পাপিয়ার দেখা মার্কিন মুলুকের ৫ বিস্ময়

স্বপ্ন ৬৪টা জেলাই ঘুরবেন। এখনো অধরা রয়ে গেছে সেই স্বপ্ন। তবে আরেকটি স্বপ্ন কিন্তু ঠিকই পূরণ করতে চলেছেন নড়াইলের মেয়ে পাপিয়া শারমিন। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সব কটি অঙ্গরাজ্য ঘোরা। ২০১৬ সালে মার্কিন মুলুকে গিয়েই পরিকল্পনাটা করেছিলেন। এ মাসে পেনসিলভানিয়া ভ্রমণের মাধ্যমে যার ইতি টানতে যাচ্ছেন। ক্রিমিনাল জাস্টিসে স্নাতকপড়ুয়া পাপিয়া কাজ করেন নিউইয়র্ক ট্রাফিক বিভাগে। ভ্রমণ–অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে পাঁচটি গল্প শোনালেন পাপিয়া শারমিন

১. বরফের জাদুঘর, আলাস্কা

আলাস্কা গিয়ে আইস মিউজিয়াম দেখব না, তা কি হয়!

স্বাভাবিক তাপমাত্রাই তখন হিমাঙ্কের ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে। ভয় পাচ্ছিলাম, বরফের জাদুঘরের ভেতর না জানি কত ঠান্ডা হবে। অকারণ শঙ্কা, জাদুঘরের ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের চেয়েও কম।

বরফ জাদুঘরের ভেতরে
ছবি: লেখক

জাদুঘরে যা কিছু চোখে পড়ল, সবই বরফের তৈরি। আছে বরফের তৈরি নানা কারুকার্য আর ভাস্কর্য। আমার কাছে সবচেয়ে মজার ছিল বসার জন্য রাখা চেয়ার আর সামনের টেবিলগুলো। এগুলোও বরফ দিয়ে তৈরি। জাদুঘরের ঠিক মাঝখানে একটা পানঘর! যেখানে পানীয় পরিবেশন করা হচ্ছিল বরফের তৈরি একবার ব্যবহার উপযোগী গ্লাসে।

গ্লাসটাও বরফের তৈরি
ছবি: লেখক

বরফ জাদুঘরের পাশেই অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়। হট স্প্রিং। আলাস্কার হিংস্র ঠান্ডায় লেক, নদী—সবকিছু যখন জমে বরফ হয়ে যায়, তখনো এই উষ্ণ প্রস্রবণে ফুটতে থাকে পানি। উষ্ণ প্রস্রবণে গোসলের সময়টা ছিল অন্য রকম। পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত গরম পানি। বাকি অংশ শীতে জমে যাওয়ার দশা।

২. মরিচের মালা, নিউ মেক্সিকো

আলবুকার্কির ওল্ড টাউনে পা রেখে মনে হলো আরব্য কোনো শহরে আছি। বাড়িঘর, দোকানপাটের স্থাপত্যশৈলী, রং—কিছুই মার্কিন ধাঁচের না। ছোট শহরটাজুড়ে পুরোনো সব বাড়ি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হেঁটে পুরো শহর ঘুরে ফেললাম।

আলবুকার্কির ওল্ড টাউনে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সরু রাস্তার দুই পাশে নানা রকম পণ্যের দোকান। সব দোকানের সামনে একটি জিনিস কমন—মরিচের মালা। প্রতিটি দোকানের সামনে কাঁচা ও পাকা মরিচের বড় বড় মালা ঝুলছে। পরে জানলাম, মরিচ এখানে কেজি দরে বিক্রি হয় না। মরিচের মালার দৈর্ঘ্য অনুযায়ী বিক্রি হয়। মানে ইঞ্চি হিসেবে দাম।

মরিচের মালা
ছবি: লেখক

ওল্ড টাউনের উপহারসামগ্রী বিক্রির দোকানগুলোও অন্য রকম। সাজানো প্রতিটি স্মারকে আভিজাত্যের ছোঁয়া। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মনোযোগ কাড়ল স্ট্রিট পারফরম্যান্স। কেউ সুর তুলেছে ইংরেজি গানে, কেউ বা স্প্যানিশ। গানের সঙ্গে অনেকে নাচও পরিবেশন করছেন। সবকিছু মিলিয়ে আলবুকার্কির ওল্ড টাউন গল্পে পড়া কোনো শহরের মতো—যেন মায়াপুরী।

৩. উইন্ডোজের ওয়ালপেপার, ইউটা

করোনা মহামারির ভয় কাটিয়ে বছরখানেক পর ঘুরতে বের হই। সঙ্গী সাত বন্ধু। গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত। সাত দিনে প্রায় তিন হাজার মাইল পাড়ি দিই। পথে ইউটা পড়ল। এই অঙ্গরাজ্যের প্রতিটি ন্যাশনাল পার্কই স্বতন্ত্র। একটার সঙ্গে আরেকটার তুলনা চলে না। ঠিক করলাম, সবচেয়ে জনপ্রিয় আর্চেস ন্যাশনাল পার্কের ‘ডেলিকেট আর্চ’–এ যাব। ছোটবেলায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে আর একটু বড় হয়ে উইন্ডোজের ডিফল্ট ওয়ালপেপারে মায়াময় জায়গাটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে দেখেছি। আজ দেখব চর্মচক্ষে।

ডেলিকেট আর্চ
ছবি: লেখক

পার্কে প্রবেশ করে জানলাম, যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় তিন মাইলের পদযাত্রা। আমরা ভেবেছিলাম সামান্য দূরত্ব, এক নিমেষেই ঘুরে আসতে পারব। কিন্তু দূরত্ব কম হলে কী হবে, পথটা কঠিন করে তুলল পাহাড়। ডিঙানোর অভ্যাস নেই বলে একটু পরপরই বিরতি নিচ্ছিলাম। কখনো পানি পানের বিরতি, কখনো ছবি তোলার। সবার যে কষ্ট হচ্ছিল, তা কিন্তু কেউ স্বীকার করিনি। ডেলিকেট আর্চে পৌঁছানোর পর অবশ্য মনে হলো এই সৌন্দর্যের কাছে এ টুকু কষ্ট কিছুই না।

৪. গাছের বয়স ৫ হাজার বছর, নেভাদা

নেভাদার নাম শুনলে চোখে দুরকম চেহারা ভাসে—মরুভূমি আর জুয়ার শহর লাসভেগাস। এর বাইরেও নেভাদা যে এতটা সুন্দর, গ্রেট বেসিন জাতীয় উদ্যানে পা না রাখলে অজানা থেকে যেত। উদ্যানটির সবচেয়ে উঁচু জায়গার উচ্চতা ১৩ হাজার ফুট। গাড়ি চালিয়ে ৯ হাজার ফুটের ওপর পর্যন্ত যাওয়া যায়। বাকিটা পা–ই ভরসা।

গ্রেট বেসিন জাতীয় উদ্যানে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গ্রেট বেসিন জাতীয় উদ্যান সল্ট লেক সিটি আর লাসভেগাসের মাঝামাঝি। যোগাযোগব্যবস্থা সুবিধার নয়। তাই পর্যটকের আনাগোনাও কম। মরুভূমির পেট চিরে রাস্তা চলে গেছে। ছুটতে ছুটতে সংকেত দেখে থামি। জানতে পারলাম, সামনের ৮০-৯০ মাইলের মধ্যে কোনো গ্যাস স্টেশন নেই। বুঝতেই পারছেন কী দুর্গম এলাকা। মধ্যদুপুরেও গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে চালাতে হয়। কারণ, যেকোনো সময় ধূলিঝড় হতে পারে।

ব্রিস্টলকোন পাইনের ছায়ায়
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গ্রেট বেসিন জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করলাম। গাড়িতে বসে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠল। মনে হলো, রোলার কোস্টারে বসে আছি। রোমাঞ্চকর যাত্রা!

এরপর শুরু হলো পায়ে হাঁটা। হাঁটাপথে পর্বত, হ্রদ, হিমবাহ মিলেমিশে একাকার। বোনাস হিসেবে পেলাম বিরল ব্রিস্টলকোন পাইন প্রজাতির গাছ দেখার সুযোগ। পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক গাছের মর্যাদা পেয়েছে এই পাইন প্রজাতি। বয়স প্রায় পাঁচ হাজার বছর। সামান্য আয়ুর মানুষ হয়ে হাজার বছরের সাক্ষী এই ব্রিস্টলকোন পাইন দর্শন সেদিনের হাঁটার কষ্ট ভুলিয়ে দিল।

৫. পৃথিবীর দীর্ঘতম গুহা, কেনটাকি

কেনটাকি রাজ্যের প্রধান আকর্ষণ পৃথিবীর দীর্ঘতম গুহা—ম্যামথ। ৪২০ মাইলের দীর্ঘ গুহাটির বিশেষত্ব বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তার সব সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে মাটির নিচে, গভীরে। জুন-জুলাই কেনটাকিতে বর্ষাকাল। ডিসেম্বর হলেও সেদিন সারা দিন বৃষ্টি ঝরল। আমি এসেছি ম্যামথ কেভ ন্যাশনাল পার্কের ডায়মন্ড ক্যাভার্নে। বৃষ্টির কারণে গুহায় প্রবেশ করতে বেগ পেতে হলো। ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে জায়গাটা। পা টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছিল।

গুহার ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছিল খাঁজে খাঁজে, ভাঁজে ভাঁজে হীরা ছড়ানো
ছবি: লেখক

গুহার ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছিল খাঁজে খাঁজে, ভাঁজে ভাঁজে হীরা ছড়ানো। এই গুহার বয়স ১ কোটি বছর। হাজার হাজার বছর ধরে ইঞ্চি ইঞ্চি করে সবার অগোচরেই গড়ে উঠেছে মাটির নিচের এই সাম্রাজ্য।