হিমালয়ে সাঁতার–সাইক্লিং–দৌড়ের কঠিন চ্যালেঞ্জ জয় করলেন দুই বাংলাদেশি

হিমালয়ান এক্স–ট্রাইয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন শামসুজ্জামান আরাফাত
ছবি: সংগৃহীত

এক্স দিয়ে বোঝানো হয়েছে এক্সট্রিম, আর ট্রাই মানে ট্রায়াথলন। দুটো মিলে এক্স–ট্রাই। সাঁতার, সাইক্লিং আর দৌড়ের সমন্বয়ে যে ক্রীড়া, সেটিই ট্রায়াথলন। ট্রায়াথলনের কঠিনতম পর্ব হলো আয়রনম্যান। আর এই আয়রনম্যান প্রতিযোগিতারই এক্সট্রিম বা চরম রূপ হলো এক্স–ট্রাই। বিশ্বের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে এই এক্স–ট্রাইয়ের আয়োজন করা হয়। তাই দূরত্বটাই শুধু পার হতে হয় না, সঙ্গে বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গেও চলে যুদ্ধ। নিজের শারীরিক সামর্থ্যের পুরোটাই ঢেলে দিতে হয়।

নেপালের হিমালয় পর্বতমালার অন্নপূর্ণা রেঞ্জে গত ৬ মে হয়ে গেল এ বছরের ‘হিমালয়ান এক্স–ট্রাই’। আয়রনম্যান যেমন এক কর্তৃপক্ষ, তেমনি এক্স–ট্রাইও এই প্রতিযোগিতার কর্তৃপক্ষ। নেপালে সহযোগিতা করেছে নেপাল ট্রায়াথলন অ্যাসোসিয়েশন। হিমালয়ান এক্স–ট্রাইয়ে এবার অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশি দুই আয়রনম্যান শামসুজ্জামান আরাফাত ও ইমতিয়াজ এলাহী। এই দুই আয়রনম্যানের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় ঢাকায় বসে।

এক্স–ট্রাইতে এবার ২১ দেশের ৩৩ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন। আরাফাত বললেন, ‘এটা সত্যি কঠিন। কারণ, আয়রনম্যানের সমান দূরত্ব তো পেরোতে হয়ই, পাশাপাশি মুখোমুখি হতে হয় বিরূপ প্রকৃতি ও আবহাওয়ার। চরম ঠান্ডা। প্রায়ই হতে থাকে তুষারবৃষ্টি বা তুষারঝড়। দৌড়ানোর জন্য সিঁড়ির মতো পথ। সেটাও কঠিন। তাই এক্স–ট্রাইয়ে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশ কম।’

‘এক্স–ট্রাই ফিনিশার’ ইমতিয়াজ এলাহী (বাঁয়ে) ও শামসুজ্জামান আরাফাত
ছবি: সংগৃহীত

ইমতিয়াজ এলাহী শোনালেন প্রতিযোগিতার বৃত্তান্ত। এক্স–ট্রাইয়ের শুরু নেপালের পোখারা হ্রদ থেকে। এটি ৮০০ মিটার (২৬২৫ ফুট) উচ্চতায়। ৬ মে ভোর চারটায় শুরু হয় ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার। সাঁতারের পর সাইক্লিং। অন্নপূর্ণার পাথুরে পথে ১৫৫ কিলোমিটার সাইক্লিং করে ১ হাজার ৮০০ মিটার (৫৯০৫ ফুট) উচ্চতায় গিয়ে শেষ। শেষ ধাপে ৪২ কিলোমিটার দৌড়। ইমতিয়াজ বললেন, ‘দৌড়াতে থাকবেন আর উচ্চতা বাড়তে থাকবে।’

এক্স–ট্রাইয়ের নিয়ম অনুযায়ী তিনটি উচ্চতায় শেষ করা যাবে ট্রায়াথলন। আর তা ২৭ ঘণ্টা সময়ের মধ্য। তবেই ‘ফিনিশার’ বা সম্পন্নকারী হিসেবে স্বীকৃতি মিলবে। তিনটি উচ্চতা যথাক্রমে লো ক্যাম্প (৩০০০ মিটার বা ৯৮৪২ ফুট), হাই ক্যাম্প (৩৫০০ মিটার বা ১১৪৮২ ফুট) এবং ভিউ পয়েন্ট (৪০০০ মিটার বা ১৩১২৩ ফুট)।

আরাফাত লক্ষ্য স্থির করেন হাই ক্যাম্পে। ৩৫০০ মিটার উচ্চতায় গিয়ে ২০ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট সময় নিয়ে তিনি শেষ করেন সাঁতার–সাইক্লিং–দৌড়। ৩৩ প্রতিযোগীর মধ্যে ১২তম স্থান অর্জন করেন। এক্স–ট্রাইয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, পাঁচজন ৪০০০ মিটার উচ্চতায় শেষ করেছেন ট্রায়াথলন। চেক প্রজাতন্ত্রের পিটার ভাবরোসেক ১৬ ঘণ্টা ৫১ মিনিট সময় নিয়ে শীর্ষস্থান অর্জন করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান পেয়েছেন যথাক্রমে ইতালির জিওভানি বর্তোলাসো (১৭ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট) ও রাশিয়ার ইলিয়া বুবলিক (১৮ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট)।

আরাফাত বলেন, ‘সাঁতারের সময় হ্রদের পানির তাপমাত্রা ছিল ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু পানি থেকে উঠে সাইক্লিং আর দৌড়ে আমরা ওপরে উঠতে থাকি। দৌড়ের সময় তো তাপমাত্রা অনেক কম ছিল। তুষারপাত ও তুষারবৃষ্টি হচ্ছিল। সঙ্গে বাড়ছিল অক্সিজেন–স্বল্পতা। এই প্রতিযোগিতায় সঙ্গে অক্সিজেন ক্যান নেওয়ার সুযোগ নেই।’

ইমতিয়াজ এলাহীর লক্ষ্য ছিল লো ক্যাম্প বা ৩০০০ মিটার উচ্চতায় গিয়ে শেষ করা। সাঁতার ও সাইক্লিং নির্বিঘ্নেই শেষ করেছিলেন। কিন্তু দৌড়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে তুষারঝড়ের কবলে পড়েন। এলাহী বলেন, ‘পরিস্থিতি দ্রুত বিপজ্জনক হয়ে উঠল।’ এলাহীকে থামতে হলো।

ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী খারাপ আবহাওয়ার জন্য স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটে এই রেস থামিয়ে দেওয়া হয়। যাঁদের দৌড় তখনো শেষ হয়নি, তাঁদের বিকল্প নিরাপদ একটি পথে প্রতিযোগিতার পরিচালকের (রেস মার্শাল) কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে বলা হয়। ইমতিয়াজ এলাহী সেটি করেছেন এবং ‘এক্স–ট্রাই ফিনিশার’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।

বাংলাদেশি দুই আয়রনম্যান শামসুজ্জামান আরাফাত ও ইমতিয়াজ এলাহী
ছবি: সংগৃহীত

চ্যালেঞ্জ জয়ের চেষ্টা

ইমতিয়াজ এলাহী ও শামসুজ্জামান আরাফাত—দুজনের কাছেই প্রশ্ন ছিল, আপনারা তো একাধিক আয়রনম্যান সম্পন্ন করেছেন। এরপর এই এক্স–ট্রাইয়ে কেন? দুজনের জবাব একই রকম। ট্রায়াথলেটরা নিজের সামর্থ্যকে নিজেই চ্যালেঞ্জ করেন। আগের চেয়ে ভালো করার চেষ্টা করেন। ইমতিয়াজ বলেন, ‘একেকটা আয়োজনে অংশ নেওয়ার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়। ট্রেনিং করতে হয় নিয়মিত। তারপর যেতে হয়। সফল হলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।’

আরাফাত বললেন, ‘যেকোনো ট্রায়াথলনই টাফ। এ রকম কঠিন বাধাকে জয় করার মধ্যে আনন্দ অনেক। আমরা প্রথম, দ্বিতীয় হওয়ার জন্য রেস করি না। আমাদের দেখে তরুণেরা উৎসাহ পাক, এটাই চাই।’

যেন ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসা

১৯৭৫ সালের ২৭ জুন জন্ম ইমতিয়াজ এলাহীর। কদিন পরই ৪৮ বছর পূর্ণ হবে। সেটা বড় কথা নয়। ইমতিয়াজের কাহিনি শুনলে পুরাণের ফিনিক্স পাখির কথাই মনে আসে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ইমতিয়াজ। ২০০০ সালে একটা প্রশিক্ষণে প্যারাস্যুট লাফের সময় দুর্ঘটনায় পড়েন। ইমতিয়াজ বলেন, ‘এটা ছিল প্যারাস্যুট জাম্পের প্রশিক্ষকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণ। আকাশে লাফ দিয়ে নামার সময় আরেকটি প্যারাস্যুটের সঙ্গে আমারটা পেঁচিয়ে যায়। ২০০ ফুট ওপর থেকে আমরা দুজনই মাটিতে পড়ে যাই।’

এতে মেরুদণ্ডের তিনটি হাড় ভেঙে যায় ইমতিয়াজ এলাহীর। ডান পা অর্ধেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। লম্বা সময় লাগে সক্ষমতা ফিরে পেতে। দুর্ঘটনার পর ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন সেনাবাহিনী থেকে। এরপর তথ্যপ্রযুক্তির উদ্যোগ শুরু করেন। ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রতিবন্ধিতা মেনে নিতে চাইনি। ২০১০ সালে ধীরে ধীরে সাইক্লিং ও দৌড় শুরু করি। আরাফাতের সঙ্গে পরিচয় হয়। একসঙ্গে আমরা ট্রেনিং করি। নিজের জন্য একটার পর একটা লক্ষ্য স্থির করি।’

এখনো কিন্তু হাঁটতে একটু সমস্যা হয় ইমতিয়াজ এলাহীর। তারপরও ২০১৮ ও ২০২২ সালে পূর্ণ দূরত্বের দুটি আয়রনম্যান সম্পন্ন করেছেন। ২০১৯ সালে অর্ধ দূরত্বের একটি (আয়রনম্যান ৭০.৩)। সাঁতরে বাংলা চ্যানেলও পাড়ি দিয়েছেন। আর এবার করলেন এক্স–ট্রাই।

দৃষ্টি আরও সামনে

শামসুজ্জামান আরাফাত আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছেন গত বছর। আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশ নিয়েছেন। সব মিলিয়ে পাঁচটি পূর্ণ দূরত্বের আয়রনম্যান ও চারটি অর্ধ দূরত্বের আয়রনম্যান সম্পন্ন করার পদক রয়েছে ৩৩ বছর বয়সী এই তরুণ ট্রায়াথলেটের। এবারে যোগ হলো হিমালয়ে এক্স–ট্রাই। আরাফাত বলেন, ‘এবার আয়রনম্যানের আরও দুটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। প্রতিদিনই নিজেকে নতুন করে তৈরি করার চেষ্টা করি।’

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দৌড়ে যাওয়া, ৯ বার বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া আরাফাত এ রকম কঠিন ক্রীড়ার জন্য ২৭টি লক্ষ্য স্থির করেছেন। ‘এর মধ্যে কয়েকটি পূরণ হয়েছে। বাকিগুলো পূরণের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ ট্রায়াথলনের পাশাপাশি এখন পর্বতারোহণের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পেশাগত জীবনে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক শামসুজ্জামান আরাফাত।