হিমালয়ে হিমবাহে ৭
স্বর্গের নিচে স্বপ্নের সরোবর
৬৩ বছর বয়সে এসে হিমালয়ের প্রেমে পড়েন ইফতেখারুল ইসলাম। এভারেস্ট বেসক্যাম্প ভ্রমণ নিয়ে ২০২১ সালে লিখেছেন বই—‘যেখানে এভারেস্ট’। হিমালয়ের ডাকে এ বছরও গিয়েছেন গোকিও। গোকিও রির শীর্ষ থেকে দেখেছেন এভারেস্টসহ বিখ্যাত সব পর্বতশিখর। সে অভিযাত্রার সপ্তম পর্ব পড়ুন আজ।
মাছেরমোর তাশিদেল লজের হিমশীতল ছোট্ট ঘরে পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখি জানালায় ভোরের রোদে ঝলমল করছে। বেশ কদিন পর এত রোদ দেখে ভালো লাগে। হাতমুখ ধোয়া বা নাশতার টেবিলে যাওয়ার আগেই লজের চারপাশটা হেঁটে দেখে আসি। নীল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা দূরের পর্বতশিখর দেখে আশ্চর্য এক আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে শরীর ও মনে। বেশ কদিন পর এ রকম উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখছি। দেখছি রোদ আর থামশের্কুর সাদা শিখর। এ রকম দিনে একছুটে পাহাড়ের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে। প্রবল ঠান্ডা উপেক্ষা করে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একে একে অন্যরাও বেরিয়ে আসে। সবার আগে উঠেছিল বেন আর মাইকেল, সকালের হাঁটা সেরে ফিরে আসছে ওরা। এখন দ্রুত সব কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ব আমরা।
সবার আগে তেজ আর আমি একসঙ্গে নাশতা সেরে নিয়েছি। পাহাড়ি পথে রোদ থাকুক আর না থাকুক সারা মুখে সানস্ক্রিন লাগাতেই হয়। আজ রোদ বেশি বলে সানস্ক্রিন লাগিয়েছি ভালো করে। প্রতি রাতের বিরতি শেষ করে ভোরে উঠে বড় ব্যাগ আর নিজের ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নেওয়া একটা কঠিন কাজ। স্লিপিং ব্যাগ গুটিয়ে, ওষুধপত্র, শেভিং-সরঞ্জাম, তোয়ালে, স্যান্ডেল সব গুছিয়ে যখন ব্যাগের মধ্যে ঢোকাতে চেষ্টা করি, তখন ব্যাগটাকে আগের চেয়ে ছোট লাগে। অথবা জিনিসগুলো বড় হয়ে যায়!
শিবা একে-ওকে জিজ্ঞেস করে, আমাদের গাইডকে কি কেউ দেখেছ? কেউ কিছু বলতে পারে না। জোহরা ও শিবা নাশতার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে তাদের গাইডকে খুঁজে বেড়ায়। একজন পোর্টারের কাছ থেকে জানা গেল ওদের গাইড তখনো ঘুমাচ্ছেন। সবাই অবাক। আমাদের গাইডরাই তো ভোরে আমাদের ডেকে তোলেন। কিন্তু শিবা অবাক হয় না। ওদের কথায় বুঝতে পারি, এই ভদ্রলোকের ঘুম প্রতিদিনই একটু দেরিতে ভাঙে। ওরা তাহলে পরে আসুক। আমরা বেরিয়ে পড়ি।
সকালের রোদে উজ্জ্বল নীল আকাশের নিচে হাঁটতে ভালো লাগে। নিচের দিকেও একটা রাস্তা আছে। কিন্তু তেজ বলে, একটু কষ্ট করে পাহাড়ের উঁচুতে উঠে ওপর দিয়ে হাঁটলে সেখান থেকে দূরের পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। প্রায় তিরিশ মিনিটের খাড়া চড়াই। একটু কঠিন হলেও প্রবল উত্সাহ নিয়ে ওপরে উঠে যাই। এখান থেকে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। নিচে তাকিয়ে দেখি জোহরা, শিবা ও বেন-মাইকেলদের দলটি লজ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ওরা হাঁটছে নিচের রাস্তা ধরে। পাহাড়ের ওপরে আছি বলে চারপাশে ছোট–বড় সব তুষারঢাকা পর্বতশিখর কাছে মনে হয়। চো ওইয়ু, চোলাত্সে, কংডে ও থামশের্কু। কষ্ট করে একটু উঁচুতে ওঠার সুবিধা এই যে চারদিক খুব ভালো করে দেখা যায়।
দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর কফিবিরতি। আজ পর্বতশিখরগুলো ঝকঝক করছে। বিশেষ ধরনের সানগ্লাস ছাড়া ওই চোখঝলসানো তুষারাবৃত শিখরের দিকে তাকানো যায় না। এমন দিনে ঘরের ভেতরে বসে থাকা যায়? লজের বাইরের চত্বরে কফি নিয়ে বসি। কফি খেতে খেতে দেখতে পাই কীভাবে দূরের একটা পাহাড়ি ঝরনা থেকে প্লাস্টিকের পাইপে করে পানি নিয়ে আসা হচ্ছে। আমার ব্যাকপ্যাকে কয়েকটা প্রোটিনবার আর খেজুর থাকে। তেজ ও আমি প্রোটিনবার খাই। এসব জিনিস একটু বেশি করেই এনেছি। তেজ প্রোটিনবার বেশ পছন্দ করে। তিলক মালপত্র নিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে বলে ওরটা তেজের কাছে দিয়ে রাখি। একটু পরেই একটা পাথরের বেঞ্চের কাছে তিলককে পেয়ে যাই আমরা।
রূপবতী হ্রদ
কফিবিরতির পরের দেড় ঘণ্টা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়। হাঁটতে কষ্ট হলেও আমার উত্সাহে একটুও ভাটা পড়ে না। কে যেন বলেছিলেন, জার্নি ইজ দ্য রিওয়ার্ড—এ রকম পথে চলাটাই তো পুরস্কার। ওই পথ ধরে ঠিক দেড় ঘণ্টা উঁচুতে ওঠার পর প্রথম লেকটা দেখতে পাই। পৌঁছে গিয়েছি গোকিওর প্রথম লেকে। লেকের অংশটুকু সমতল। একদিকে খাড়া পাহাড়, বাকি তিন দিকে পাথর ছড়ানো। যতটুকু দেখা যায় স্বচ্ছ ও অগভীর জল। জলের নিচেও পাথর। বাংলাদেশের মানুষের জাফলং ও তামাবিলের কথা মনে পড়বে।
লেকের কাছে দাঁড়িয়ে চারদিকের অপূর্ব দৃশ্য দেখি। এরপর আবার ভালো করে দেখি ছোট্ট, অগভীর জলাশয়টিকে। প্রকৃতির এমন অপূর্ব দৃশ্যের মাঝখানে আমি একা, আর কেউ নেই—এ রকম কখনো হয়েছে কি না মনে করতে পারি না। কিছুক্ষণ সেই নীরব নির্জনতা উপভোগ করার পর আবার হাঁটতে শুরু করি। আরও ৪৫ মিনিট হাঁটার পর গোকিও পৌঁছানোর ঠিক আগে দ্বিতীয় লেক। প্রথম লেকের মতোই ছোট আকারের আর একটা ঝিল। এটা একটু লম্বাটে। পাহাড় আর নীল আকাশের পটভূমিতে নির্জন নিঃশব্দ প্রকৃতি আমাদের স্বাগত জানায়। টলটলে জল পান্নার মতো সবুজ। তাতে চারপাশের নিচু পাহাড় ও উঁচু পর্বতশিখরের ছায়া। দুপুর রোদের সেই রূপবতী লেক দেখে মনে হয় এত দূরে, এতটা উঁচুতে উঠে আসা সার্থক হয়েছে। অন্তত আরও দুজন মানুষ রয়েছে এখানে। জোহরা ও শিবা উচ্ছল হয়ে নানা জায়গাতে ছবি তুলছে। তখনো আমরা তৃতীয় লেকটা দেখিনি।
লেকের পাড়ে গ্রাম
দ্বিতীয় লেক থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটার পর তৃতীয় লেক। এখানেই গোকিও। ৬ মে লুকলা থেকে ট্রেকিং শুরু করে ১১ মে দুপুরে এসে পৌঁছালাম গোকিও। মাছেরমো থেকে সকালে বের হয়েছি। প্রথম ও দ্বিতীয় লেক দেখে দুপুরের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছেছি। দূরত্ব বেশি নয়। কিন্তু এইটুকু ট্রেক করে আমার হৃত্স্পন্দন অস্বাভাবিক দ্রুত হয়েছে। খুব পরিশ্রান্ত লাগে। তেজ আমাকে এখানকার উচ্চতা আর বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতার কথা মনে করিয়ে দেয়। একটা চার্ট দেখায়, যেখানে বিভিন্ন উচ্চতায় অক্সিজেনের পরিমাণ কীভাবে কমে আসে, তার তালিকা রয়েছে।
গোকিওর তৃতীয় লেকটাই সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে বেশি সুন্দর। সকালে মেঘমুক্ত আকাশ ছিল নীল। এখন আকাশে মেঘ জমছে বলে দূরের পর্বতশিখর ভালো করে দেখা যায় না। সব ধূসর হয়ে আছে। তবু চারপাশের পাহাড়ের মাঝখানে অসাধারণ সুন্দর লেকটা আমার মন কেড়ে নেয়। লেকের পাড়ে গোকিও গ্রাম—৪৭৫০ মিটার বা ১৫ হাজার ৫৮৪ ফুট এখানকার উচ্চতা। ছোট–বড় বেশ কয়েকটি হোটেল ও লজ। লেকের এক কোণে পাহাড়ের ঢালে অল্প একটু জায়গাতে ঘন করে স্তরে স্তরে লজ। এতে অন্য সব কটি দিকের প্রকৃতি অপরিবর্তিত রাখা সম্ভব হয়েছে। স্বাভাবিক রয়েছে পাহাড়ঘেরা হ্রদটির পুরো পরিধি আর চারপাশের অপার্থিব দৃশ্য। এখনকার এই জনবিরল পরিবেশে কল্পনাই করতে পারি না যে আগস্টে পূর্ণিমায় একটা ধর্মীয় উত্সবে এই হ্রদে অবগাহন করতে আসবেন কয়েক শ পুণ্যার্থী।
লেক ও পাহাড় দেখার জন্য মেঘ ছাড়া আর কোনো বাধা নেই। মেঘ ভেসে বেড়ায়—কখনো সূর্যকে ঢেকে দেয়, নিচে ঘোলাটে দেখায় লেক। কখনো মেঘ পুরো লেকটিকে ঢেকে দেয়, কিন্তু তার ওপরে, নীল আকাশে সূর্যের আলো। যতক্ষণ দেখা যায়, ওই লেকের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে, চারদিকের প্রকৃতির বিশালতাকে অনুভব করি। আকাশে হেলান দিয়ে আছে পাহাড়। তার পায়ের কাছে স্বচ্ছ জলের এই রূপবতী হ্রদ, ওপরে মেঘ। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায় সেই মেঘ। স্বর্গের কোনো রূপকল্প আমার কাছে নেই, তবু মনে হয় স্বর্গের খুব কাছে পৌঁছেছি। সেই স্বর্গের নিচে স্বপ্নের মতো একটা সরোবর।