একবার উন্মাদ হিসেবে স্বীকৃতি পেলে সবকিছু সহজ হয়ে যায়

নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন থেকে পোখারা যাওয়ার ছোট্ট বিমান

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে (এবিসি) যাওয়ার কথা ভেবে রেখেছিলাম অনেক দিন আগে। এভারেস্ট বেজক্যাম্প (ইবিসি) থেকে ফিরে আসার পর করোনা সংক্রমণের মহামারিতে অনেক দিন পর্যন্ত আতঙ্কিত সময় কেটেছে। তখনকার গৃহবন্দী জীবনের অফুরন্ত অবসরে বহু পরিকল্পনা করেছি। সেই ভাবনা যথাসময়ে কাজে পরিণত করতে পারিনি। ২০২২ সালের বসন্তে হিমালয়ে আমার দ্বিতীয় অভিযান। কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে আবারও এভারেস্ট দেখতে ইচ্ছা করল। সব মিলিয়ে আমাকে বেশি কাছে টানল গোকিও লেক। তাই সে বছর মে মাসে ট্রেক করে গেলাম গোকিও লেক আর গোকিও রি পর্যন্ত। সেখান থেকে দেখলাম এভারেস্টসহ অন্য সব চেনা পর্বত শিখর।

তার কয়েক মাস পরই, ২০২২ সালের অক্টোবরে আবার হিমালয়ে যাই। ইতিমধ্যে বন্ধু ও স্বজনদের অনেকেই আমাকে পুরোপুরি ‘পাগল’ ভাবছেন। দেখলাম, একবার উন্মাদ হিসেবে স্বীকৃতি পেলে সবকিছু সহজ হয়ে যায়। আর আমার কোনো ভয় অথবা দ্বিধা নেই। আবার কেন যাচ্ছি, বারবার কেন যেতে চাই, এর কারণ দর্শানোর কোনো চেষ্টা করতে হয় না।

পোখারা যাওয়ার জন্য ইয়েতি এয়ারলাইনসের ছোট বিমানটি ভরে ওঠে যাত্রীদের হাসি আনন্দে

গত বছর অক্টোবরে একটু বেশি সময় নিয়ে হিমালয়ে যেতে পেরেছিলাম। দুবার অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পের কিছুটা কাছাকাছিও গিয়েছি। প্রথমবার ঘোরেপানি পুনহিল ট্রেক শেষ করার পর, আর দ্বিতীয়বার অন্নপূর্ণা সার্কিট শেষ করে। অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেকের শেষে আমাদের সদলবলে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে যাওয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যায়ে এসে মালয়েশীয় ট্রেকার বন্ধু কেভিন, লিম, ইয়ং আর আমি সেই পরিকল্পনা বাদ দিই। মনে হয়, অন্নপূর্ণা সার্কিটের পর, বিশেষ করে থোরাং লা পাস পার হওয়ার মতো একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতার পর একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। এবিসিতে যাওয়ার আগে একটা বিরতি চাই। সেবারের মতো পাহাড় ও তুষারের মোহনীয় দৃশ্য বুকে নিয়ে, পর্বত ও গিরিপথে ট্রেক করে চলার স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরে আসি। এবিসি একটা আলাদা ট্রেক হলেই এর প্রতি সুবিচার করা হবে।

কোভিড কমলেও দেশে হিমালয় সংক্রমণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পাহাড়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই আগ্রহ দেখতে পাই। কেউ কেউ বারবার যান। গত কয়েক বছরে আমার ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে ট্রেকার ও পর্বতারোহীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রায়ই তাঁদের পোস্ট দেখি। তাঁদের মধ্যে আছেন পরিচিত ও অপরিচিত পর্বতপ্রেমিক। কেউ ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট আবার কেউ হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কোর্স করতে যান। খ্যাতনামা পর্বতারোহীদের মধ্যে কেউ মানাসলু, দোলমা খ্যাং অথবা অন্য কোনো পর্বত শিখরে অভিযান করতে যান। আগ্রহ নিয়ে আমি এসব খবর দেখি। ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে তাঁদের অভিযাত্রার কথা পড়ি। কখনো মুগ্ধ হয়ে, কখনো রুদ্ধশ্বাসে দেখি তাঁদের প্রশিক্ষণ ও পর্বতারোহণের ভিডিও ক্লিপ। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আমার মন উড়ে বেড়ায় পাইন বনে, পর্বতে, গিরিপথে, তুষারঢাকা চড়াই পেরিয়ে শিখরে শিখরে। কিন্তু শিখরে ওঠার অভিযান আমার সাধ্যের বাইরে। জানি ও-পথ আমার নয়, তাই আমি অত চঞ্চল হই না।

মেঘলা দিনে পোখারার ফেওয়া লেকে পাহাড়ের শ্যামল ছায়া

আমি চঞ্চল ও অস্থির হয়ে উঠি হিমালয়ে ট্রেক করতে যাওয়ার মতো গন্তব্যের ছবি দেখলে। দেশের ট্রেকার বন্ধুদের নতুন কোনো ট্রেকিংয়ের খবর পেলে, তাঁদের ট্রেকের বিবরণ পড়লে। ট্রেকারদের মধ্যে কেউ কেউ ইবিসি বা এবিসিতে গেলে ফেসবুকে নিয়মিত তাঁদের অগ্রগতির ছবি পাই। তাঁদের প্রতিদিনের যাত্রাপথের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। মনে হয়, আমিও তো তাঁদের সঙ্গী হতে পারতাম! তাঁদের ট্রেকের রোমহর্ষক বিবরণ আমার শরীরে শিহরণ জাগায়। তাঁদের দেওয়া ছবিতে পর্বত শিখরের দৃশ্য দেখি। প্রতিকূল আবহাওয়াতে, বৃষ্টি, তুষার ও মেঘের ভেতর দিয়ে তাঁদের হেঁটে যাওয়ার চ্যালেঞ্জের কথা শুনলে আমি উৎকণ্ঠিত বোধ করি।

এই নতুন পাওয়া বন্ধুদের মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য অন্বেষণে ব্রতী ভ্রামণিক এলিজা বিনতে এলাহী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর ইবিসি যাত্রার অনুপ্রেরণা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার গল্প শুনি। তিনি এবং আর এক পর্বতপ্রেমী মনিরুল ইসলাম ইবিসি ট্রেক করে এসেছেন ২০২২ সালে। মনিরুল এ বছর, মানে ২০২৩-এর মার্চে গিয়েছেন অন্নপূর্ণা অঞ্চলে। ইয়াসমিন লিসা তারও অনেক আগে হিমালয়ের বেশ কিছু অঞ্চলে ট্রেক করে এসেছেন। তিনি আবার কয়েকজনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছেন, এমন পরিকল্পনার কথা শুনি।

মার্চ মাসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি, এই বসন্তে আমি অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে যাব। তবে আমি যেতে পারব পবিত্র রমজান শেষ হওয়ার পর। অর্থাৎ ঈদের দু-এক দিন পর, এপ্রিলের শেষ দিকে। প্রায়ই শুনতে পাই, বাংলাদেশ থেকে এখন অনেক নারী-পুরুষ নেপালে ট্রেক করতে যান। কিন্তু আমার সম্ভাব্য সময়সূচি অনুযায়ী, এখান থেকে কেউ যাচ্ছেন বলে খুঁজে পেলাম না। আমাকে তাহলে একাই যেতে হবে। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমি আমার এজেন্সি অ্যামেজিং নেপাল ট্রেক অ্যান্ড এক্সপিডিশনের সন্তোষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সম্ভাব্য দিন-তারিখ ঠিক করতে চাই।

প্রথমে ঠিক করি ২৫ এপ্রিল ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাব, সেখান থেকে পরের দিন যাব পোখারা। আর তার পরদিন থেকে ট্রেকিং শুরু করব। এবার শুরু থেকেই সন্তোষকে জানিয়ে রাখি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখতে হবে। ওই দিন যাব, নাকি তারিখ পিছিয়ে অন্য কোনো দিন যাব, সেটা ঠিক করব আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে। গত বছরের পুনহিল ট্রেকের সময় কয়েক দিন ধরে যে অবিশ্রান্ত বর্ষণ হয়েছিল, সে কথা মনে রেখেই এবার বাড়তি সতর্কতা। সত্যিই কয়েক দিন পর দেখা গেল ২৫ থেকে ৩০ এপ্রিল প্রায় প্রতিটি দিন অন্নপূর্ণা অঞ্চলে টানা মেঘ ও বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। পরের দিনগুলো কেমন হবে, তখনই তা বলা যাচ্ছে না, তবু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ২ মে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাব ঠিক হলো।

মার্চ মাসের মাঝামাঝি একদিন ফেসবুকে দেখতে পাই, মনিরুল ইসলাম সস্ত্রীক গিয়েছেন ঘোরেপানি ও পুনহিল। ট্রেকটা অসামান্য সুন্দর। তবে ওই পথে উল্লেরির আগে যে ৩ হাজার ২০০ স্টেপস পাথরের খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, সেটা খুবই কঠিন। মনে মনে সারাটা সময় দেখতে পাই তাঁদের হেঁটে চলার ছবি। তাঁদের অভিযানের সাফল্যে চমৎকৃত হই। তারপর দেখি ঘোরেপানি পুনহিল শেষ করে তাঁরা দুজনেই এবিসিতেও যাচ্ছেন। মনিরুল খুব চমত্কার করে ৬ হাজার ৯৯৩ মিটার উঁচু মচ্ছপুছারে বা ফিস-টেইল পর্বতের বিবরণ লেখেন। তিনি ওখানকার স্থানীয় মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন নেপালিরা কেন ওই পর্বতকে পবিত্র মনে করেন আর কেন সরকারিভাবে সে পর্বতের শিখরে আরোহণ নিষিদ্ধ রয়েছে। কেউ কেউ বিশেষ অনুমতি নিয়ে এই রহস্যময় পর্বতে অভিযান চালালেও নেপাল সরকারের নিষেধাজ্ঞা ও মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একেবারে শিখর পর্যন্ত না গিয়ে ৫০০ ফুট বা এ রকম একটা দূরত্ব বাকি রেখে ফিরে আসেন।