মাইজবাড়ির অধিকাংশ বাড়িতেই ‘আলং’ আছে। আলং মূল বসতবাড়ির বাইরে আলাদা একটি ঘর। যে ঘরে সারা দিন নৌকাসহ বিভিন্ন আসবাব বানানোর কাজ চলে। এসব ঘরের কোনো বেড়া নেই, আছে শুধু টিনের ছাউনি। এমন একটা আলংয়েই কাজ করছিলেন আবুল কালাম। সঙ্গে ছিলেন সহকারী মছব্বির মিয়া, শাহ নূর ও সুরুজ মিয়া। চারজন মিলে ঘাটনৌকা, বারকি নৌকাসহ হাওর অঞ্চলের নানা আকৃতির নৌকা তৈরি করেন। বছরজুড়ে নৌকা তৈরির কাজ চলে, তবে বর্ষাকালে রীতিমতো ধুম পড়ে যায়। ৭ সেপ্টেম্বর যে নৌকাটার কাজ করেছিলেন তাঁরা, সেটির সামনের গলুইয়ে ক্রমিক লেখা ৪৬। তার মানে, এ মৌসুমের ৪৬তম নৌকাটি বানাচ্ছে আবুল কালামের দল।

কাঠে পেরেক ঠুকছেন আবুল কালাম
ছবি: ছুটির দিনে

কাঁচা কাঠে পেরেক ঠুকতে ঠুকতে গল্প করেন আবুল কালাম, ‘আমি ৫০ বছর ধরি নৌকা বান্ধার কাজে আছি। বুঝ-জ্ঞান হওয়ার পর দেখছি দাদা নৌকা বান্দইন। পরে বাবাও এই কাজ করছইন। তবে নৌকা বান্ধার আগের জমজমাট ভাবটা নাই।’

বর্ষায় হাওর জনপদে নৌকাই মানুষের যাতায়াতের ভরসা। যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত হওয়ার পরও এখন অনেক বাড়ির ঘাটে একটি-দুটি করে ছোট নৌকা বাঁধা থাকে। এই ‘ঘাটনৌকা’ দিয়েই মাইজবাড়িতে নৌকার কারবার শুরু। তবে ঠিক কবে থেকে শুরু, হলফ করে মুরব্বিরাও বলতে পারেন না। আবুল কালাম যেমন বাবা-দাদার কাজের ধারাবাহিকতা টেনে ২০০ বছরের কাছাকাছি বলে ধারণা করলেন।

সুনামগঞ্জ শহরে আসবাবের বেশ কিছু দোকান আছে। এ দোকানগুলোরও অধিকাংশের মালিক মাইজবাড়ির মানুষ। এসব প্রতিষ্ঠানের মিস্ত্রি, শ্রমিক ওই গ্রাম থেকে আসেন। একসময় কাঠের ব্যবসার সঙ্গে বেশি জড়িত ছিলেন গ্রামের মানুষ। সীমান্তের কাছে হওয়ায় ভারত থেকে সহজে কাঠ আনা যেত। পরে আসবাব ও নৌকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত হন তাঁরা। নৌকা তৈরিতে কাঠ, লোহার দুই ধরনের পিন, আলকাতরা, পাট লাগে। আলংয়ের মালিকেরাই এসব দেন। ঘুম থেকে উঠেই সহকারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন আবুল কালাম। দিনভর চলে নৌকা তৈরির কাজ। চার-পাঁচজন মিলে দিনে একটি ছোট নৌকা তৈরি করতে পারেন তাঁরা। তবে বারকি নৌকা তৈরি করতে লাগে দু-তিন দিন। একেকটি নৌকায় দুই থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পান তাঁরা।

মৌসুমের ৪৬তম নৌকাটি বানাচ্ছে আবুল কালামের দল
ছবি: ছুটির দিনে

কালাম মিস্ত্রি বলেন, ‘পরিশ্রমের কাজ। সেই তুলনায় আয়রোজগার কম। একসময় সুনামগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে কাঠ আসত, এখন কাঠ আনতে হয় যশোর, বগুড়া, নেত্রকোনা থেকে। অনেকেই নৌকা তৈরির ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে আসবাবের ব্যবসা ধরে রেখেছেন। আমার তিন ছেলের কেউই নৌকা তৈরির কাজে নেই।’

আয় কম হলেও বাবা-দাদার আদি পেশা ছাড়তে পারেননি আবুল কালাম।