বাইকে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা টু ইরান, পাড়ি দিলেন ৯ হাজার কিলোমিটার

মোটরবাইকে ভারত, পাকিস্তান হয়ে ইরান পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন ঢাকার তরুণ দম্পতি ইরফান-ই-এলাহী আমিনা আফরিন। নিজেদের রোমাঞ্চকর ভ্রমণের গল্প শোনালেন ইরফান-ই-এলাহী। শুনলেন সজীব মিয়া

ভারতের ঝাড়খন্ডে ইরফান-ই-এলাহী ও আমিনা আফরিনছবি: সংগৃহীত

২০১৯ সালে বাইকে ভারতে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা—একা একা ভারতের রাজ্যগুলো ঘুরে দেখা। আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সেবার শুরুর আগেই ভ্রমণের সমাপ্তি টানতে হলো। কলকাতা থেকে মন খারাপ করে দেশে ফিরে আসি। কিছুদিনের মধ্যে আবার বেরিয়ে পড়ব, তখন এই ছিল সংকল্প। কিন্তু করোনা মহামারি সেই পরিকল্পনাও ভেস্তে দিল।

তত দিনে আমার মনে বিশ্বভ্রমণের ইচ্ছা জেগেছে। সেই স্বপ্নে আমার সারথি হয়ে ওঠে আমিনা আফরিন। আমার স্ত্রী। আমরা দুজনই ব্যবসায়ী। মোটরবাইকের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের ব্যবসায় একজন অপরজনকে সহায়তা করি। শুরুতে ওর ব্যাপক বাইক ভীতি ছিল। একসময় সেটি কমতে থাকে। বাইকে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন পর্যটন স্পটে দুজনে ঘুরেছি, পাহাড়েও গিয়েছি কয়েকবার। বিশ্বভ্রমণের জন্য যে পরিমাণ সময় ও অর্থ প্রয়োজন, তারও প্রস্তুতি নিতে থাকি।

যে পথে গিয়েছি আমরা

করোনা স্বাভাবিক হয়ে এলে ভারত, পাকিস্তান ও ইরানের ভিসা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করি। বাংলাদেশি নিবন্ধিত মোটরসাইকেল নিয়ে দেশের বাইরে যেতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন লাগে। অনেক ছোটাছুটি করে অনুমোদন জোগাড় করি। ভিসা জটিলতায় কেটে যায় আরও কিছু সময়।

সব প্রস্তুতি শেষে গত ৫ জুলাই রাজধানীর মনিপুরীপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। সঙ্গী ১৫০ সিসির প্রিয় বাইক।

কলকাতায় কয়েকটা দিন

৬ জুলাই সকাল। বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে ভারতে প্রবেশ করি। বনগাঁ হয়ে চলে যাই কলকাতা। নিউমার্কেট এলাকার একটা হোটেলে উঠি। কলকাতায় অনেক পরিচিত মানুষ। তাঁদের সঙ্গে শহরের এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি করে কাটে কয়েকটা দিন। কোরবানির ঈদের দিনটাও কলকাতায় কাটে।

কলকাতায় কেটেছে কয়েকটা দিন
ছবি: সংগৃহীত

পরিকল্পনা ছিল ১১ জুলাই ভোরে কলকাতা থেকে ঝাড়খন্ডের পথ ধরব। কিন্তু আমার ভোর হলো দুপুর ১২টায়! মাঝে বর্ধমানে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে দেখা করতে থামতে হয়। স্বাভাবিকভাবে পথেই অন্ধকার নামে। রাতে বাইক চালাতে সবাই মানা করেছিল। সেই নির্দেশনা অমান্য করতে হলো। দিনে দেখা রাস্তাটা হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠল। চারপাশের সবুজ প্রকৃতি অন্ধকারে ডুবে আছে। নির্জন পথে বাইক চালাতে ভয় করছিল। রাতের অন্ধকার। মাঝেমধ্যে সাঁই সাঁই করে ট্রাক আর লরি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ৫২২ কিলোমিটার পথ। রাত ১০টা বাজল হোটেলে পৌঁছাতে। যাত্রায় সেদিনই সবচেয়ে বেশি পথ পাড়ি দিই।

বর্ধমানে দুই শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে
ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরের ভুল

দিন কাটতে থাকল নির্ঝঞ্ঝাট। আজ বেনারস তো কাল লক্ষ্ণৌ। দুদিন আগ্রায় থাকি তো তিন দিন দিল্লি। ঐতিহাসিক স্থান, ধর্মীয় স্থাপনা, তীর্থস্থান—কিছুই বাদ দিই না। মাঝখানে একদিন তাজমহল ঘুরে আসি। এরপর পাঞ্জাবের আম্বালা হয়ে পৌঁছাই জম্মু। এদিকে আসার বাসনা আমার দীর্ঘদিনের। প্রতিটি জায়গা নিজেদের মতো করে ঘুরতে তিন-চার দিন চলে যায়। এর মধ্যে পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি পেয়ে যাই। ভারতীয় ভিসায় দেশটাতে প্রবেশ ও প্রস্থানের বন্দরের নাম উল্লেখ থাকে। তাই পাকিস্তানে যেতে অনুমতির প্রয়োজন হয়। অনুমতির জন্য আবেদন করেছিলাম ভারতে এসেই। বেশ ঝক্কির কাজ। নানা তথ্য দিতে হয়।

লক্ষ্ণৌয়ের এই পরিবারের কথা মনে থাকবে...
ছবি: সংগৃহীত

ভ্রমণের ২০ দিন কেটে গেছে তত দিনে। কাশ্মীরের শ্রীনগর এসে মুগ্ধ হই, ভ্রমণের সব ধকল ভুলে যাই। ডাল হ্রদ, আশপাশের আরও কিছু পর্যটনস্থান ঘুরে দেখি। কাশ্মীরের অতুলনীয় সৌন্দর্য যুগ যুগ মানুষকে মুগ্ধ করেছে। রূপলাবণ্যের কত প্রশংসা মানুষের মুখে। নিজে ঘুরে ঘুরে সেই মুগ্ধতার পরশ নিই।

পহেলগাম হয়ে সোনমার্গ ঘুরে আমরা অমৃতসরের দিকে ফিরব, এমনটাই পরিকল্পনা। তারপর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে ঢুকব। কিন্তু কাশ্মীরের রূপের রানি সোনমার্গে এসে লোভে পড়ে গেলাম! লোভের নাম ‘কারগিল’।

কারগিলের নাম কতবার শুনেছি। মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরের শহরটা না দেখে চলে যাব! দুজনই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তা যে ভুল ছিল বুঝতে পারি অনেক পরে।

কাশ্মীরের কাছাকাছি
ছবি: সংগৃহীত

আফরিনের অ্যাজমার সমস্যা আছে। সে কারণে লাদাখের দিকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু সোনমার্গের কিছু পরেই যে জোজিলা পাসের শুরু, এটা আমাদের মাথায় ছিল না। বিশ্বের অন্যতম দুর্গম এই পাসটি তুষারপাতের কারণে বছরের অর্ধেক সময়ই বন্ধ থাকে। পথ চলতে চলতে তারই কিছুটা নমুনা টের পাচ্ছিলাম। বড় বড় লরি চলছে। বৃষ্টি ঝরছে। খাড়া ওপরে উঠে গেছে অনেকটা পথ। অক্সিজেন স্বল্পতায় মাথা ঝিমঝিম করে। দুজনেই অসুস্থবোধ করি। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই খাদে পড়ে যাওয়ার ভয়।

জোজিলা পাস থেকে নিচে নেমে একটা দোকানে নুডলস খেতে খেতে দোকানিকে জিজ্ঞেস করি, কারগিল যেতে কতক্ষণ লাগবে। দোকানি বলেন, মাত্র তো জোজিলা পাস পার হলে!...এরপর কী বলেছিলেন জানি না। জোজিলা পাস শুনে আমরা থ হয়ে যাই!

একাকী লাদাখ

কারগিল জেলার দ্রাস শহরকে বলা হয় লাদাখের প্রবেশদ্বার। জোজিলা পাস পার হয়ে কারগিল পৌঁছার আগের রাতটা সেখানেই ছিলাম। রাতভর আমি ঘুমিয়েছি, আফরিন যে ঘুমাতে পারেনি, সকালে সেটা টের পেয়েছি। তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। কারগিল কিছুটা নিচের দিকে। দ্রুত কারগিল যেতে বলছিল শুধু। করগিল পৌঁছেই বুঝলাম সে অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে নিলাম। ধীরে ধীরে সুস্থ হলো আফরিন। সে সুস্থ হয়েই এক দিন পর সমস্যা বাধাল।

লাদাখের দুর্গম পথে বাইক চালাব, স্বপ্নটা অনেক দিনের। আমার ইচ্ছার কথাটা ভালো করেই জানে আফরিন। সে তাগাদা দিতে থাকে, যাও লাদাখের লেহ ঘুরে আস। শুরুতে গাঁইগুঁই করলেও একসময় বেরিয়ে পড়ি। হোটেলে থেকে যায় আফরিন।

যাওয়ার পথে আগের দিনের মতোই বৃষ্টি। হাড়কাঁপানো শীত। তবে ফেরার পথে পড়লাম বিপদে। লামায় বৃষ্টিতে পাহাড়ধস হয়েছে। রাস্তা বন্ধ। শত শত গাড়ি আটকে আছে। এতই দুর্গম এলাকা যে মোবাইলও কাজ করে না। পানি ছাড়া খাবারও কিছু নেই। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলাম। শীতে, বৃষ্টিতে অসহনীয় অবস্থা। বৃষ্টি কিছুটা থামলে মাটি সরানো শুরু হলো। এরই মধ্যে কেটে গেছে ছয় ঘণ্টা। মাটি সরানোর পরও হাঁটুসমান কাদা বাইকে পার হতে হলো।

পাকিস্তানের সুক্কুর শহরে পৌঁছে
ছবি: সংগৃহীত

লাহোর থেকে প্রস্থান

কারগিল থেকে ভারতের অমৃতসর। জোজিলা পাসের অপেক্ষাকৃত নিচের পথটা বেছে নিয়েছিলাম। যেতে যতটা কষ্ট হয়েছিল, ফেরাটা ততটা কষ্টের ছিল না।

৩ আগস্ট ভারতের ভূখণ্ড ছেড়ে পাকিস্তানের ওয়াগা সীমান্তে প্রবেশ করি। বাংলাদেশের দম্পতি বাইকে ঘুরছে জেনে ইমিগ্রেশনের সবাই বাহবা দিল। অনেকে এগিয়ে এসে ছবিও তুলল। মানুষের আগ্রহ দেখে আমরাও আনন্দ পেলাম।

সীমান্ত থেকে কয়েক ঘণ্টার পথ লাহোর। ঐতিহাসিক শহরটায় বেশ কয়েক দিন ছিলাম। বলা যায়, থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আশুরার সময় এদিকটায় গোষ্ঠীগত সংঘাতের আশঙ্কা থাকে। প্রশাসনের নানা বিধিনিষেধ জারি থাকে। ঝুঁকি না নিয়ে হোটেল থেকে নিরাপদ জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছি।

আমাদের পরের গন্তব্য পাঞ্জাব প্রদেশের রহিম ইয়ার খান শহর। স্থানীয় মোটরসাইকেল চালকদের সংগঠন থেকে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। ওদের আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করে।

পাকিস্তানের রহিম ইয়ার খান শহরের প্রবেশপথে
ছবি: সংগৃহীত

তপ্ত তাওয়ার মতো মরুপথ

১৪ আগস্ট ২০২২। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মরুপথ পেরিয়ে ইরানের তাফতান সীমান্তে এসে থামি। ইমিগ্রেশনে আনুষ্ঠানিকতা শেষে পথ ধরি জাহেদান শহরের। সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রধান শহর এটি। যাওয়ার পথে বিশেষ কিছু নেই। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মতোই ধু ধু মরুভূমি, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা। সন্ধ্যায় শহরে এসে মোটামুটি মানের একটা হোটেলে উঠি।

বাড়ির কথা মনে পড়তে থাকে। মরুময় এসব এলাকা ভালো লাগে না। প্রকৃতি হা হা জাগানিয়া। ভাষাগত সমস্যাও প্রকট। ফারসি ছাড়া স্থানীয় মানুষ কোনো ভাষাই বোঝে না। হোটেল থেকে জেনেছি, শহরে প্রতারক চক্র সক্রিয়। বিদেশি পর্যটকেরা প্রায় বিপদে পড়েন। মোটরসাইকেল সার্ভিসিং করানো দরকার। কোথায় পাব? সামান্য উর্দু বোঝেন এমন এক তরুণ খোঁজ দিয়ে উদ্ধার করেন।

পাকিস্তানে প্রবেশ করার পর থেকেই মনটা পালাই পালাই করছিল। ইরানে এসে তা দ্বিগুণ হয়েছে। কারণও আছে। পাকিস্তান থেকে কিছু রুপি সঙ্গে এনেছিলাম। সীমান্তে ইরানি রিয়ালে বিনিময় করেছি। জানা ছিল না, ইরানে ক্রেডিট কার্ড অচল। রিয়াল ফুরিয়ে গেলে কী করব?

বন্দর-ই-আব্বাসে বিপদ

ইরানের বন্দর আব্বাসে
ছবি: সংগৃহীত

জাহেদান শহর থেকে বাম পর্যন্ত আসার সময়টা কখনো ভুলব না। তপ্ত তাওয়ার মধ্যে ফেললে যেমন অনুভূতি হয়, তেমন গরমে মরুপথে বাইক চালিয়েছি। বন্দর-ই-আব্বাস ইরানের বিখ্যাত বন্দর। পারস্য উপসাগরের এই বন্দর থেকেই ফেরিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যাওয়া যায়। বন্দর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানলাম, এজেন্ট ছাড়া পারাপার সম্ভব নয়। একটা এজেন্ট অফিসে গেলাম। তারা বিস্তারিত জানাল। সবই ঠিক আছে, সমস্যা শুধু অর্থ। আমাদের কাছে যে পরিমাণ ইরানি রিয়াল আছে, তা দিয়ে মোটরবাইক পাঠানো সম্ভব, কিন্তু আমরা যেতে পারব না। কী করা? স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে কথা বললাম। তারাও জানাল, কিছু করার নেই। এর মধ্যে কয়েকজন বাটপারের পাল্লায় পড়লাম। তাঁরা আবার নারী। বন্দরে আমাদের বিপদ বুঝতে পেরে পাশে দাঁড়ানোর ভং ধরেছিল। পরে বুঝতে পেরে রক্ষা পেয়েছিলাম।

দুবাইয়ে দুজনে
ছবি: সংগৃহীত

শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো, ফেরিতে বাইক পাঠাব। আমরা যাব বিমানে। বাংলাদেশ থেকে এক বন্ধু ফ্লাইটের টিকিট কেটে দিল। ১৯ আগস্ট উড়াল দিলাম দুবাইয়ের উদ্দেশে। বাইকে সড়কপথে ভ্রমণের সমাপ্তি সেখানেই। এর মধ্যে বাইকে পাড়ি দিয়েছি প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার।

দুবাই ঘুরে সৌদি আরবের পবিত্র মদিনা থেকে বিমানে ঢাকায় নেমেছি ১ সেপ্টেম্বর। বাইকটা দুবাইয়ে এক বন্ধুর কাছে রেখে এসেছি। সেখান থেকেই পরের যাত্রাপথ ঠিক করব। বাইক হাঁকিয়ে হয়তো নতুন কোনো দেশে যাব।