থেমে তাই আরও উঠতে থাকি। এই পথেই পেলাম দুটি গুম্ফা। এদিক-সেদিক পাথরের ছোট কুটির, যেখানে থাকে রাখালেরা। ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখতে পাওয়া পাহাড়গুলোর গায়ে দেখলাম অসংখ্য গুম্ফা। সেখান থেকে আরও একটু এগোতেই দেখি, পাইনবনের ভূমিজুড়ে জমে আছে সাদা, শক্ত বরফ। এরপর যত এগোতে থাকি, বরফও বাড়তে থাকে। তবে পিচ্ছিল শক্ত বরফে হাঁটা খুব একটা নিরাপদ না বলে আবার নামার পথ ধরি।

নামার পথে বেলজিয়ান পর্যটক জুলিয়ানের সঙ্গে পরিচয়। জানতে পারলাম, পরদিনই সে আইস লেক পর্যন্ত ট্রেক করবে। আমারও একই পরিকল্পনা। ঠিক করলাম, দুজন একসঙ্গে যাব। পাইন বন, দৈত্যাকার পাহাড় আর অপরূপ সুন্দর উপত্যকা দেখতে দেখতে দুপুরে লজে ফিরে এলাম।

মানাংয়ে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

বিকেলে মানাং গ্রামটা ঘুরে দেখতে ডাচ বন্ধু নেইসের সঙ্গে বের হলাম। মানাংয়ের মাঝ দিয়ে পাথরের একটা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে সব টুরিস্ট লজ। একটা সিনেমা হলও পেলাম। মূল রাস্তাটা থেকে অনেক সরু গলি ওপরে উঠেছে বা নিচে নেমেছে। এদিকে স্থানীয় লোকদের বসতি। গ্রামের সব বাড়ি পাথর ও কাঠের তৈরি। বেশির ভাগ বাড়িই তিনতলা। শীতকালে যখন সবকিছু তুষারে ঢেকে যায়, বাড়ির নিচতলায় এসে ঠাঁই নেয় গবাদি চমরী গাই আর ছাগলের পাল। দ্বিতীয় তলায় থাকে মানুষ আর তৃতীয় তলায় গবাদিপশুর জন্য জমা করা খাবার।

সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করলে তুষারঢাকা পর্বতচূড়া হয়ে ওঠে আগুনরাঙা। দ্রুত কমতে থাকে তাপমাত্রা। শীত বাড়তে থাকায় আমরা লজে ফিরে যাই। পথে দেখি, উপত্যকার সমতল অংশ থেকে শত শত ছাগল, চমরী গাই আর ঘোড়ার পাল নিয়ে ফিরছে রাখালেরা। পশুগুলোর গলায় বাঁধা ঘণ্টার ধাতব মিষ্টি শব্দ সন্ধ্যা-নামা পরিবেশে অদ্ভুত এক মূর্ছনা তৈরি করে।

এখানকার সব লজেই একটা কমন ডাইনিং স্পেস থাকে, যেখানে আগুন জ্বেলে ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা থাকে। আমরা সেখানে গিয়ে বসি। নানা দেশের ট্রেকারদের সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠে। রাতের খাওয়া শেষ হলে সবাই যার যার রুমে চলে যায়। আমি একা থেকে যাই। হোটেল মালিক আর স্টাফরা তাদের সঙ্গে আবার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে আরেক দফা খেতে বসি। বাকহুইটের গুঁড়ার তৈরি প্যানকেকের মতো একধরনের রুটির সঙ্গে চমরী গাইয়ের মাংস আর মরিচভর্তা, মাখন দিয়ে তিব্বতীয় বাটার-চা ছিল তাঁদের রাতের খাবারে।

মানাং গ্রামের মূল রাস্তা
ছবি: লেখক

পরের সকালে বেলজিয়ান বন্ধু জুলিয়ানের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। মানাং থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচুতে উঠতে হবে। পাশের গ্রাম ভ্রাকা পার হয়ে অর্ধেক পথ ওঠার পর উচ্চতাজনিত অসুস্থতায় শুরু হয় মাথাব্যথা। তাই সেখানে জুলিয়ানকে বিদায় জানিয়ে আবার ভ্রাকায় নেমে আসি। ঘুরে দেখি পুরো গ্রাম।

দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লজের ছাদে কাটিয়ে দিই, বিশাল অন্নপূর্ণার সামনে সূর্যাস্ত দেখি। সূর্য ডোবার সময়ে বরফ-ঢাকা পর্বতচূড়ার রং যেভাবে বদলাতে থাকে সে দৃশ্য অপূর্ব!

রাতের খাবার খেয়ে চলে যাই জুলিয়ানের লজে। সেখানে একসঙ্গে ফুটবল ম্যাচ দেখার দাওয়াত আছে।

পরদিন সকালেই আবার বেসিসাহার। তারপর কাঠমান্ডু হয়ে ঢাকা। মানাং গ্রামে হিমালয়ের যে মোহনীয় রূপ আর তিব্বতীয় আতিথেয়তা পেয়েছি, তাতে ফেরার সময়ই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি অন্নপূর্ণার কাছে কোনো গ্রামে আবার আসব।