২০০০ কিলোমিটার ট্রেনযাত্রায় পার হয়েছি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেলস্টেশন, শত শত টানেল, গিরিপথ

চীনের জিনিং থেকে তিব্বতের লাসা দুই হাজার কিলোমিটার। দীর্ঘ এ যাত্রায় কখনো কখনো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুটেরও বেশি ওপর দিয়েও চলল ট্রেন। যেতে যেতে পেরোতে হলো শত শত টানেল, গিরিপথ, বরফে ঢাকা মালভূমিসহ কত কী। সেই গল্পই শোনাচ্ছেন এলিজা বিনতে এলাহী

প্রকৃতি দেখতে দেখতেই খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহীর সৌজন্যে

ঢাকা থেকে কুনমিং, কুনমিংয়ে রাত কাটিয়ে পরদিনই ফ্লাইটে আবার জিনিং। প্লেন থেকে নেমেই রেলওয়ে স্টেশনে চলে যাই। সেখানে আমাদের তিব্বত পারমিট চেক করা হলো। এরপর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। যাত্রীদের বসার জায়গাটা সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। আয়তনও চোখে পড়ার মতো। চারদিকে নানা ধরনের খাবারের দোকান। যাত্রীদের অনেকে খাবার কিনছেন। শুনেছি ট্রেনে খাবারের খুব বেশি বিকল্প নেই, প্রত্যেকেই তাই সঙ্গে কিছু খাবার নিচ্ছেন। আমার ব্যাগে খেজুর, চকলেটবার, বাদাম আছে। দলের তন্দ্রা আপা পাউরুটি আর কলা কিনে নিলেন।

এরই মধ্যেই বোর্ডে লেখা এল, লাসাগামী ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে ভিড়েছে। দোতলা থেকে নিচতলায় নেমে দেখি জনশূন্য প্ল্যাটফর্ম। প্রতিটি কম্পার্টমেন্টের দরজার সামনে একজন করে গার্ড। ওভারকোট ও হ্যাট পরা। মনে হচ্ছিল বিশ শতকের কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য।

আমাদের ৫ নম্বর কোচের গার্ড একজন নারী। তিনি তিব্বত পারমিট, পাসপোর্ট চেক করে আমাদের কোচে উঠতে বললেন। একটি কোচে চারজনের শোবার ব্যবস্থা। ওপরে দুটো, নিচে দুটো। তবে বাক্স-পেটরা রাখার জায়গা কম। মনে মনে বলি, এত উঁচু দিয়ে ট্রেন যাবে, যা জায়গা আছে এতেই শুকরিয়া!

বাংলাদেশ থেকে আমরা দুটি দল তিব্বত ভ্রমণে যাচ্ছি। আমার দলে ৭ জন, অন্যটিতে ১৫ জন। দুটি দলেরই দায়িত্বভার নিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হোসেন ও আইরিন হোসেন।

ট্রেনে লেখক
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহীর সৌজন্যে

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। গতি ধীর। সব গুছিয়ে বসতে বসতেই মিনিট বিশেক পার। এরই মধ্যে প্রায় পাঁচটি বড় বড় টানেলের ভেতর দিয়ে গেল ট্রেন। এর পর থেকে কখনো গতি বাড়ে, কখনো কমে। গতি ধীর হলেই বুঝতে পারি ট্রেন উঁচুতে উঠছে। পর্বতমালার বুক চিরে চলেছে ট্রেন। কাচের জানালা দিয়ে উপভোগ করছি তিব্বত মালভূমি। কখনো ধূসর পাহাড়, কখনো গুল্ম, আবার গাছপালাহীন পাহাড়। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় এসব পাহাড়। কখনো হলুদ, কখনো লালাভ। আকাশের দিকে তাকালে মন ভরে যায়। নীল আকাশ। মেঘ নেই। মাঝেমধ্যে বরফে মোড়ানো পাহাড় উঁকি দিচ্ছে। হিমবাহ গলে হ্রদে পড়ছে। ইয়াকের পাল মুখ গুঁজে ঘাস চিবোচ্ছে। ঘাস কোথায়, এ তো তৃণভূমি। ছেলেবেলায় রুশ উপন্যাস আর সেবা প্রকাশনীর বইতে পড়া বিস্তীর্ণ স্তেপ-অঞ্চল। কত পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট চলছে। সারি সারি উইন্ডমিল। কিন্তু মনভরে ক্যামেরায় মুহূর্ত বন্দী করতে পারছি না। ক্যামেরা রেডি করতে করতেই মিলিয়ে যাচ্ছে সেই দৃশ্য। প্রকৃতির এই মোহময় রূপ কদাচিৎ দেখা যায়।

দেখতে দেখতেই চারদিকে অন্ধকার নেমে এল। নিজেদের ছবি তোলা ছাড়া তখন আর কাজ নেই। না, না, কাজ আরও দুটো আছে—রাতের খাওয়া আর শোবার আয়োজন। টুকটাক সবার কাছে যা ছিল, সেগুলোই ভাগ করে খেলাম। ট্রেনের টিকিটের সঙ্গে খাবার যুক্ত করা যায়, সেই সুবিধা আমরা নিইনি।

ট্রেনে করে চীন থেকে তিব্বতে যেতে যেতে দেখা মেলে এমন মালভূমি
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহী

দুই দিন আগে ঢাকা থেকে বেরিয়েছি। সবাই ক্লান্ত। খেয়েদেয়ে দ্রুতই শোবার আয়োজন করলাম। আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে ওপরে। সন্ধ্যা অবধি ট্রেনটা কেবল একটি স্টেশনে থেমেছে। তারপর গতির ভিন্নতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মন পড়ে আছে টাংগুলা রেলওয়ে স্টেশনে। এ পথেই পড়বে ১৬ হাজার ফুটেরও বেশি উঁচুতে অবস্থিত রেলস্টেশন!

ঘুম আসছে না। কিছুটা শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য মাথাব্যথাও আছে। উচ্চতায় এই দুই উপসর্গ খুব স্বাভাবিক। অতি উচ্চতার জন্য ট্রেনে কৃত্রিম অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে, অবস্থা অতটাও খারাপ নয় যে অক্সিজেন সাপোর্ট লাগবে। স্বাভাবিক হতে তাই বিছানায় উঠে বসলাম। মিনিট কয়েক পর শ্বাস স্বাভাবিক হলো। কখন জানি ঘুমিয়েও পড়লাম। 

স্টেশনে কোনো কর্মী নেই

টাংগুলা স্টেশন
ছবি: উইকিপিডিয়া

রাত তিনটায় আচমকা ঘুম ভাঙল। দেখি টাংগুলা স্টেশনে ট্রেন থেমে আছে। আগেই বলেছি, সমুদ্র সমতল থেকে ৫ হাজার ৬৮ মিটার বা ১৬ হাজার ৬২৮ ফুট উঁচুতে এই স্টেশন। শুনেছি এই স্টেশনে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। সত্যতা যাচাই করতে পারিনি। আলোতে একদম ঝলমল করছে স্টেশন। ট্রেন থেকে কেউ কেউ নেমে দাঁড়িয়েছেন, ছবি তুলছেন। আমি উবু হয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে স্টেশনটি দেখছি আর ছবি তোলার চেষ্টা করছি। রাত তিনটায় কামরার সবাইকে জাগিয়ে নামাটা ঠিক হবে না। আবার নামতে পারছি না ভেবে মনে মনে সুজন আর আইরিনকে বকাঝকা করছি, আমাকেই কেন ওপরের সিট দেওয়া হলো। আর আমিও কেন সিট বদল করিনি। নিজের বোকামির কথা ভাবছি আর দেখছি স্টেশন ত্যাগ করছে ট্রেন।

ভোরের আলো ফুটতে আরম্ভ করল। আমাদের কামরার পাশেই রেস্টরুম আর মুখ ধোওয়ার ব্যবস্থা। ফ্রেশ হয়ে বসে বসে বাইরে তাকিয়ে আছি। মাঝেমধ্যে বসতি চোখে পড়ল। দ্বিতল ছোট ছোট বাড়ি। বাড়িগুলো একই আকৃতির। একসময় ট্রেন এসে থামল একটি স্টেশনে। নাম ‘ইয়াং বা জিং’। এরও উচ্চতা ৪ হাজার ৩০৫ মিটার।

দুপুর ১২টার দিকে আমরা দুপুরের খাবারের জন্য খাবার গাড়িতে গেলাম। মেনু থেকে এক বাটি ভাত, সবজি, মুরগি আর মাছ অর্ডার করলাম। খানা শেষ হওয়ার ঘণ্টা দেড়েক পর জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম দু-একটা আধুনিক দালান। খুশিতে সবার চোখ চকচক করে উঠল। লাসার কাছেপিঠে চলে এসেছি।

লাসা রেলস্টেশনে লেখক
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহীর সৌজন্যে

ট্রেনে জিনিং থেকে লাসা আসতে আমাদের লাগল সাড়ে ২১ ঘণ্টা। ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ট্রেনযাত্রায় পার হতে হয়েছে প্রায় ৭০০ টানেল। এর কোনো কোনোটা ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। পার হয়েছি বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল টানেল ফেঙ্গুওশান। এর উচ্চতা ৪ হাজার ৯০৫ মিটার। তিব্বতের গড় উচ্চতা ১১ হাজার ফুটের মতো। আর ভূপৃষ্ঠ থেকে লাসা রেলস্টেশনের উচ্চতা ১১ হাজার ৯৪৫ ফুট!

লাসায় ট্রেন থেকে নামার পর উত্তরীয় পরিয়ে স্বাগত জানাল স্থানীয় ট্যুর কোম্পানির স্বত্বাধিকারী পিটার। লাসায় প্রবেশ করেই অনুভব করলাম, ছিমছাম, নিঃশব্দ ও পরিচ্ছন্ন এক শহর।

আরও পড়ুন