জাতিসংঘ আজকের দিনটিকে কেন বাইসাইকেল দিবস ঘোষণা করে

আজ ৩ জুন, বিশ্ব বাইসাইকেল দিবসছবি: প্রথম আলো

গাঁয়ের সন্ধ্যা। রান্নাঘরে টিমটিমে কুপির আলোয় রান্না করছেন মা। দাওয়ায় বসে আছেন দাদিমা। ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং—সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে। ‘বাজান এলি!’—দাদিমার গলা শোনা যায়। চুলার আঁচ বাঁচিয়ে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মা একবার চোখ তুলে তাকান। ভাই-বোনেরা সব হুল্লোড় করে বেরিয়ে আসে। ওই ঘণ্টাধ্বনির জন্যই যেন এতক্ষণের অপেক্ষা। আল মাহমুদের কবিতার মতো দৃশ্য—আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি।

সাইকেলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শৈশব-কৈশোরের এমন কত স্মৃতি। ছেলেবেলায় সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে মনে হতো পাখি। কেবলই সাঁই সাঁই করে উড়ে চলা। অবশ্য শিক্ষক বা গুরুজন দেখলে আচমকা থেমে যেত গতি। আলগোছে সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে ‘সালাম’ বা ‘নমস্কার’। আবার অনেক সময় টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে পড়ে গিয়ে শরীরের কত জায়গায় ব্যথা পাওয়া, ব্যথিত অঙ্গ জানে সেসব স্মৃতি। সেই যে সুনির্মল বসুর ছড়া—

ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং! সবে সরে যাও-না

চড়িতেছি সাইকেল, দেখিতে কি পাও না?

ঘাড়ে যদি পড়ি বাপু, প্রাণ হবে অন্ত

পথ-মাঝে র’বে পড়ে ছিরকুটে দন্ত।

উদ্ভাবনের পর থেকে আজ অবধি, বাইসাইকেলের জনপ্রিয়তা কিন্তু কমেনি। কতশত সহস্র বাহনের জন্ম হলো, সভ্যতায় যুক্ত হলো আধুনিক থেকে আধুনিকতর বৈদ্যুতিক বাহন, কিন্তু সাইকেলের সমাদর রয়ে গেল সমান। তার অবশ্য যৌক্তিক কারণ আছে। পরিবেশবান্ধব এই বাহন কেবল যেন বাহন নয়, একসঙ্গে অনেক কিছু। শরীরচর্চার দারুণ মাধ্যম সাইকেল চালানো। গবেষণা বলছে, সাইকেল চালালে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে, ক্যানসারের ঝুঁকি কমে, হৃদ্‌যন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ে, মজবুত হয় হাড় ও পেশি। এ রকম একটি প্যাকেজ বাহনের জনপ্রিয় না হয়ে উপায় আছে!

বাইসাইকেলের বাংলা শব্দটা ভারি সুন্দর—দ্বিচক্রযান। এই দ্বিচক্রযানের সঙ্গে সমাজ–সংসারের তুলনা করেছেন পৃথিবীর নানা দার্শনিক-লেখক। যেখানে নারী ও পুরুষ সাইকেলের দুই চাকা। আবার কেউ মানবজীবনকে এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেমন—আইনস্টাইন বলেছেন, জীবন হলো বাইসাইকেল চালানোর মতো, সব সময় চালাতে হয়, না হলে পড়ে যেতে হয়! ওই গানটা তো শুনেছেন নিশ্চয়ই—হাওয়ার ওপর চলে গাড়ি, লাগে না পেট্রোল ডিজেল/ মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল।

গানের কথা হলো, সাইকেল নিয়ে যে ভুবনবিখ্যাত কত সিনেমা আছে, সেসবের কথা আর নাই–বা বলি কেন। সৌদি আরবের প্রথম নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা হাইফা আল মনসুরের সিনেমা ওয়াজদা সাইকেল নিয়ে নির্মিত এক অনবদ্য চলচ্চিত্র। ইতালীয় নির্মাতা ভিত্তোরিও ডি সিকার কালজয়ী সিনেমা দ্য বাইসাইকেল থিভস দেখেননি এমন চলচ্চিত্রামোদী মানুষ অল্পই আছে।

সাইকেল নিয়ে কথা হবে অথচ সেই খ্যাপাটে প্রেমিকের কথা হবে না, তা কি হয়! ভারতের ওডিশা রাজ্যের প্রত্যন্ত গাঁয়ের তরুণ শিল্পী প্রদ্যুম্ন কুমার মহানন্দিয়া প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে ৬ হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাল্টিক সাগরের তীরঘেঁষা দেশে, সুইডেনে।

আজ ৩ জুন, বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস। লেসজেক সিবিলস্কি নামের এক মার্কিন অধ্যাপক তাঁর সমাজবিজ্ঞানের ক্লাস থেকে শুরু করেছিলেন একটি প্রচারণা অভিযান। ২০১৫ সালে তিনি বাইসাইকেল নিয়ে রীতিমতো একটি একাডেমিক প্রজেক্ট চালু করেন, খুব দ্রুতই যা ব্যাপক এক আন্দোলনে রূপ নেয়। এরই পথ ধরে জাতিসংঘ ২০১৮ সালে ৩ জুনকে বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস ঘোষণা করে আর তাতে নিঃশর্ত সমর্থন জানায় সব সদস্যদেশ।

ন্যাশনাল ডে ক্যালেন্ডার অবলম্বনে