সুন্দরবন-সংলগ্ন খুলনা জেলার কয়রা উপজেলা অতীতে গভীর বন ছিল। কালের বিবর্তনে সেই বন এখন লোকারণ্য। আদতে সুন্দরবন অঞ্চলে লোকবসতি যেমন কোনোকালেই চিরস্থায়ী হয়নি, তেমনি মানুষ তাকে গভীর বনও থাকতে দেয়নি। বনাঞ্চল সাফ করে গড়ে ওঠা বসতি প্রাকৃতিক প্রলয়ের মুখোমুখি হয়ে বারবার বিলীন হয়েছে, শত বছরের ব্যবধানে আবার গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের সেই লোকারণ্যের ভাঙাগড়ার অতীত খুঁজে পেতে বর্তমান উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের সবচেয়ে প্রাচীন স্থান বেদকাশী গ্রাম ও বড়বাড়ি গ্রাম। লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, এসব স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইতিহাসের দুজন প্রতাপশালী নৃপতি ও তাদের ভক্ত, শিষ্য, সৈন্য-সামন্তদের আগমন ঘটেছিল। সুলতানি আমলে হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) শিষ্য ও বোরহান খাঁর (বুড়ো খাঁ) অনুচর পীর খালাস খাঁ প্রথম বেদকাশীতে আসেন। মোগল আমলে বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপশালী রাজা প্রতাপাদিত্য এই বেদকাশীতে আসেন।
পীর খালাস খাঁ প্রথমে তাঁর সহযোগী একটি দল নিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে সুন্দরবনের গভীরে প্রবেশ করেন। তিনি দলবল নিয়ে কয়রা নদী পার হয়ে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হন। সবশেষে আনুমানিক ১৪৩৭-৪২ সালে বেদকাশীতে এসে আস্তানা স্থাপন করেন। অতঃপর তিনি হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) প্রতিনিধি হিসেবে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি এখানে অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছিলেন। আনুমানিক ১৪৪৫-৫০ সালে বেদকাশীতে বিশাল একটি দিঘি খনন করেছিলেন। দিঘিটির দৈর্ঘ্য ১০৫০ ফুট ও প্রস্থ ৬০০ ফুট। যার মিষ্টি পানি এই অঞ্চলে সুখ্যাত। দিঘিটির প্রকৃত নাম ‘খালাস খাঁ দিঘি’। দিঘির এক পাড়ে ছিল পীর খালাস খাঁর আস্তানা এবং মাজার। দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ইট দিয়ে গাঁথা একটি কালীর থান (হিন্দু মন্দির) ছিল। এসব স্থাপনা বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত।
ষোড়শ শতাব্দীর সুন্দরবনের ইতিহাসে মহারাজ প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। বারো ভূঁইয়াখ্যাত প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য গৌড় থেকে দক্ষিণবঙ্গে এসে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এই বেদকাশীতে মহারাজ প্রতাপাদিত্য এবং বসন্ত রায় ও কচু রায়ের পদচারণ ঘটেছিল। কথিত আছে, মহারাজ প্রতাপাদিত্য সুন্দরবন অঞ্চলে ১৪টি দুর্গের নির্মাণ করেন। যার অবস্থান যশোর, ধুমঘাট, রায়গড়, কমলাপুর, বেদকাশী, শিবসা, প্রতাপনগর, শালিখা, মাতলা, হায়দারগড়, আড়াই কাকি, মানি, রায়মঙ্গল। বর্তমান কলকাতার মাতলা, রায়গড়, তালা, বেহালা, শালিখা, চিৎপুর এবং মুলাগড়ে আরও সাতটি দুর্গ ছিল।
বেদকাশীর দুর্গটি আনুমানিক ১৫৮৭-৯৫ সালে নির্মাণ করেছিলেন প্রতাপাদিত্য। দুর্গটি ছিল বেশ বড়, এ কারণে স্থানীয়রা একে বলে ‘বড়বাড়ি’। ইতিহাসে তা প্রতাপাদিত্যের গড় নামেও পরিচিত। এ দুর্গের চারদিকে ছিল প্রাচীর। প্রাচীরের ভেতরে ছিল বড় বড় সুরম্য প্রাসাদ। রাজা প্রতাপাদিত্যের দুর্গের সেসব ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়। বড়বাড়িজুড়ে রয়েছে পুরোনো সব ইট। মাটির নিচে ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত খুঁড়লে ইটের গাঁথুনিযুক্ত প্রাচীর এবং অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পাশাপাশি তাঁর চাচা বসন্ত রায় এখানে আসেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বেদকাশীর মাটিতে বিভিন্ন নিদর্শন রেখে গেছেন। এ অঞ্চলে আগমনের পর তাঁরা জঙ্গল কেটে রাস্তাঘাট, বড় বড় জলাশয়, সুরম্য প্রাসাদসহ বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড়বাড়ির দুর্গ, বেদকাশীর মিষ্টি পানির দিঘি, নোনা পানির দিঘি, শীলপুকুর, পদ্মপুকুর ও দুই সতিনের পুকুর। নানা রকমের নকশা করা পাথর, এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে আজও বেদকাশীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বর্তমানে বড়বাড়ি এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সেই আমলের ইট এবং ইটের তৈরি ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এই এলাকার অধিবাসীরা মাটি খুঁড়ে এসব ইট সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি করে বসবাস করছে।
শুধু ইট নয়, এখানে আরও রয়েছে নানা রকমের নকশা বা খোদাই করা ছোট-বড় পাথর। কোনো কোনো পাথরের ওজন প্রায় ৫০-১০০ কেজি। এসব পাথর বিভিন্ন ধরনের নকশা করা। যেমন হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, নানা রকম ফুল-ফল ও লতা-পাতা এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর ছবি। এক একটি পাথরে এক এক ধরনের কারুকার্য। বড়বাড়িতে সে আমলের তিনটি বড় পুকুর রয়েছে—শীলপুকুর, পদ্মপুকুর ও দুই সতিনের পুকুর।
কিন্তু অতীতের এই নিদর্শনগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে প্রতাপাদিত্যের বাইরেও বেদকাশীর সুদূর সমৃদ্ধ একাধিক অতীতের ইঙ্গিত করে। শুধু বেতকাশী নয়, সুন্দরবনের তেরকাঠি ও শিবসাপারের শেখেরটেক অঞ্চল প্রতাপের সময়ে ব্যবহার হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। তবে এসব অঞ্চলে প্রতাপের আগেও সমৃদ্ধ বসতি ছিল। কিন্তু পুরো সুন্দরবনে আর কোথাও উল্লিখিত দুর্গের সন্ধান মেলে না। যে কয়টি স্থাপনা বা বসতির সন্ধান গভীর বন ও সাগরকূলে পাওয়া গেছে, তার একটিও প্রতাপের নয়। এমনকি কোনো কোনোটি সেই সময় ব্যবহার বা সংস্কারও হয়নি। এই স্থাপনাগুলো প্রতাপের বহু আগের। স্থাপনা, প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলোতে প্রতাপ-পূর্ব সময়ের প্রভাব লক্ষণীয়। এমনটা হতে পারে যে কিছু কিছু প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রতাপাদিত্য নতুন বা সংস্কার করে পুনর্ব্যবহার করেছেন।
প্রতাপাদিত্যের গড়ের একটি পাথরে খোদাই করা দুটি অক্ষরের লেখা পাওয়া গেছে: ‘অ’ ও ‘ম’। অনুমেয় হয় লিপিটি ব্রাহ্মী। উল্লেখ্য ব্রাহ্মীলিপি খ্রিষ্টপূর্ব শেষ শতক এবং খ্রিষ্ট-পরবর্তী প্রথম শতকে ভারত উপমহাদেশ ও মধ্য এশিয়ায় ব্যবহৃত হতো। ব্রাহ্মীলিপি থেকে অনেক লিপির উদ্ভব হয়েছিল। যেমন পঞ্চম শতকের গুপ্তলিপিকেও ‘পরবর্তী ব্রাহ্মী’ বলা হয়। ফলে প্রাপ্ত লিপিটি পরবর্তী নাকি পূর্ববর্তী ব্রাহ্মীলিপি, তা নির্ধারণ করা গেলে প্রতাপাদিত্যের গড় নামে পরিচিত প্রত্নস্থলটির সঠিক পরিচয় জানা সম্ভব হবে। এ অঞ্চলে পুকুর খননে মাটির ঢাকনাসহ একটি কালো হাঁড়ি পাওয়া গিয়েছিল, যা প্রতাপ-পূর্ব যুগের নিদর্শন। হয়তো প্রতাপাদিত্যের গড় তিনি সংস্কার বা পুনর্ব্যবহার করেছিলেন। তবে প্রতাপাদিত্যের গড় যে প্রতাপের নয়, অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদই ইতিমধ্যে তা বলেছেন। বরং এই প্রত্নাঞ্চল খনন করলে হয়তো আরও চমকপ্রদ কোনো ইতিহাসের সন্ধান মিলতে পারে।
লেখক: মাহমুদ আলী, সদস্য (যুগ্ম সচিব), স্পারসো, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইসমে আজম, সুন্দরবন গবেষক