প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে ৬ হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছেন তিনি
‘সাইকেল চালানোর ব্যাপারে কখনো আগ্রহ ছিল না। শুধু ভালোবাসার জন্য সাইকেল চালিয়েছিলাম,’ প্রদ্যুম্ন কুমার মহানন্দিয়ার সরল স্বীকারোক্তি, জগৎজোড়া যিনি পি কে মহানন্দিয়া নামেই পরিচিত বেশি। চেনা লাগছে না নামটা? ভারতের ওডিশা রাজ্যের প্রত্যন্ত গাঁয়ের খ্যাপাটে সেই তরুণ; ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করতে সাইকেল চালিয়ে যিনি চলে গিয়েছিলেন প্রেয়সীর শহরে, বাল্টিক সাগরের তীরঘেঁষা দেশে। ঠিক কতটা পথ! আমরা আর কতটুকুই বা আন্দাজ করতে পারি! কবির কল্পনা হয়তো কিছুটা স্পর্শ করতে পারে সেই দূরত্ব—‘একবার দেখা পাব, শুধু এই আশ্বাস পেলে/এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেব।’ একপৃথিবী দূরত্বই বটে। নয়াদিল্লি থেকে সুইডেন—পথে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক—আটটি দেশ আর কত না শহর! দূরত্বের হিসাবে প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার। আর সময়ের হিসাবে ৪ মাস ৩ সপ্তাহ। সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ পারি দিয়েছেন প্রদ্যুম্ন।
এক শীতের সন্ধ্যায় প্রথম দেখা
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর। শীতকাল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দিল্লির বহুল ব্যস্ত কনট প্লেসের আঙিনায় বসে ছবি আঁকছেন প্রদ্যুম্ন। সামনে এসে বসলেন এক তরুণী। ধবধবে গায়ের রং। আসন্ন অন্ধকারের শরীর কেটে আলো ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ভারতীয় তরুণ আঁকিয়েকে দিয়ে নিজের একটা পোর্ট্রেট করাবেন—রূপবতীর এমনই ইচ্ছা। তেমন কিছু নয়, নেহাত শখের বশে। পেশাগত ঢঙে হাতে পেনসিল তুলে নিলেন তরুণ শিল্পী। চোখ তুলে তাকালেন তরুণীর দিকে। চোখ গিয়ে পড়ল একেবারে চোখে। চোখ ছাড়িয়ে আরও গহিনে। ঝনঝন করে উঠল ভেতরটা। দুই পাশ থেকেই। সময় থমকে দাঁড়াল। শিল্পীর হাত কাঁপছে। তিনি আঁকতে পারছেন না। লাইন থেকে সরে যাচ্ছে পেনসিল। মুহূর্তে মনে পড়ল নিজ গাঁয়ের সেই জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী: দূর দেশের এক বৃষ জাতিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে। অভিজাত বংশের সেই মেয়ে হবে বিশাল বনাঞ্চলের মালিক। হবে সংগীতানুরাগী, বাজাবে বাঁশি। প্রদ্যুম্ন কুমারের ভেতর যেন ভর করল প্রেমের স্বর্গীয় শক্তি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কন্যা, তুমি কি বৃষ রাশির জাতিকা?’
‘হ্যাঁ’ জবাব দিলেন মেয়েটি। বন, গান, বাঁশি? একের পর এক মিলে গেল সব অঙ্ক। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য, প্রদ্যুম্ন জানেন। কিন্তু এত কিছু ভাবার সময় কই! ঘোরগ্রস্ত প্রদ্যুম্ন সোজা বলে বসলেন, ‘তবে তুমি আমার বউ হবে।’ এ কি প্রস্তাব, নাকি অদৃশ্য থেকে ভেসে আসা অনিবার্য নিয়তি? স্বর্ণকেশী রূপবতী মুহূর্তের জন্য স্থির। ‘তুমি আমার বউ হবে’—রিনরিন করে বাজছে তাঁর কানে। কোথা থেকে এল আহ্বান! যেখানে থাকে প্রেম, থাকে মনের মানুষের খোঁজ—অনাদিকালের সেই হৃদয়-উৎস থেকে? তা–ই হবে। নইলে তাঁর অমন লাগবে কেন!
এই আহ্বান উপেক্ষা করার শক্তি তাঁর ছিল না। একটা স্মিতহাসি ফুটে উঠল তরুণীর চোখেমুখে। প্রদ্যুম্ন কুমার বুঝে ফেললেন, বদলে গেছে তাঁর জীবনের গতিপথ।
গ্রন্থিতে বাঁধা দুই জীবন
শার্লট ভন শেডভিন—সুইডেনের অভিজাত পরিবারের স্বর্ণকেশী এই তরুণী সে বছরই ভারতে বেড়াতে এসেছিলেন। নতুন দেশ, সংস্কৃতি, আবহাওয়া—সব মিলিয়ে হই–হুল্লোড় করে ভালোই কাটছিল দিন। এর মধ্যেই ওই মাতাল সন্ধ্যা! রাতভর হাজারটা প্রশ্ন শার্লটের মাথায় ঘুরছিল। সুইডেন থেকে নিজেই নিজের গাড়ি হাঁকিয়ে এত দূর এসেছেন কেন? কেন চারপাশটা এত সুন্দর লাগছে আজ? চোখ বুজলেই ঝলমলে শত ফুল আর একটা মুখ ভাসছে। দিল্লির এত অজস্র তরুণের ভিড়ে কী আছে ওই ভ্রমরকালো মুখে? বুকের ভেতর বিরামহীন কেন বেজে চলছে সেই পঙ্ক্তি—তুমি আমার বউ হবে!
এরপর তাঁদের দেখা হতে লাগল পরপর। দেখা হওয়াই যেন অমোঘ নিয়তি। শার্লটকে নিজ গাঁয়ে আমন্ত্রণ জানালেন প্রদ্যুম্ন। শার্লটের না যেতে চাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। গ্রামের সরু পথ ধরে যখন যাচ্ছিলেন, অনাবিল আনন্দে মন তাঁর ভরে উঠছিল। প্রেমিকের গ্রাম বলে কথা, সবকিছুই যেন প্রেমময়। প্রদ্যুম্ন কুমারের বাড়িতে গিয়ে আরও অদ্ভুত মুগ্ধতা পেয়ে বসল। প্রতিটি মানুষ যেন প্রকৃতিরই অভিন্ন রূপ। বৃক্ষলতা, বন, পাখির মতো সহজ–সরল। বেশ ভালো কাটল সময়। এরপর প্রদ্যুম্ন কুমারের মা–বাবার কাছ থেকে বিয়ের সম্মতি নিয়ে ফিরে এলেন দিল্লিতে।
এবার যে যেতে হয়
শার্লট ফিরে যাবেন নিজের দেশে। সেখানে গিয়ে প্রদ্যুম্নকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন, এমনই কথা রইল। ফিরে গেলেন শার্লট। হাহাকার বুকে নিয়ে দুই প্রান্তে দুজন। টেলিফোনে গলার স্বর আর চিঠির অক্ষরে হৃদয়ের ভাষা—তাতে কি আর প্রেমিক হৃদয় তৃপ্ত হয়! শার্লট বিমানের টিকিট পাঠাতে চাইছেন। কিন্তু প্রদ্যুম্ন একরোখা—না, তোমার টাকায় নয়, আমার নিজের টাকায় যদি যেতে পারি, তবেই যাব। বিমানে না হোক, অন্য কোনোভাবে। কিন্তু যাবই।
ভরসা বাইসাইকেলে
সত্তর দশকের পৃথিবী। অধিকাংশ দেশেই ভিসা-পাসপোর্টের বাড়াবাড়ি নেই ঠিক, কিন্তু বিমান টিকিট! প্রদ্যুম্ন কুমারের মতো দরিদ্র শিল্পীর কাছে তো অত টাকা নেই। সে সময় কেবল রাজা-মহারাজারাই বিমানে যাতায়াত করার মতো বিত্তশালী ছিল। উপায়ন্তর না দেখে প্রদ্যুম্ন ভাবলেন ভিন্ন কিছু। পাগলাটে প্রেমিক। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে এক অসম্ভব সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। যা ছিল সম্পত্তি, সব বিক্রি করে দিলেন। তা দিয়ে কিনলেন বন্ধুর পুরোনো সাইকেল। একটা ব্যাগে পুরে নিলেন ছবি আঁকার সরঞ্জাম আর তাঁর আঁকাআঁকি নিয়ে ছাপা হওয়া বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং।
১৯৭৭ সালের ২২ জানুয়ারি। ইউরোপের পথে মহাযাত্রা শুরু করলেন মহানন্দিয়া। পথের সব প্রতিকূলতা, খাবারের জোগাড়—সব সামলেছেন ছবি এঁকে, ছবি বেচে। মাঝেমধ্যে ক্লান্তি পেয়ে বসত যখন, ব্যথায় জড়িয়ে আসত গা-হাত-পা, ভাবতেন প্রেমিকার মুখ। আবার পূর্ণোদ্যমে পা চালাতেন প্যাডেলে। চার মাসের বেশি সময় সাইকেল চালিয়ে মে মাসের শেষ দিকে পৌঁছান সুইডেনে, প্রেমিকার দেশে।
অবশেষে দেখা হলো দুজনার
সুইডেনে ঢোকার মুখে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। এক অভিবাসন কর্মকর্তা পাচারকারী হিসেবে তাঁকে আটকে দিচ্ছিলেন। সবকিছু খুলে বলার পরও বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না যে এমন এক কালো বর্ণের ভারতীয় তরুণকে ভালোবাসতে পারেন তাঁদের স্বদেশি অভিজাত তরুণী। ভয় দেখালেন ওই কর্মকর্তা—শার্লটের বাবার কাছে একটি বন্দুক আছে এবং তাঁর নিশানা অত্যন্ত নিখুঁত। কিন্তু সংকুল পথে পেরিয়ে আসা প্রেমিককে কি বন্দুকের ঠুনকো ভয় ফেরাতে পারে! টেলিফোন বুথ থেকে প্রেয়সীকে ফোন করলেন প্রদ্যুম্ন। তাঁকে নিয়ে যেতে বাবাকে নিয়ে চলে এলেন উচ্ছ্বসিত প্রেয়সী। কত দিন পর দেখা! নিবিড় আবেগে দুজন জড়িয়ে ধরলেন দুজনকে। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন শার্লটের বাবা। এগিয়ে এসে প্রদ্যুম্নকে বুকে টেনে নিলেন। সে দেশেই বিয়ে হলো। কিংবদন্তির মতো এই গল্প ছড়িয়ে পড়ল সারা ইউরোপে। শতাব্দীর সেরা প্রেমিক হিসেবে সুইডেনের ঘরে ঘরে, মানুষের মুখে মুখে তাঁর নাম আজও উচ্চারিত হয় সপ্রেম, সশ্রদ্ধ।
মানবপ্রেমী প্রেমিকযুগল
দরিদ্র পীড়িত পরিবারে জন্মেছিলেন প্রদ্যুম্ন কুমার। এই নিয়ে স্কুল-কলেজ, বন্ধুমহলে প্রবল নোংরামির শিকার হয়েছেন। তবে এসব কিছু মনে রাখেননি। তরুণ বয়সেই শিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। সুইডেনে শিল্পী হিসেবে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। হয়েছেন সুইডেন সরকারের শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা। আদিবাসী শিল্পের প্রসারের কাজে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন এই যুগল। তাঁদের দুটি ছেলে-মেয়ে আছে। ভারতের আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের ২৫ হাজার শিক্ষার্থীকে বাৎসরিক বৃত্তি দিয়ে থাকেন তাঁরা। ২০০৫ সালে প্রদ্যুম্ন কুমার মহানন্দিয়া নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।