ঐতিহ্য
এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করে আনেন, তারপর কুস্তি খেলেন
তিন গ্রামের মানুষ মিলে দাওয়াত করে আনলেন পাশের দুই গ্রামের মানুষ। তারপর তাঁরা মাঠে নামলেন কুস্তি খেলতে। ফল যা–ই হোক, উৎসব হলো বেশ! হাওর অঞ্চলে খেলাটা ‘দাওয়াতি কুস্তি’ নামে পরিচিত। সুনামগঞ্জ সদরের বড়ঘাট গ্রামের এমন এক কুস্তির আয়োজনে দাওয়াত পেয়েছিলেন খলিল রহমান
কয়েক দিন আগেই দাওয়াত পেয়েছি। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বড়ঘাট গ্রামে দাওয়াতি কুস্তির আয়োজন আছে। বড়ঘাটে খেলা হলেও তাঁদের সঙ্গে পুরান লক্ষণশ্রী ও কুতুবপুর গ্রামের মানুষও এককাট্টা। তিন গ্রাম মিলে দাওয়াত করেছে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা ও দুর্গাপুর গ্রামের মানুষদের। মাঠে এই পাঁচ গ্রামের কুস্তিগিরেরা আনন্দের লড়াই করবেন।
২৫ সেপ্টেম্বর। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম বড়ঘাট গ্রামে। খেলা তখনো শুরু হয়নি। তবে মাঠের চারদিকে হাজারো দর্শকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। খেলা দেখতে জড়ো হয়েছেন আশপাশের অন্তত ১০ গ্রামের লোকজন। শহর থেকেও এসেছেন পরিচিত কেউ কেউ।
মাথার ওপর কাঠফাটা রোদ। উৎসবের আনন্দের কাছে রোদ অবশ্য দর্শকদের কাবু করতে পারছে না। অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ কেউ বসেছেন ঘাসের ওপর। মাঠের দুই কোনায় দুই দলের খেলোয়াড় আর সমর্থকেরা।
খেলা শুরুর ঘোষণা হতেই দুদিক থেকে দুজন কুস্তিগির মাঠে প্রবেশ করলেন। তাঁদের ডান হাতে নতুন গামছা। গামছাটা তুলে নেচে নেচে এগোতে থাকলেন তাঁরা। পেছন থেকে উল্লাসধ্বনিতে মাতলেন সমর্থকেরা। মাঠে প্রবেশ করে মানিত আমিনদের কাছে গেলেন দুই প্রতিযোগী। যাঁরা খেলা পরিচালনা করেন, তাঁদের বলা হয় ‘মানিত আমিন’। সবাই মান্য করে বলেই এমন নাম। আমিনদের অনুমতি পেতেই ‘তলা’য় চলে গেলেন প্রতিযোগী দুজন। মাঠের যে অংশে লড়াই হয়, সে জায়গাকে বলে ‘তলা’। আর কুস্তিগিরদের বলা হয় ‘মাল’।
আমিনদের ইশারায় শুরু হয় লড়াই। ঘুরে ঘুরে দুই কুস্তিগিরকে পর্যবেক্ষণ করেন তিন আমিন। এক মিনিট, দুই মিনিট করে পাঁচ মিনিট ধরে চলে লড়াই। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে বিজয়ী হয় বড়ঘাট গ্রামের প্রতিযোগী। রঙিন গামছা উঁচিয়ে নেচে নেচে চারপাশ ঘুরে উল্লসিত দর্শকদের অভিনন্দন জানান জয়ী কুস্তিগির।
এভাবে একে একে দুই পক্ষের খেলোয়াড়েরা মাঠে নামলেন। কখনো জয়ী হলো দুর্গাপুর, কখনো কুতুবপুর। আবার নির্দিষ্ট সময়ে খেলা শেষ করতে না পারায় ড্র–ও হলো।
প্রথম পর্বের খেলা শেষ হতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। দর্শকদের মধ্যে চরম উত্তেজনা। মাঠে শলাপরামর্শ করে দাগা বা চূড়ান্ত পর্বের ঘোষণা করলেন আমিনেরা। নড়েচড়ে বসল দর্শক। চূড়ান্ত পর্বে ২ পক্ষের ১০ জন কুস্তিগির অংশ নিলেন। মোক্ষম লড়াই হলো, তবে জিতল সবাই! কারণ, ফলাফল ড্র।
কাইউমও খেলতেন
বড়ঘাটে সুনামগঞ্জের জলিলপুর গ্রামের আবদুল কাইউমের সঙ্গে দেখা। বয়স ৬০ বছর। একসময় কুস্তি খেলেছেন। এখন দুই ছেলে কামরুল ইসলাম ও ময়না মিয়া কুস্তিগির। তাঁদের খেলা দেখতেই তিনি এসেছেন। ‘মাল’ হিসেবে কামরুল ইসলামের নাম জেলার আমুদে দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে। তাই ছেলেকে নিয়ে গর্বিত আবদুল কাইউম। আলাপের সময় যৌবনে ফিরে গেলেন তিনি। গল্পে গল্পে বললেন, তাঁদের সময়ে কুস্তি খেলায় মজা ছিল বেশি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই গ্রামে বৈঠক হতো, দাওয়াতি লোকজনের খাওয়াদাওয়া ও থাকা এসব নিয়ে আলোচনা হতো। গ্রামবাসী চাঁদা তুলে গরু কিনতেন। সেই গরু জবাই করে মাংস বিতরণ করা হতো বাড়ি বাড়ি। দাওয়াতি লোকজনকে ভাগ করে সেসব বাড়িতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। রাতে বসত আড্ডা, গল্পের আসর। অন্য রকম আনন্দ ও উত্তেজনা ছিল। তখন নৌকাই ছিল যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন। নৌকা নিয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যেতে হতো। এখন সবখানেই সড়ক হয়ে গেছে। সহজেই যাতায়াত করা যায়। এ কারণে রাতযাপনের বিষয়টি কমে গেছে।
সেদিন খেলা শেষে ১০ গ্রামের মানুষের আড্ডা হয়েছে। অস্থায়ী দোকানগুলোতে বিক্রিও হয়েছে দেদার। বিদায়বেলায় বিশ্বম্ভরপুরে শক্তিয়ারখলা ও দুর্গাপুর গ্রামের মানুষেরা ফিরেছেন হাসিমুখে। এখন তাঁদের দাওয়াতে যাবেন বড়ঘাট, পুরান লক্ষণশ্রী আর কুতুবপুর গ্রামের মানুষ। শত বছরের আয়োজনটা এভাবেই হাওরপাড়ের মানুষদের এক করে রাখছে।
দাওয়াতি কুস্তি
‘সমানে সমানে দোস্তি, সমানে সমানে কুস্তি’Ñসুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় কথাটি বেশ প্রচলিত। হাওরপাড়ের মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ধরে রাখতে বহুকাল থেকে এক গ্রামের মানুষ আরেক গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করে আনেন। শত শত মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন তাঁরা। তারপর কুস্তি খেলেন। স্থানীয়ভাবে যাকে বলে ‘দাওয়াতি কুস্তি’। এ যেন অন্য রকম এক উৎসব।
সুনামগঞ্জ এক ফসলি বোরো ধানের জেলা। তাই বোরো ধান তোলার পর যখন বর্ষা আসে, তখন মানুষের তেমন কোনো কাজ থাকে না। প্রায় ছয় মাস তাঁদের অনেকটা বেকার সময় কাটে। তখন গ্রামে গ্রামে গানের আসর হয়, চলে হাডুডু আর কুস্তি খেলা। অবশ্য এসব আনন্দ-আয়োজন নির্ভর করে হাওরের বোরো ফসল নির্বিঘ্নে গোলায় তোলার ওপর। যে বছর ফসল ভালো হয়, সেই বার উৎসব হয় বেশি।