সাইকেলে ভারতের এমাথা–ওমাথা ঘুরলেন বাংলাদেশের বাবর

আমাদের দেশে যেমন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, ভারতে তেমনই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী। সড়কপথে যার দূরত্ব প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার। মাঝে পাড়ি দিতে হয় ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। দীর্ঘ এই পথেই সাইকেল চালিয়ে এলেন বাংলাদেশের বাবর আলী। বিশ্ব বাইসাইকেল দিবসে শুনুন তারই কিছু বর্ণনা।

কন্যাকুমারী পৌঁছার পর বাবর আলীর মুখে অভিযান সমাপ্তির হাসিছবি: অভিযাত্রীর সৌজন্যে

দুই দিন হলো জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে পৌঁছেছি। আজ আমার দুই চাকার বাহনটি ভারতের দীর্ঘতম জাতীয় মহাসড়কের কালো পিচে গড়ানোর জন্য প্রস্তুত। শ্রীনগরের লাল চৌক থেকে শুরু হবে সেই যাত্রা। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে ‘ঘণ্টাঘর’। সেখানে দাঁড়িয়েই প্রাতর্ভ্রমণে বেরোনো দুই কিশোরীকে একটা ছবি তুলে দিতে অনুরোধ করলাম। বয়ঃসন্ধিকালের লাজুকতায় ওরা একজন আরেজনকে ঠেলতে লাগল। এরই মধ্যে ওদের অভিভাবক এল। তাঁদেরই একজন আমার ছবি তুলে দিলেন!

গুপকার সড়ক থেকে ডানের পথই আমাকে আজকের গন্তব্য বানিহালে পৌঁছে দেবে। বাদামিবাগ সেনানিবাস–সংলগ্ন রাস্তায় অসংখ্য উইলো পথের ওপর নুয়ে আছে। ডানে সঙ্গী হিসেবে আছে সরীসৃপের মতো গা এলিয়ে পড়ে থাকা ঝিলাম। নদীটির শয়ে শয়ে বাঁক দেখতে দেখতে ভৈরবের কথা মনে পড়ে গেল। এত বাঁক আর খুব কম নদ–নদীরই আছে। মূল মহাসড়কের পাশে কোনো গাছপালা নেই। অল্প কিছু গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। তার পরই বিস্তৃত মাঠ, মাঠের শেষে এক সারি দেবদারু। দেবদারুর যেখানে শেষ, ঠিক সেখান থেকেই দিগন্তে মাথা তুলেছে তুষারমৌলি শিখরের চূড়া। খানিক পরে দুপাশেই জাফরানের খেত। জাফরানের জন্য এই জায়গাটা জগদ্বিখ্যাত। চেসরু থেকে শুরু হলো উইলো কাঠের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য। ক্রিকেট ব্যাটের স্বর্গরাজ্য। রাস্তার দুই ধারে ব্যাট তৈরির কারখানা আর দোকান। দোকানের সাইনবোর্ডে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা আর মহেন্দ্র সিং ধোনি।

গুগল ম্যাপসে বাবরের অভিযান

বনিগাম থেকে তুষারে মোড়া শিখরগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে। মনে হয় একদম কাছে, যদিও চড়তে গেলে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। শামপোরা থেকে রাস্তার একপাশ ট্রাকের দখলে চলে গেল। সামনের টানেল অতিক্রম করার জন্য দানবাকৃতির ট্রাকগুলো অপেক্ষমাণ। কঠিন পাথুরে গায়ের ওপর তুষারের টোপর পরা পর্বতের পেট চিরে চলে গেছে টানেল। টানেলের অপর পাশের ভূপ্রকৃতি পাল্টে গেল। রাস্তার ওপর ওড়াউড়ি করছে অসংখ্য প্রজাপতি। উতরাই পথে দুই-চারটা আমার মুখে এসেও পড়ল। প্রজাপতির রঙিন ডানার ঝাপটা খেয়ে ছোট একটা টানেল পেরোলাম। টানেল থেকে বানিহাল রেলস্টেশন ছাড়িয়ে বাঁয়ে মোড় নিতেই মূল জনপদের দিকে এগোনো শুরু। মাঝারি একটা ঝিরি তার প্রবাহপথের নানান আকৃতির ধূসর পাথরগুলোকে ক্রমাগত ভিজিয়ে বানিহালের পাশ দিয়ে নিচে নেমে গেছে। বানিহাল জায়গাটা আধা শহর, আধা গঞ্জ। অবস্থান কাশ্মীর-কন্যাকুমারী হাইওয়ের সঙ্গে বলে রাস্তায় যানবাহনের অসহনীয় শব্দ। তবে শেষ বিকেলের আলোয় নাগবাল–সংলগ্ন রাস্তার সামনে দাঁড়ালে শব্দসন্ত্রাসের হাত থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও রেহাই পাওয়া যায়। বিশাল চিনারগাছের প্রসারিত শত শত ডালে হাজারটা শালিকের কিচিরমিচিরে যানবাহনের শব্দ হারিয়ে গেছে! সেই শব্দেই সন্ধ্যা নামল। আমারও প্রথম দিনের পথচলায়ও ইতি হলো।

প্রাচীন সড়কপথে ক্যারাভান সরাই

আজ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। জম্মু ও কাশ্মীর হয়ে হিমাচল প্রদেশের কিছু অংশ ছুঁয়ে প্রবেশ করেছি পাঞ্জাব রাজ্যে। পাঠানকোট থেকে আজকের গন্তব্য জলন্ধর নামের এক শহর। কাশ্মীর-কন্যাকুমারী মহাসড়ক ধরে চললেও সড়কের পাশের জনপদে এই রাস্তার নাম লেখা জিটি রোড তথা গ্র্যান্ড ট্র্যাক রোড। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এ সড়ক। ভারতীয় উপমহাদেশকে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছিল এই পথ। ঐতিহাসিক সেই পথে ছুটছে আমার দ্বিচক্রযান।

পথের পাশে কোস মিনার, হরিয়ানা
ছবি: অভিযাত্রীর সৌজন্যে

পথে লুধিয়ানা শহরে লোদি দুর্গ দেখে মনটা খারাপ হলো। সিকান্দার লোদির ৫০০ বছরের পুরোনো দুর্গ এখন বিদ্যুৎ অফিস। ফাঁকা জায়গাগুলোয় বিদ্যুৎ বিভাগের নানা সরঞ্জাম।

সাইকেলের সওয়ারি হওয়ার ষষ্ঠ দিনে লুধিয়ানার অদূরে মোগল ক্যারাভান সরাইয়ের দেখা পেলাম। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে বইয়ে মোগল সরাইয়ের সরেস বর্ণনা আছে। চতুষ্কোণ একটা সুবিশাল মাঠের চারপাশে সারিবদ্ধ অনেক কামরা। দূরের যাত্রায় আঁধার নেমে এলে অপরিসর এসব কামরাতেই রাত কাটাতেন পরিব্রাজকেরা। খাবারদাবারের ব্যবস্থাও ছিল। বেশির ভাগ কক্ষের ইট–কাঠই বৃদ্ধদের দাঁতের মতো নড়বড়ে হয়ে গেছে। কক্ষের গুমোট হাওয়ায় সে যুগের কোনো পরিব্রাজকের নিশ্বাস এখনো যেন আটকে আছে বলে মনে হলো। তিন পাশের কামরাগুলো এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও একপাশ পুরোপুরি ধসে গেছে। বিহারি শ্রমিকেরা হাত লাগিয়েছেন মেরামতে। আগের কাঠামো ধরে রাখার চেষ্টা দৃশ্যমান। ভেতরে তিন গম্বুজওয়ালা একটা মসজিদও আছে। কিছুটা এগিয়ে খান্না শহরের আগে আছে লস্করি খানের সরাই। রং দে বাসন্তী সিনেমার দৌলতে এটি এখন বেশ পরিচিত। সিনেমার একটি গানের চিত্রায়ণ এখানে হয়েছিল।

গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কোস মিনারের নাম। সড়কের পাশে কোস মিনারের দেখা পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে হরিয়ানা রাজ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত। দাহার নামের জনপদে প্রথম চোখে পড়ে মাঝারি উচ্চতার এসব মিনার। হরিয়ানা ছাড়িয়ে উত্তর প্রদেশেও মোগল স্থাপত্যের এসব অনন্যনিদর্শন পথের সঙ্গী হয়েছে। গুগল ম্যাপ আর মাইলফলকহীন যুগে এসব কোস মিনারই ছিল পথের নিশানা। কোস মূলত সংস্কৃত শব্দ। এক কোস বা এক ক্রোশ হলো দুই মাইল কিংবা ৩ দশমিক ২০ কিলোমিটারের সমান। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আদেশে রাজন্যবর্গের চলাচলের সুবিধার্থে এসব কোস মিনার নির্মাণ করা হয়। লাল ইটে তৈরি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু কিছু কোস মিনার এখনো ভারতের পথেঘাটে আছে। হরিয়ানায় আছে সবচেয়ে বেশি।

মধ্যপ্রদেশের পথে
ছবি: অভিযাত্রীর সৌজন্যে

মধ্যপ্রদেশের মায়া

দুই চাকায় পথচলার ১২তম দিনে পড়ল চম্বল। এই নদীই রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশের সীমানা। আমাদের দেশেও নদী-খাল দিয়ে জেলা-উপজেলার সীমানা নির্ধারণ বহুল প্রচলিত রীতি। নদীর এপার-ওপার বেঁধে ফেলা সেতু পেরিয়ে প্রবেশ করলাম মধ্যপ্রদেশে।

পরদিন নুরাবাদ হয়ে গোয়ালিয়র দুর্গে। এই নগর কেল্লাজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সাম্রাজ্যের প্রচুর নিদর্শন। নগর দুর্গের নানা স্থানে ইসলাম, হিন্দু, শিখ ও জৈন ধর্মের নানান নিদর্শন। জাহাঙ্গীর মহল হয়ে পা বাড়ালাম অনেক লম্বা খাম্বাযুক্ত পানির বাওরি তথা লম্বা সিঁড়িযুক্ত কুয়ার দিকে। বেরিয়ে এগোলাম সাস-বহু মন্দিরে! মূল নাম সহস্র বাহু মন্দির। সেখান থেকেই সাস-বহু! উতরাই পথে পড়ল তেলি কা মন্দির, অসাধারণ স্থাপত্য। এই মন্দিরে ভারতীয় মন্দিরগুলোর উত্তর আর দক্ষিণের স্থাপত্যকলার ছাপ পাওয়া যায়। বাইরের দেয়ালও নানান ভাস্কর্যে ভর্তি। তেল ব্যবসায়ীদের টাকায় বানানো হয়েছে বলে নাম ‘তেলি কা মন্দির’!

গোয়ালিয়র শহর ছেড়ে বেরোতেই রাস্তার দুই পাশ একদম খাঁ খাঁ। পাথুরে পাহাড় বাদে নেই কোনো দোকানপাট, বসতি, মায় পেট্রলপাম্প পর্যন্ত। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার রাস্তা এমনই। মহাসড়কের অন্যতম উপাদান ধাবাও আজকের পথে কদাচিৎ দেখা মিলছে। এগোতেই মনে হচ্ছে এক অসীম শূন্যতার মধ্যে পথ চলেছি।

রাতের ঠিকানা

১৯তম দিনে তেলেঙ্গানা প্রদেশের কামারেড্ডি নামক শহর ছাড়িয়ে আবার মহাসড়কে পড়া গেল। সন্ধ্যা সমাগত। ধাবার খোঁজে চোখ রেখে পথ চলছি। দুটো ধাবাতে কথা বলেও থাকার ব্যবস্থা হলো না। এদিকের ধাবাগুলো রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া উপস্থিত। ধাবারই এক কর্মচারী বললেন, সামনে পেট্রলপাম্প আছে। ওখানে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারো।

হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়ামের পেট্রলপাম্পে আশ্রয় মিলল। রাত বাড়লে একপাশে তাঁবু পাতা যাবে। এর মধ্যেই অবশ্য ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি এক দফা কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। পেট্রলপাম্পের পাশের দোকানের একদম মাঝামাঝি বসে চা খেতে গিয়েও অর্ধেক ভিজে গেছি। দক্ষিণাঞ্চলের গরম নিয়ে শঙ্কায় ছিলাম, এখন দেখছি বেকায়দায় ফেলছে দক্ষিণের বৃষ্টি। রাতের আশ্রয় নিয়েও কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা যে হচ্ছে! রাত্রিবাসের জন্য প্রথম দিকে বেছে নিয়েছিলাম শিখদের উপাসনালয়। গুরুদুয়ারার দুয়ার সব ধর্মের লোকের জন্যই উন্মুক্ত। যতই উত্তর ভারত হয়ে মধ্য ভারতের দিকে এগিয়েছি, মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে ধাবাগুলোয়। রাজপথে ট্রাক কিংবা লরিসহ যাঁদের দিন কাটে, তাঁদের একটা বিশাল অংশ রাত কাটান ধাবার চারপাইতে। আমিও রাতের আশ্রয়ের জন্য ধাবাগুলোর ওপরেই নির্ভর করেছি। আজ ধাবা না মেলায় পেট্রলপাম্পের চাতালে তাঁবু পাতার অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল।

চালকের কৈফিয়ত

তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দরাবাদ থেকে অন্ধ্র প্রদেশের দিকে এগোচ্ছি। ইতিমধ্যে পাড়ি দিয়ে ফেলেছি প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ। মধ্যপ্রদেশ ছাড়িয়ে তেলেঙ্গানায় প্রবেশের পর থেকেই রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডে দুর্ঘটনা নিয়ে নানান সাবধানবাণী চোখে পড়ছিল। অনেক জায়গায় মজা করে লেখা, ‘এখানকার বাইকাররা বেশির ভাগই অন্ধ, আর কেউ কেউ আবছা দেখেন!’ তেমনই এক ‘অন্ধ বাইকার’ উড়ালসড়কের ওপর পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিল আমার সাইকেলে। হ্যান্ডেলবারের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে মহাসড়কে ছিটকে পড়ার পর মনে হয়েছিল, এ জীবনে মেরুদণ্ড সোজা করে বুঝি আর উঠে দাঁড়াতে পারব না। ধাক্কা দেওয়া মোটরসাইকেল আরোহী নেমে এলেন। ‘সরি, সরি’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। আরে নাদান, এখন সরি বলে কী লাভ!

উড়ালসড়কের রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসলাম। শরীরের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করছি। হাঁটুর নিচটায় জ্বলছে। ওখানটাতে কয়েক জায়গায় ছড়ে গেছে। পিঠেও তো লেগেছে। হাড়গোড় ভাঙেনি তো? মনে শঙ্কা। শিরদাঁড়াটাই তো সম্বল। ওটা সোজা রেখেই যে বাঁচতে চাই আজীবন। হাত পেছনে নিয়ে ধীরে ধীরে বুঝলাম শিরদাঁড়া ঠিকঠাক আছে। তবে বাঁ নিতম্বের ওখানে ব্যথা। তবে মাংসে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহী ইংরেজি-তেলেগু মিলিয়ে কৈফিয়ত দিয়েই যাচ্ছেন, ‘আই ব্রেকড, বাট ইট স্কিডেড।’ ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে দেখলাম চলাফেরার মতো অবস্থায় আছি। শরীর ঝুঁকিয়ে পায়ের আঙুল ধরার চেষ্টা করতে হিপের ওখানে লাগল খুব। বাকি মোটামুটি ঠিকঠাক আছি। কয়েক জায়গায় ছড়ে যাওয়া ছাড়া বড় কোনো অসুবিধা হয়নি।

ভরসা ‘আন্না’

২৬তম দিনে আট্টেবেল নামক জনপদ ছাড়াতেই কর্ণাটক থেকে তামিলনাড়ুতে প্রবেশ করলাম। আমার এবারের যাত্রাপথের সর্বশেষ রাজ্য। জাতীয় মহাসড়ক ৪৪ যেসব রাজ্য ও অঞ্চল দিয়ে গেছে, তার মধ্যে এই রাজ্যেই পড়েছে মহাসড়কের দীর্ঘতম অংশ। জাতীয় মহাসড়ক ৪৪–এর ৬৩০ কিলোমিটার পথ এই রাজ্যেই। তামিলনাড়ুর প্রথম জনপদ যুযুবাদি। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোয় আমি রীতিমতো ভাষার ভিখারি। ‘আন্না’ (বড় ভাই) শব্দকে পুঁজি করেই চারখানা রাজ্য পার হয়ে এলাম। আমাদের ভাবপ্রকাশের ভাষা পৃথক, আশপাশের দুনিয়াটাও অনেকাংশে ভিন্ন; কিন্তু প্রকৃতি যেহেতু এক জায়গায় এনেছে, যোগাযোগে সেসব খুব একটা বড় বাধা হলো না।

মহারাষ্ট্র থেকেই খাবারের ধাঁচ গিয়েছিল বদলে। পোহা, পাউরুটি পাকোড়া, বরফ গোলার স্বাদ নিতে নিতে প্রবেশ করেছিলাম তেলেঙ্গানায়। দক্ষিণের দোসা, ইডলি, সাম্বার, বড়া, উথাপ্পাম কিংবা ভেজ থালিতে নোলা থেকে হৃদয় পর্যন্ত হচ্ছে পরিতৃপ্ত।

কন্যাকুমারীতে তিন সাগরের মোহনায় বাবর আলী
ছবি: অভিযাত্রীর সৌজন্যে

শেষ বিন্দু

প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার পথের শেষ বিন্দু কন্যাকুমারী আমার বর্তমান অবস্থান থেকে আর মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। হর্সপাওয়ার চালিত যানের দখলে থাকা মহাসড়কে চলেছে উইলপাওয়ার (ইচ্ছাশক্তি) আর ‘প্যাডেল পাওয়ারে’ ভর করা আমার ধীরগতির দুই চাকার বাহন। প্যাডেলের প্রতিটা চাপ আমাকে আরেকটু এগিয়ে দিচ্ছে গন্তব্যের পানে, কমছে কন্যাকুমারীর সঙ্গে দূরত্ব। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর আর ভারত মহাসাগর—এই তিন সাগরের মোহনার জল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের সর্বদক্ষিণের ভূভাগ। তিন সাগরের সঙ্গমে এসে ফুরাল সাইকেলের গড়ান। ঝলসানো রোদে উজ্জ্বল হলুদ দিনটি সবে ১১টায় পৌঁছেছে। কাল থেকে এই পথে আর চলা হবে না। পথ আমাকে শ্রান্ত করেছে, করেছে ক্লিষ্ট, কিন্তু কখনোই একঘেয়েমি দেয়নি। এই রাস্তাকে ছেড়ে চলে গেলেও এই পথের একটা অংশ আজীবন আমার স্মৃতি হয়ে থাকবে।