অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব

পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণের শহর আর্জেন্টিনার উসুয়াইয়া
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গল্পটা রূপকথার সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হওয়ার মতো, যার শুরুটা আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে। এখান থেকে পৃথিবীর একেবারে দক্ষিণ দিকে যাত্রা। দক্ষিণেরও দক্ষিণ। বলা হয়ে থাকে ‘দি এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। একটি শহর, একটি বন্দর, একটি ভূমি—উসুয়াইয়া। আর্জেন্টিনার সর্ব দক্ষিণের শহর।

পণ করেছিলাম পরিণত বয়সে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত যাব। স্বপ্ন দেখা সহজ, করে দেখানো কঠিন। এ জন্য তিন মহাদেশ পাড়ি দিয়েছি। পথ চলতে চলতে পথের পরিধি বাড়িয়েছি। পথেই ভেবেছি উসুয়াইয়াই যদি যাব, তবে অ্যান্টার্কটিকা কেন নয়? দুরূহ। কিন্তু আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

উসুয়াইয়া শহরের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে ৭০ ভাগ কাঠ। বাকিটা কাচ আর স্টিল। কয়েক দিন অবস্থান করেই বুঝেছি, এ শহরে নান্দনিকতা ও আধুনিকতা পাল্লা দিয়ে খেলা করে। সে খেলা আমার ভালো লাগে। আমি আমোদিত হই। খিদে পেলে আরও আমোদিত হই কারণ এ শহরে বিক্রি হয় একটি বিশেষ বার্গার। নাম ‘মেসি বার্গার’। এ শহর পর্যটকদের মনে করিয়ে দেয়, তাঁদের ফুটবল নায়ক আর কেউ নন, মেসি।

উসুয়াইয়ার দোকানে সাজানো সুভেনির
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কীভাবে শুরু হয় অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা? সব অভিযাত্রী যে যাঁর দেশ থেকে উসুয়াইয়ায় পৌঁছে হুড়মুড় করে জাহাজে উঠে? না, ব্যাপারটা একেবারেই সে রকম নয়। জাহাজে বোর্ডিংয়ের আগে সব অভিযাত্রীকে একটি নির্দিষ্ট হোটেলে রাখা হয় এক রাত। আমরাও হোটেলে হাজির হয়েছি। জাহাজের কেবিনে যেভাবে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ হোটেল কক্ষে প্রবেশ করে যাঁর বা যাঁদের সঙ্গে আপনার দেখা হবে, বুঝে নিতে হবে জাহাজে তিনি বা তাঁরাই হবেন আপনার কেবিনসঙ্গী। হোটেল কক্ষে প্রবেশ করেই দেখি এক সুন্দরী। রুশ। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, জাহাজে তুমিই তবে আমার কেবিন সঙ্গী হবে?

পরদিন বিকেলে গাড়ি এল। আমরা কয়েক দফায় তাতে করে জাহাজে পৌঁছালাম। জাহাজ যাবে অ্যান্টার্কটিকা। সে মহাদেশে যাওয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পাঁচটি পথ আছে। তার মধ্যে আর্জেন্টিনার উসুয়াইয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত।

প্রাচীন গ্রিক ও রোমান পণ্ডিতেরা অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণে একটি ভূখণ্ডের অস্তিত্বে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। যদিও তাঁদের হাতে কোনো প্রমাণ ছিল না। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল একদা ঘোষণা দিয়ে বসলেন, দক্ষিণ মেরু বলে একটি অঞ্চল আছে। মিসরীয় ভূগোলবিদ টলেমিও একই অনুমান করেছিলেন।

অ্যান্টার্কটিকাগামী জাহাজে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

১৭৭৩ সাল থেকে শুরু হলো অ্যান্টার্কটিক অভিযান। তবে সে সবই ছিল পুরুষের মিছিল। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত নারীদের অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু প্রথাবিরোধী কেউ কেউ থাকেন, তেমনি একজন লুইস সেগুইন। প্রথম ইউরোপীয় নারী যিনি নিষেধাজ্ঞা ভেঙে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ করেন। কেউ কেউ বলে নিজের পরিচয় গোপন করে পুরুষ বেশে জাহাজে চড়েছিলেন তিনি। আবার কেউ বলে তিনি গণিকা সেজে জাহাজে চড়েছিলেন। তবে নামতে পারেননি, জাহাজ থেকেই দেখেছেন অ্যান্টার্কটিকা। আরেকজন শক্তিমান নারী ক্রিস্টেনসেন। ১৯৩০-এর দশকে জাহাজে করে স্বামীর সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ করেছিলেন। একবার–দুবার নয়, মোট চারবার। তিনি অ্যান্টার্কটিকার মূল ভূখণ্ডে অবতরণকারী প্রথম নারী। পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু নারী গবেষকও এই প্রথা ভেঙেছেন।

ভাবছি আমার দেশের কথা। আমার বাংলার হাতে গোনা দু-তিনটি সবুজ পাসপোর্ট এ পথে গেছে।

আজ (২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি) আরেকটা সবুজ পাসপোর্ট যাচ্ছে। আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল। জাহাজের অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে ঘোষণা এল। সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরার একটি ডেমোতে অংশগ্রহণ নিতে হবে। দ্রুত।

(চলবে)