পূর্ণিমার রাতে কর্ণফুলীর তীরে তাঁবু পেতেছিলেন একদল প্রকৃতিপ্রেমী, কেমন অভিজ্ঞতা হলো তাঁদের
পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভাসতে কাপ্তাইয়ের অরণ্যে গিয়েছিলেন একদল প্রকৃতিপ্রেমী। কর্ণফুলীর তীরে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটিয়েছেন তাঁরা। সেই ক্যাম্পিংয়ের গল্প শোনাচ্ছেন মনিরুল ইসলাম
ক্যাম্পসাইটে ঢোকামাত্রই আশাভঙ্গের অনুভূতি মেঘের মতো পুরো মনটা ছেয়ে ফেলল। ক্যাম্প করার জন্য আমরা সাধারণত নির্জনতা খুঁজে থাকি। শীলছড়ির এই জায়গাটা মোটেও সে রকম না। সত্যি বলতে দোষটা আমাদেরই। শীতকালের ছবি দেখে আশ্বিন মাসে হাজির হয়েছি, আর সেটাই এখন মনোবেদনার কারণ। সঙ্গীরা বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে তর্কে ব্যস্ত, এমন সময় কর্ণফুলীর ওপারে পাহাড়চূড়ায় দৃষ্টিটা হঠাৎ আটকে গেল। একখণ্ড মেঘ আপন মনে উড়ছে। দেখে মায়ায় না ভালোবাসায় পড়ে গেলাম, বলা মুশকিল।
অনেক সলাপরামর্শ করে ওখানেই ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত হলো। তাঁবু খাটানোর আদর্শ জায়গাটা এখন ভেসে থাকলেও জোয়ার এলেই পানির দখলে চলে যাবে। অনেকটা নিরুপায় হয়েই নদীর ওপর দিকটায় চলে যেতে হলো।
এবারের ক্যাম্পের উদ্দেশ্যই ছিল পূর্ণিমার চাঁদ দেখা। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে ছিল তাঁবুর ফ্লাইয়ারে ওপর নৃত্যরত বৃষ্টির রিমঝিম শোনা। দেখি কে বেশি রোমান্টিক, টিনের চালের বৃষ্টি নাকি তাঁবুর ফ্লাইয়ারে ওপর বৃষ্টি?
মানবসৃষ্ট এই বন ছোট হলেও বেশ ঘন। পাতার ফাঁক গলে সূর্যের আলো পৌঁছাতে ভালোই বেগ পেতে হয়। অরণ্যের ভীষণ নির্জনতা এখানে নেই, নেই শব্দের অযাচিত বৈরিতাও। একসঙ্গে পাঁচটা তাঁবু খাটানোর মতো জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। পাশাপাশি তিনটা আর দুটো কিছুটা দূরে। হ্যামক, তাঁবু, কিচেন সেট করেই কর্ণফুলীর শীতল পানিতে ঝাঁপ। এদিকে সেই সকাল থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি নামানোর হুমকি দিয়ে যাচ্ছে মেঘেরা। একে একে মাছ ধরা নৌকা এসে থামছে, সবার কাছেই কুচো চিংড়ি, অল্প কিছু বড় চিংড়ি আর কয়েকটা ছোট আকারের নলা মাছ। মহাজন বসে আছেন। তিনি সবার মাছ সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে যাবেন। মাছ কিনতে চেয়েও পারলাম না। নিতে হলে সব কটি নিতে হবে। সেটা আবার আমাদের জন্য অনেক বেশি হয়ে যাবে।
পানি ছেড়ে উঠে পড়লাম, রান্নার তাড়া রয়েছে। দুপুরের মেনু কর্ণফুলীর কালবাউশ আর ডাল-ভাত। বিকেলের দিকে আমাদের ক্যাম্পসাইটে বেড়াতে এলেন কয়েকজন শাখামৃগ। গাছের মগডালে শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন উৎসুক মেহমান আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ কালো, বেশ লম্বা লেজ, গায়ের রং ঝকঝকে সোনালি। তাহলে এরা কি সোনালি বানর?
কী মনে করে এবার ছাতা নিয়ে এসেছিলাম, এখন বেশ কাজে দিচ্ছে। পঞ্চের মতো কার্যকরী কিন্তু বিদঘুটে বস্ত্রটা পরতে হয়নি। ছাতার সাহায্য নিয়ে আমি ও জুয়েল ঘুরে এলাম কাপ্তাই বাজার। ইতিমধ্যে বৃষ্টি অনেকটাই ধরে এসেছে। কাপ্তাই এসে অতি আকাঙ্ক্ষিত সেই পূর্ণ চাঁদের দেখা পাওয়া গেল, কিন্তু মেঘ তার আলোকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। বৃষ্টির আর তর সইল না, আবার স্বরূপে ফিরে এল। সিএনজি পেতে ভালোই বেগ পেতে হলো, এখন বোঝা গেল মোহন ভাই কেন বারবার নিরুৎসাহিত করেছিলেন। ফিরে এলাম মুড়ি মাখানোর উপকরণ আর সরঞ্জাম নিয়ে। ঝুম বৃষ্টিতে সান্ধ্য নাশতা হিসেবে মুড়ি-চানাচুরের চেয়ে উপাদেয় আর কিছু হতে পারে না। এরপর শুরু হলো রাতের খাবারের আয়োজন। বৃষ্টির দাপটে বেশিক্ষণ আর বাইরে বসা গেল না। আশ্রয় নিলাম তাঁবুর ভেতরে।
ফিকে জ্যোৎস্নালোকিত রাত, বুনো জগৎ, নদীর বয়ে চলার শব্দ আর বৃষ্টির মিলিত সৌন্দর্য, প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে প্রণয়, তা আরও বাড়িয়ে দিল। মেঘেদের ভালোবাসার আলিঙ্গনে পূর্ণিমা রাত অনেকটাই ফিকে হয়ে আছে। তারপরও মেঘ ও ডালপালার ফাঁকফোকর গলিয়ে যেটুকু জ্যোৎস্নালোক এসে পৌঁছেছে, তাই এক আশ্চর্য রহস্যময়তা তৈরি করেছে। নদীর ঘাটে জেলেদের নৌকা অলস পড়ে আছে, আজ তাদের কোনো কাজ নেই। বৈরী এই আবহাওয়ায় অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে গেছেন জেলেরা। হয়তো কেউ আজ বাড়ি থেকে বেরই হননি।
তাঁবুর ওপরে বৃষ্টির নিরন্তর শব্দকে আলাদা কিছু মনে হয় না, এ যেন পরিবেশেরই অংশ। তাঁবুর ভেতরে রাজ্যের নির্জনতা এসে ভর করে, মনে হয় পুরো পৃথিবীতে আমি একা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো করে বলতে হয়, ‘কত দুর্লভ এই একাকিত্ব। শহরে সব সময় মানুষ, সব সময় কেউ না কেউ, সব সময়ে আমাকে থাকতে হয় নিজের পরিচয়ে। আমি কারুর বন্ধু, কারুর ভাই, কারুর কাছে দেনাদার, কারুর কাছে কৃপাপ্রার্থী। এখানে এই মুহূর্তে আমি কেউ না। আমি শুধু আমি।’