সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘সহে না সহে না জনতার জঘন্য মিতালী।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির এ যুগে কবির পঙ্ক্তি যেন আরও সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তিসর্বস্ব জীবনে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব কিংবা মুঠোফোন—যার যার ডিভাইসে সবাই বুঁদ হয়ে আছে। পরিবার, প্রতিষ্ঠান, আড্ডাস্থল সর্বত্র এক চিত্র। ভার্চ্যুয়াল পৃথিবীর মোহের কাছে বাস্তবের জগৎ ম্লান। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পালে সজোরে বাতাস দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা। বিচ্ছিন্নতা আরও তীব্র হয়েছে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধনে এসেছে শৈথিল্য।
এমন একটি সময়ে গত ডিসেম্বরে সুন্দরবন ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। নিকটাত্মীয় পাঁচটি পরিবারের ১৭ জন সদস্য প্রবল উৎসাহে সাড়া দেয়। তাদের মধ্যে ১২ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ৫টি শিশু। ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে রওনা হয়ে সবাই খুলনা পৌঁছাই ১৮ ডিসেম্বর রাত আটটায়। খুলনা মুহূর্তের মধ্যে মন কেড়ে নেয়। শিশুদের সরল দৃষ্টিতে সত্য সহজেই ধরা পড়ে। খুলনা শহর নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাসের বড় কারণ প্রশস্ত সড়ক এবং যানজটের উৎপাত না থাকা। এমন বৈশিষ্ট্য যেকোনো নগরীর জন্যই আশীর্বাদস্বরূপ।
১৯ ডিসেম্বর ভোরবেলায় শুরু হয় সুন্দরবন অভিযান। খুলনার জেলখানা গেট থেকে একটি নৌকায় আমরা ১৭ জন আরোহী রওনা হই অপেক্ষমাণ জাহাজের উদ্দেশে। রূপসা ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার সময় চোখে পড়ে নদীর পাড়সংলগ্ন জেলা প্রশাসকের বাসভবনের বকুলতলা। ১৮৬০ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে এই বাসভবনে থাকতেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বকুলতলায় বসেই তিনি কপালকুণ্ডলা ও বেশ কিছু কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেন। বঙ্কিমের স্মৃতিবিজড়িত রূপসা নদীতে ভাসতে ভাসতে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত জাহাজে। ‘জলফড়িং’—এমন কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় নাম দেখে জাহাজের প্রতি অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি হলো।
ছোট জাহাজটিতে শুধু আমরাই যাত্রী। নিচতলায় আটটি কেবিন। প্রতিটি কেবিনে স্বচ্ছন্দে দুজন থাকতে পারে। দোতলায় কিচেন, ডাইনিং আর উন্মুক্ত পরিসর। এর ওপরে ছাদে আড্ডা দেওয়ার চমৎকার জায়গা। দ্রুত যার যার কেবিনে মালামাল রেখে সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য ডাইনিংয়ে হাজির হলাম সবাই। পরোটা, সবজি, ডিমভাজি আর ডাল ছিল মেনু। বাড়তি আনন্দ যোগ করেছিল সুন্দরবনের মধু, সেই সঙ্গে চা-কফি। খাওয়ার পর্ব শেষে সবাই ছাদে উঠে গেলাম। জাহাজ ততক্ষণে মোংলা বন্দর ছাড়িয়ে রামপালের দিকে ছুটছে। সবার মধ্যে তখন ছবি তোলার উত্তেজনা। নারী-পুরুষ-শিশু—সবাই নিজেদের পছন্দমতো ভঙ্গিতে, কখনো একা, কখনো প্রিয়জনের সঙ্গে, কখনো দলবদ্ধভাবে ছবি তুলতে শুরু করলেন। একসময় উপলব্ধি করলাম মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক নেই। এ নিয়ে কারও কারও মধ্যে হতাশা দেখলেও আমি খুশি। ফোনে সংযোগ না থাকা মানে প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি। দেশে, বিদেশে কোথায় কী হচ্ছে—হোক সেটি রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্রীড়া কিংবা সংস্কৃতিজগতের কোনো ঘটনা—আমাদের যে তা স্পর্শ করছে না, এটি পরম স্বস্তিদায়ক। সভ্যতার সঙ্গে যেন সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।
দুপুর নাগাদ আমরা রামপাল অতিক্রম করি। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করি, নদী, সমুদ্র ও জঙ্গলের অনিন্দ্য সমাহার আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। নদীর বুকে মাঝে মাঝে শুশুক দেখা দিল। বিভিন্ন ধরনের মাছ, বক, মাছরাঙা দেখে মনটা ভরে উঠল। একাধিকবার চোখে পড়ল কুমিরের রোদ পোহানোর দৃশ্য। আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। দুই পাশে অপূর্ব সুন্দর বৃক্ষরাজি। দূর থেকে তাকালে দেখা যাবে, একটি গাছের সঙ্গে অন্য গাছের দূরত্ব ও উচ্চতার মধ্যে বিস্ময়কর জ্যামিতিক বিন্যাস। প্রকৃতির সুধা পান করতে দুপুরের আহার সেরে নিলাম। বিচিত্র ধরনের সামুদ্রিক মাছ ভোজনপর্বকে অসামান্য করে তুলেছিল। পাকস্থলীর ক্ষুধা ও চোখের ক্ষুধা পরিতৃপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা পৌঁছে গেলাম হারবারিয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে।
জাহাজের সঙ্গে বেঁধে রাখা নৌকায় হারবারিয়ার ঘাটে নামলাম আমরা। একজন গাইড ও সশস্ত্র বনরক্ষীর তত্ত্বাবধানে ঢুকে পড়লাম সুন্দরবনের গহিনে। বানর, হরিণ ও কুমিরের দেখা পেতেই সঙ্গে থাকা শিশুরা উল্লাস প্রকাশ করল। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, গোলপাতাসহ বিচিত্র বৃক্ষের সারি পেরিয়ে হাঁটতে থাকলাম আমরা। ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য শ্বাসমূল। পাঠ্যবইয়ের তথ্যের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিল শিশুরা। কাঠের তৈরি দীর্ঘ সাঁকো পার হয়ে দলবদ্ধভাবে ঘুরলাম আমরা। বাঘের দেখা মিলল না, বাঘের পায়ের ছাপ দেখে থমকে দাঁড়ালাম। এ ছাপ মুহূর্তেই ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত হয়ে গেল সবাই।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই আবার নৌকায় চড়ে জাহাজে ফিরে এলাম। সন্ধ্যায় নানা মুখরোচক খাবার আর মধু সহযোগে চা দ্বারা আপ্যায়িত হলাম সবাই। নানা দলে, উপদলে বিভক্ত হয়ে আড্ডায় মেতে উঠলাম। শিশুরা এক হয়ে ছোটাছুটি করছে। অভিভাবকদের কোনো শাসন নেই। বঙ্গোপসাগরের বুকে ভেসে চলতে চলতে বিচ্ছুরিত হলো জোছনা। আমাদের সৌভাগ্য সেটি ছিল পূর্ণিমা রাত। অপার বিস্ময়ে সবাই প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। আমাদের বড় ছেলে সাগ্নিক বলেই ফেলল, এত সুন্দর দৃশ্য সে কখনো দেখেনি। ছোট ছেলে ঋত্বিকের দেখা সবচেয়ে সুন্দর চাঁদ এটি। আমাদের দলে সংগীতশিল্পী ও আবৃত্তিশিল্পীর অভাব ছিল না। রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতা বাড়ছিল। সম্মিলিত কণ্ঠে কবিতায় ও গানে পূর্ণিমা সবার প্রাণে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল। নৈশভোজে রসনাবিলাসী খাবার যথারীতি সবাইকে উৎফুল্ল করল।
পরদিন দিনের আলো ফোটার আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম কটকা সি বিচের উদ্দেশে। গভীর বনে ঢুকে আমাদের প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে। হরিণের পাল অবাক হয়ে আমাদের দেখছিল। এমন সময় সুন্দরী সুন্দরবনের হৃদয় চিরে আকাশে আবির্ভূত হলেন সূর্য। আহা বহু বছর পর সূর্যোদয় দেখলাম—এমন অনুভূতি প্রায় সবারই।
সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কটকা সি বিচে পৌঁছে গেলাম। এটি জামতলা সি বিচ নামেও পরিচিত। সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির স্বাতন্ত্র্য এই সমুদ্রসৈকতের আবেদন বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এটি সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের মোহনীয় মিলনস্থল। সমুদ্রের ঢেউয়ে নিজেদের সিক্ত করা, ছবি তোলার পর্ব চলল কিছুক্ষণ। শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জের কাছে এসে দাঁড়ালাম সবাই। একই পথে ফিরে আসার সময় চোখে পড়ল সিডরের ধ্বংসলীলার চিহ্ন—উপচে পড়া গাছের গুঁড়ি ও শাখা–প্রশাখা। সুন্দরবন যে বাংলাদেশের কত শক্তিশালী রক্ষাব্যূহ, আবারও উন্মোচিত হলো সেই সত্য। প্রকৃতির ভয়ংকর তাণ্ডবলীলায় আমাদের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত যদি সুন্দরবন না থাকত।
ফেরার পর আমাদের জাহাজ আবার চলতে শুরু করে। মধ্যাহ্নভোজনে রাজকীয় আয়োজন। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, মাংসের ঘ্রাণে ভরে উঠল জাহাজ। প্রচুর হাঁটার কারণে সবাই ক্ষুধার্ত ছিলাম। তাই খাওয়ার স্বাদ যথারীতি বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত দুবলার চরে। শুঁটকির চর হিসেবেও এটি পরিচিত। সারিবদ্ধ জেলেদের ঘর সেখানে। আমাদের দলের প্রায় সবাই পছন্দমাফিক শুঁটকি কিনলেন। জাহাজে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেল।
শীতের হিম বাতাস যেন কামড়ে ধরল। ডেকের উন্মুক্ত স্থানে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠায় সবাই নিচতলায় যার যার কেবিনের সামনের করিডরে অবস্থান নিই। অভিযাত্রীদের সুপ্ত প্রতিভার বর্ণিল পরিচয় মিলল সেখানে। গান, কবিতা, কৌতুক, গল্প—বঙ্গোপসাগরের বুকে নেমে এল স্মরণীয় আনন্দসন্ধ্যা। জাহাজের কর্মী, বনরক্ষী সবাই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছে এ আয়োজন। রাতে ছাদে বহু কাঙ্ক্ষিত বার-বি-কিউ। সে রাতেও পূর্ণিমার ছোঁয়া লেগে ছিল। আনন্দে, আড্ডায়, ভোজনে চোখের পলকে রাতটি ফুরিয়ে গেল।
পরদিন সুন্দরবনে আমাদের শেষ দিন। সকাল থেকেই আমাদের সবার মনে বিচ্ছেদ–বেদনার সুর। গন্তব্য এবার করমজল। এ স্থান কুমির প্রজননের জন্য বিখ্যাত। খুব কাছে থেকে হরিণের দল দেখার সুযোগ হলো। শিশুরা মহানন্দে হরিণকে লতাপাতা খাওয়াল। দীর্ঘ কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছে গেলাম। টাওয়ারের চূড়ায় উঠে সবাই সমগ্র বনকে আরও গভীরভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। এখানেও কিছুটা সময় ব্যয়িত হলো ছবি তোলার জন্য। ফেরার পথে দেখি কাঠের সেতুতে এক বড়সড় বানর বসে আছে। দুঃসাহস দেখিয়ে আমার দুই পুত্র বানরের সঙ্গে বাঁদরামি শুরু করল। অন্য শিশুরাও এই কাণ্ডে যোগ দিল। শেষ মুহূর্তে একটি চরম নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল। অন্যতম অভিযাত্রী স্বপনদার জ্যাকেটের পকেটে ভ্রমণব্যয়ের টাকা ছিল। উড়নচণ্ডী বানর সেই টাকা ছিনিয়ে নিতে তাকে আক্রমণ করে বসল। অন্য বানরদেরও এদিকে আসতে দেখা গেল। কিছুটা সংগ্রাম করেই সেই বানরের হাত থেকে অবশেষে নিস্তার মিলল।
জাহাজে ফিরে বিদায়ী ভোজ গ্রহণ করলাম সবাই। বিভিন্ন পদের মাছ-মাংসের সঙ্গে স্থানীয় বিখ্যাত মিষ্টি ও দই দিয়ে ভোজনপর্বের সমাপ্তি ঘটল। ধীরে ধীরে জলফড়িং আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে চলল খুলনার দিকে। সবার মন বিষণ্ন। বিশেষ করে শিশুরা বারবার অনুরোধ করছিল অন্তত আরও এক দিন সুন্দরবনে থেকে যাওয়ার জন্য। তাদের কারও কারও চোখে জল। শিশুদের চোখের জলমাত্রই কষ্টদায়ক। কিন্তু এই চাপা কান্না দেখে স্বস্তি পেয়েছি এ জন্য যে প্রকৃতি, প্রাণী ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ না থাকলে তারা কষ্ট পেত না।