একজন বিশ্ব পরিব্রাজকের নাম বলুন তো? এই প্রশ্ন করলে আমাদের এখানে যে কেউ উত্তর দেবেন, ইবনে বতুতা।
ভাবতে শিহরণ লাগছে, সেই বতুতার রাজ্যে যাচ্ছি। পরিব্রাজক যে পথ দিয়ে হেঁটেছেন, সেই পথ দিয়ে হাঁটব।
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার বাজারে বিশ্বভ্রমণ ভীষণ কঠিন হয়ে উঠছে। তার ওপর উড়োজাহাজের খরচা আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। প্রায় মাস তিনেক ধরে নিজের ভেতর জল্পনাকল্পনা চলেছে। মরক্কোর বিভিন্ন ট্রাভেল কোম্পানির সঙ্গে নিয়মিত কথা চলছে। আর মাঝেমধ্যে নিজের ওপর খালি রাগ হচ্ছিল, কেন ইউরোপে থাকার সময় এই সুযোগ হাতছাড়া করেছি। স্পেনের একেবারে কাছেই তো মরক্কো।
ঢাকার মরক্কো দূতাবাস থেকে ভিসা পেতে পাক্কা ২১ দিন লাগল। অথচ ভেবেছিলাম, ৭ দিনের বেশি লাগবে না। কারণ, দূতাবাসের সামনে পর্যটকের কোনো ভিড় ছিল না। কাকপক্ষীর অবস্থানও দেখতে পাইনি ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার সময়।
প্রায় ভোররাতে ফ্লাইট। ট্রানজিট আর আকাশে ভেসে বেড়ানোর সময় মিলে ২১ ঘণ্টা পর সকাল সাতটায় ক্যাসাব্লাঙ্কা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। দুই মিনিটে ইমিগ্রেশন পার। ইমিগ্রেশন অফিসার কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না।
ছিমছাম সাদামাটা এয়ারপোর্ট। লাগেজ হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে খুদে বার্তা, ‘ওয়েলকাম টু মরক্কো, আই অ্যাম ইয়োর ড্রাইভার। মাই নেম ইজ ইব্রাহিম, আই অ্যাম ইন দ্য পার্কিং লট।’ বাইরে বেরিয়ে চোখে পড়ল আরবি ঘোড়ার দারুণ একটি ভাস্কর্য। কোঁকড়া চুলের ছোটখাটো উচ্চতার ফরসা এক তরুণ এগিয়ে এসে অভিবাদন জানালেন। ইনিই ইব্রাহিম।
অন্য আফ্রিকা
ছোটবেলা থেকে আফ্রিকা বলতে ঘন জঙ্গল, হিংস্র প্রাণী আর কালো চামড়ার জনমানবের একটা চিত্র আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। জঙ্গল আর প্রাণীর কথা কারও মনে থাকুক আর না থাকুক, কালো চামড়ার জনপদ আফ্রিকা মহাদেশ, এটি আমাদের মনে গেঁথে গেছে। এই ভূখণ্ডে এসে কিন্তু একেবারেই অনুভব করা যায় না, আপনি আফ্রিকার কোন জনপদে পরিভ্রমণ করছেন।
আমাদের আজকের গন্তব্য তানজিয়ার। পথে কোথাও সকালের নাশতা সেরে নেব, এমনটিই বললেন ইব্রাহিম। আগামী ১০ দিন ইব্রাহিমের সঙ্গেই পথচলা হবে। মরক্কোর রাউন্ড রোড ট্রিপ! ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে শুরু করে ৯টি শহর পেরিয়ে আবার ক্যাসাব্লাঙ্কায় এসে শেষ হবে।
মনে মনে ভাবছি, বিশ্ব পরিব্রাজকের শহরকে আমার লেখনীতে কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারব! তারপর মনে হলো, আরেক বিশ্ব পরিব্রাজক রামানাথ বিশ্বাসের কথা। অন্ধকারের আফ্রিকা গ্রন্থে তিনি লিখেছেন ‘আমার কাজ ভাষার পাণ্ডিত্য জাহির করা নয়, অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা।’ তা–ই তো!
জিপ ছুটছে। ক্যাসাব্লাঙ্কা এয়ারপোর্ট থেকে তানজিয়ার শহরের দূরত্ব ২৯০ কিলোমিটার, বললেন ইব্রাহিম। বেশ ভালো ইংরেজি বলেন ইব্রাহিম। পথিমধ্যে সকালের নাশতা করার জন্য থামা হলো। কী ধরনের নাশতা করতে চাই, জানতে চাইলেন ইব্রাহিম, মরক্কান নাকি কন্টিনেন্টাল? অবশ্যই স্থানীয়।
নাশতা এল। দুই–তিন ধরনের রুটি। সব কটিকে আমাদের মতো হাতে বেলা রুটি বলা যাবে না। একটি বেক করা, কিছুটা শক্ত মনে হলো। সঙ্গে এল পনির, মাখন, অলিভ অয়েল, সেদ্ধ কালো অলিভ। আলাদা একটি বাটিতে সাদা তরল একটি পানীয়। ইব্রাহিম বললেন, স্যুপ। খেয়ে দেখলাম। একদমই মজা না। আমার খাদ্য গ্রহণের ধীরগতি দেখে ইব্রাহিম বললেন, হারচা আর অলিভ অয়েল দিয়ে মিশিয়ে খেতে। হারচা হলো শক্ত রুটিটা। রুটির সঙ্গে অলিভ অয়েল! বুঝলাম, সামনে ১১ দিন বেশ কাটবে! কফি, পুদিনা চা আর কমলার জুস একসঙ্গে দেওয়া হলো। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব!
পথ বেশ মসৃণ। জিপ ১০০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে। চারদিক দেখছি, ছবি তুলছি, ভিডিও করছি। ২১ ঘণ্টার ফ্লাইটে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। একসময় কখন জানি চোখ বুজে এল।
বতুতার খোঁজে
ইব্রাহিমের ডাকে চোখ খুলল। ঘণ্টা তিনেক পর একটি উঁচু দেয়াল ঘেরা স্থানে এসে দাঁড়ালাম। ইব্রাহিম বললেন, ‘এখন আপনাকে একা হেঁটে যেতে হবে।’ এর বেশি গাড়ি নেওয়ার অনুমতি নেই। একটি মসজিদের কেন্দ্রে রয়েছে বতুতার সমাধি। তানজিয়ারে আমার একমাত্র কিংবা প্রথম গন্তব্য ইবনে বতুতার সমাধি শুনে তিনি বেশ অবাক হচ্ছিলেন।
আমার জিপটি আসলে তানজিয়ারের পুরোনো শহরের প্রবেশদ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো শহরকে এরা বলে মেদিনা। শহরটি উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। সেখান থেকে হেঁটে ইবনে বতুতা সড়কে যেতে হবে। গাইড নিয়েও যাওয়া যায়। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম, একাই যাব। শহরটিকে একটু বোঝা দরকার। গুগল ম্যাপ আর পথচারীরাই পথ দেখালেন। বেশ সরু একটি গলিতে প্রবেশ করলাম। চারদিকে দোকান, রেস্তোরাঁ আর হোটেল। ভ্রমণরচনায় পড়েছি, টিলার ওপর তাঁকে সমাহিত করা হয়েছিল। উঁচু–নিচু পথ দেখে অনুমান করতে পারছি, টিলা কেটে কেটে পথগুলো তৈরি করা হয়েছে। পথে যাঁকেই জিজ্ঞাসা করছি, তিনিই বলছেন, সামনে। অবশেষে একটি মসজিদের সামনে এসে পৌঁছালাম।
মসজিদে প্রবেশের আগেই দেয়ালে ইবনে বতুতার নাম লেখা। সাদা আলখেল্লাধারী একজন এসে আরবিতে কী যেন বললেন। আমি বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম। তারপর ভদ্রলোক নিজেই বললেন, ‘নো অ্যারাবিক! ইংলিশ! ইংলিশ!’ তর্জনী দিয়ে একটি বন্ধ ঘর দেখিয়ে দিলেন। ভেতরে প্রবেশ করতে নিষেধ করলেন। ইশারায় আমাকে ছবি তুলতেও নিষেধ করলেন। আর কোনো পর্যটককে দেখতে পেলাম না। ছবি তোলা বারণ, এ রকম অনেক জায়গায় অনুরোধ করে আমি ছবি তুলেছি। কিন্তু এখানে কেন চুপ থেকেছি, জানি না। আসলে ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিবন্ধকতা অনুভূত হচ্ছিল বোধ হয়। প্রিয় পরিব্রাজকের সমাধি দেখে ফিরে এলাম। সমাধিটি মসজিদের ভেতরে এবং সবুজ কাপড়ে ঢাকা।
হেঁটে মেদিনা দেখতে দেখতে জিপের কাছে এলাম। ইব্রাহিম বললেন, এবারের গন্তব্য হারকিউলিসের গুহা!