অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যেভাবে ঈদ উদ্‌যাপন করেছি

ঈদ আয়োজনে ছবি এঁকেছেন বাংলাদেশি শিশু আইমান হক
ছবি: লেখক

মাথার ওপরে নীল আকাশ। চারপাশে তাকালে মনে হয় দক্ষ কোনো শিল্পী অতি যত্নে সাজিয়েছেন বৃহৎ এক ক্যানভাস। সঙ্গে মৃদুমন্দ হিমেল হাওয়া। বিশুদ্ধ, নির্মল এমন হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করে বারবার। এপ্রিলের তীব্র দাবদাহ শেষে কুইন্সল্যান্ডের প্রকৃতিতে শীতের আগমনী টের পাওয়া যাচ্ছে। গত বছর এমনই আরামদায়ক পরিবেশে ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপনের সুযোগ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ব্রিজবেনের সেন্ট লুসিয়ায়।

আমার স্ত্রী তাহমিনা হক অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে স্যার আলফ্রেড সনেল ড্রাইভে আমাদের অস্থায়ী বাস। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দূরত্ব পায়ে হেঁটে ১০ কি ১২ মিনিটের পথ।

ঈদের আগের দিন বিকেলে কেনাকাটায় বের হয়েছিলাম। পোশাক নয়, রান্নার আনুষঙ্গিক উপকরণ। অস্ট্রেলিয়ায় বিশেষ করে ব্রিজবেনে পোশাকের দাম বেশ চড়া। তাই সেখানে ঈদের পোশাক কেনার কথাই আসে না, যা হোক, অতিথি আপ্যায়নের দুধ, চিনি, সেমাই, ফলসহ বেশি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফিরি। ফিরেই ফেসবুক গ্রুপে জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কিং লটের খোলা জায়গায় হবে ঈদুল ফিতরের নামাজ। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম কমিউনিটি এর আয়োজন করেছে। এরপর স্টুডেন্ট ইউনিয়নের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে থাকবে বিশেষ ঈদ আয়োজন।

সবার জন্য হরেক পদের মিষ্টি
ছবি: লেখক

কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার প্রচুর মুসলিম শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। ক্যাম্পাস ঘুরে মনে হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ভৌগোলিকভাবে খুব কাছে হওয়ায় হয়তো ইন্দোনেশিয়ানরা অস্ট্রেলিয়াতে বেশি পড়াশোনা করতে আসেন।

ঈদের দিন নামাজের পর পরিবারসহ গেলাম কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। খুবই ছিমছাম, গোছানো আয়োজন। এক মাস সিয়াম সাধনার পর দিনের বেলা চা পানের সুযোগ পাওয়া গেল। পা চালিয়ে গেলাম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের কফির বুথে। অত্যন্ত সুন্দরী ও সপ্রতিভ দুই ইউনিয়ন সদস্য কফি পরিবেশন করছিলেন। ঈদ মোবারক বলে শুকনা মিষ্টির সঙ্গে নিলাম এক কাপ কফি। আর আমাদের দুই ছেলে আইমান ও আইজান দৌড় দিল খেলার জায়গায়। শিশুদের সুন্দর সময় কাটানোর জন্য সেখানে হরেক রকমের আয়োজন। সকালের স্নিগ্ধ রোদে মাদুর পেতে গা এলিয়ে দিলাম, সঙ্গে কফিতে চুমুক। প্রশান্তি আর স্বস্তিতে ভরা এক ঈদ সকাল।

কফি খেতে খেতে আগত অতিথিদের দিকে লক্ষ করছিলাম। বেশির ভাগই ইন্দোনেশিয়ান ও মালয়েশীয় তরুণ, কিছু বাঙালিও আছে। মনে হলো ৯০ শতাংশই আন্ডারগ্রাডের শিক্ষার্থী। তারা মিষ্টি নিচ্ছে, ছবি তুলছে। অনেকেই ঈদ উৎসবে যোগ দিতে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে। মালয়েশীয় তরুণ মাহমুদের সঙ্গে কথা হলো। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাটন ক্যাম্পাস থেকে এসেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে এসেছেন আরও কয়েকজন মুসলিম বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এই আয়োজন শেষে তাঁরা যাবেন আরেক বন্ধুর বাসায়, সেখানেই একসঙ্গে খাবেন দুপুরের খাবার।

কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঈদ আয়োজন
ছবি: লেখক

মিষ্টান্নের টেবিলের দিকে গেলাম। মিষ্টান্ন মানে কিন্তু আমাদের রসগোল্লা বা দই না, টার্কিশ ও মধ্যপ্রাচ্যের শুকনা মিষ্টি। প্রথমে খেলাম মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন জয়নাব ফিঙ্গার। ঘিয়ে ভাজা, বাইরে শক্ত, ভেতরে নরম ছোট ছোট লম্বাটে এই খাবার সত্যিই অতুলনীয়। মিষ্টি কিন্তু অত কড়া নয়। আমার ধারণা সারা পৃথিবীতে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় মিষ্টি খেয়ে থাকেন। আমাদের অনেকের কাছে মিষ্টি মানে কড়া মিষ্টি, চূড়ান্ত মিষ্টি, সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভয়াবহ মিষ্টি, মাঝামাঝি বলে কিছু নেই। জয়নাব ফিঙ্গারের পর হাতে নিলাম বাকলাভা। সবার চেনা, টার্কিশ শুকনা মিষ্টান্ন। এটাও ঘিয়ে ভাজা, কাজুবাদাম দেওয়া এবং মাঝারি মানের মিষ্টি।

মিষ্টি খেয়ে আবার গেলাম কফি বুথে। তখনো হাসিমুখে অতিথিদের চা-কফি দিয়ে আপ্যায়ন করে যাচ্ছেন স্টুডেন্ট ইউনিয়নের দুই কর্মী। অস্ট্রেলিয়ায় কয়েক মাস টানা থাকার পর আমার মনে হয়েছে, এখানকার বেশির ভাগ মানুষের মুখেই স্বস্তি ও আনন্দের অভিব্যক্তি থাকে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, রুগ্‌ণ, বিরক্ত, জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, রাগী মানুষ এখানে আমার চোখে পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, কাউকে দেখে আমার মনে হয়নি, তিনি অপুষ্টি বা খাদ্যাভাবে ভুগছেন। এটাই হয়তো উন্নত দেশ, উন্নত সভ্যতার মাপকাঠি। যদিও আমি অস্ট্রেলিয়াকে খুব সামান্য দেখেছি। আমার পর্যবেক্ষণ ভুল হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ, যা হোক, আরেক কাপ কফি খেয়ে অত্যন্ত সুন্দরী দুই তরুণীকে বিদায় বলে বাড়ির পথ ধরলাম।

ঈদ আয়োজনে আঁকা ছবি নিয়ে দুই ছেলে বাড়ির দিকে দৌড় দিল, তাদের আবার পাশের পার্কে যাওয়ার কথা আছে। আমার স্ত্রীও তাদের পেছনে ছুটল। তখন হঠাৎ করেই মনে উঁকি দিল আমার গ্রামের বাঁশবাগানের নিচে পারিবারিক কবরস্থানের একটা ছবি। ঈদের দিন সকালে নামাজ শেষে যেখানে অবধারিতভাবে দাঁড়িয়েছি কয়েক বছর। এখন বড় হয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বাড়ি ছেড়েছি, আবেগও অনেক ফিকে হয়ে গেছে; তারপরও মনে একটা মোচড় দিল। আর মনে পড়ল ঈদ সকালে মায়ের হাতের হলুদ খিচুড়ি আর সেমাইয়ের কথা। হাজার মাইল দূরে কোথাও একজন মা হয়তো আজও অবুঝ অপেক্ষায় আছেন। আহ্ ছেলে কবে আসবে! কিন্তু অবুঝ মা তো আর জানেন না, একবার ঘর ছাড়লে আর ফিরে আসা যায় না। ফেরা হয় না। আমরা আর ফিরতে পারি না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা