এমন সাজেকময় রাত জীবনে বেশিবার আসে না

সাজেক উপত্যকার জিরো পয়েন্ট থেকে উত্তরে কংলাক পাহাড়ের দিকে যাওয়ার সময় মনের মধ্যে একটা পাখি পাখি ভাব আসে। যত দূর দৃষ্টি যায় সবুজে মোড়ানো সব পাহাড় আর পাহাড়। বন-বনানী। কুয়াশা আর মেঘ। সবকিছুর ওপরে যেন আমি ভেসে চলেছি। আঁকাবাঁকা সেই পথের দুপাশে পাহাড় নেমে গেছে কোনো অতলে। সেই ঢালু পথেই দেখা গেল মানুষের ঘরবাড়ি। মাটির দেয়াল আর ছনের ছাউনি। ঘরের চারপাশে উঠোনের মতো ছোট পরিসর। সেখানে মুরগি, ছাগল, শূকর চরে বেড়াচ্ছে। এটা একটা ত্রিপুরাপাড়া। রাস্তা থেকে ঘরের ভিটিতে নামতে মাটি কেটে তৈরি হয়েছে সিঁড়ি। সেই পাড়ার ঘরগুলোর পাশাপাশি নতুন সাত-আটটি মাচাং ঘর তৈরি হয়েছে—পর্যটকদের জন্য। ঘরের সামনে বাঁশ আর খুঁটি দিয়ে করা হয়েছে কাঠের আঙিনা। চারদিকে সীমাহীন পাহাড়ের অচঞ্চল ঢেউ। একটা ঢেউ শেষে আরেকটা। ঢেউয়ের শেষ প্রান্ত মেঘ আর কুয়াশায় ঢাকা। ত্রিপুরাপাড়ার সেই নতুন ঘরগুলোর ছয়টিতে আমরা প্রথম আলো পরিবারের ১২ জন বন্ধু দুই দিনের অতিথি হয়ে ছিলাম।

অতিথিশালাটির নাম মেঘপল্লী। ঘরের সামনে কাঠের আঙিনায় দাঁড়িয়ে দূরের বিস্তৃত সবুজের দিকে চোখ পড়লে মনে হয় সত্যিই যেন মেঘের দেশে দাঁড়িয়ে আছি। খাগড়াছড়ি থেকে ৭০ কিলোমিটারের সর্পিল চড়াই-উতরাইয়ের পথে মাঝে মাঝে অরণ্যের ভেতর থেকে আগুনের শিখার মতো পলাশ, শিমুল জানিয়ে দিয়েছে আমরা বসন্তেই বেড়াতে এসেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু এই সাজেক উপত্যকায় আমরা যখন পৌঁছাই, সূর্য তখন মধ্যগগনে। কিন্তু গরম নেই। নবাগত বসন্তে শীতের পুরোপুরি আমেজ এখনো রয়ে যাওয়ায় অসাধারণ নাতিশীতোষ্ণ এক আবহাওয়া আমাদের যেন আলিঙ্গন করল।

আমাদের কটেজগুলোর সামনে বিজন উন্মুক্ত অরণ্য প্রান্তর, শৈলমালা, বুনো কাশ আর আমের মুকুলের ঘ্রাণ মুহূর্তেই কেমন উদাস করে ফেলল। একটু সামনে পাহাড়ের তল থেকে উঠে আসা বহু বছর বয়সী একটা শিমুলগাছ সবকিছুকে ছাড়িয়ে যেন পুরো সাজেক উপত্যকাটা পাহারা দিচ্ছে। গাছটির মাঝবরাবর কাঠের পাটাতন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। কিসের টানে যেন সেখানে গিয়ে উঠলাম। সে আনন্দের তুলনা নেই। মাথার ওপরে সেই পত্রমোচী বৃক্ষের পাতাহীন ডালের বিস্তার, আর তার ফাঁকে নীল আকাশ। সামনে পাহাড় আর পাহাড়, নিচে বনভূমি। আমি যেন পার্থিব জগতের সব ধুলোমলিন বাস্তবতা থেকে অনেক ওপরে উঠে এক অলৌকিক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। মনের ভেতর কত রকম ইচ্ছা যে জেগে উঠছে এ সময়। অবচেতনে শূন্যে ভেসে থাকার একধরনের অনুভূতি শরীরজুড়ে আনন্দ ছড়িয়ে দিল।

সাজেকে পৌঁছানোর প্রথম বিহ্বলতা কাটিয়ে আমরা যে যাঁর কক্ষে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে চলে গেলাম খাবারঘরে। আলুভর্তা, মাশরুমভাজি, বাম্বো চিকেন, কাঁচা আর শুকনো লঙ্কামিশ্রিত ডাল দিয়ে দুপুরের খাবারটা খেয়ে আবার যে যাঁর কক্ষে ফিরে আসি। তখন চারদিকে অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রকৃতি। আঙিনায় ঘুঘু, বুলবুল, ফিঙেদের অসংকোচ বিচরণ। পাশের ঘরে বুনো বেগুনের ফুল, আরও নাম না–জানা ফুলের ঘ্রাণ। রোদ ক্রমশ আরও নরম হয়ে উঠছে। দূরে কুয়াশা ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারপাশে কী নিভৃতি, কী আশ্চর্য নির্জনতা। পাখির কাকলি ছাড়া আর কোনো শব্দ পাচ্ছি না তো। না আরও কিছু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। পাখিদের পায়ে পায়ে ডাল–পাতার মচমচানি, শুকনো পাতা বা লতাপাতা ঝরে পড়ার শব্দ। মাঝে মাঝে ঝিঁঝির মতো ডাকও আসে। আমি খুব নীরবে আহমেদ মুনিরের ঘরে গিয়ে পৌঁছালাম। সে বলল, এই নির্জনতার শব্দ শুনতে খুব ভালো লাগছে কায়সার ভাই। আমিও আসলে তাকে এ কথাটা জানাতে গিয়েছিলাম। সে কোলবালিশের মতো নির্জনতাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ থাকে। আমি আবার ফিরে আসলাম। আমার সামনে রোদ ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকল। গাঢ় থেকে গাঢ়তর নির্জনতার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে চরাচর। দূরের শৈলমালা ও বনানী ক্রমশ কুয়াশায় আরও অস্পষ্ট হতে থাকল। কতক্ষণের জন্য জগতের সবকিছু ভুলে গেলাম।

সাজেকের উদ্দেশে যাত্রার শুরুতে প্রণব বল আমাকে বলেছিল, ‘কায়সার ভাই, কিছু চকলেট বা মিষ্টি কিনে রাখেন। কাজে লাগবে।’ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কেন? আসার সময় বুঝলাম পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে জুমিয়াদের ছোট ছোট কুঁড়েঘর, মাচাং ঘর থেকে গাড়ি দেখে দেবদূতের মতো বেরিয়ে আসে শিশুরা। তারা অতিথিদের হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানায়। ওদের আদুরে নিষ্পাপ মুখগুলোতে রাজ্যের মায়া লেগে আছে। ইচ্ছে করছিল প্রতিবার নেমে নেমে ওদের বুকে জড়িয়ে নিই। সাজেক সত্যিই মায়ার দেশ।

বিকেলে সবাই ঠিক করলাম ট্রেকিং করে কংলাক যাব। সাজেক উপত্যকার সবচেয়ে উঁচু চূড়াটির নাম কংলাক। সাজেকে আসা পর্যটকদের জন্য এটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। খাড়া ঢালু এই পথে ওঠা অনেকের জন্য কষ্টকর হলেও মেঘ আর পাহাড়ের মিতালি দেখে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এখান থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় ভারতের লুসাই পাহাড়, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদের প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী। যে নদীর তীরে গড়ে উঠেছে হাজার বছরের পুরোনো নগর চট্টগ্রাম ও তার বন্দর। কংলাক পাহাড়ে থাকতে থাকতেই পৃথিবীর রং পাল্টে গেল। চারদিকের সবুজের ওপর অস্তগামী সূর্যটা রাঙা প্রলেপ দিয়ে অন্য রকম একটা মাধুর্য দিয়ে দিল। একটু পরেই নিঃশব্দে ডুবে গেল সেটি। আমরা নেমে এলাম। গেলাম সাজেকের জিরো পয়েন্টে।

ওখানে ভ্রমণপিয়াসী মানুষের ভিড়। হেলিপ্যাডে গোল হয়ে বসে কিছু তরুণ দরাজ গলায় গান ধরেছে। তাদের গানের সুরগুলো যেন নীরব পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে বারবার। চারপাশে দোকানপাট, ফুটপাতে খাবারের দোকানে মানুষের ভিড়। ওখানেই আছে লুসাইপল্লি। জয়ন্তী দেওয়ান বলল, ‘ওখানে টিকিট কেটে ঢুকে লুসাই পোশাক পরে ছবি তোলা যায়।’ (আমার স্ত্রী) জ্যোৎস্না কায়সার খুব আগ্রহ দেখাল। কাউন্টারে গেলাম। কিন্তু সন্ধ্যার পর আর ঢোকা যায় না। মন খারাপ করে ফিরে এলাম। এই ঘোরাঘুরির মধ্যে হঠাৎ মনে হলো, কী রে আমাদের সঙ্গে প্রণব বল নেই। সে কোথায়? খাগড়াছড়ি আর সাজেকে আসার পুরো পরিকল্পনাটা তারই। পেশাগত কারণে তাকে প্রতি মাসে একবার পাহাড়ে আসতে হয়। সে এখানকার সবকিছু জানে। আমরা কোথায় থাকব, কী খাব, কী করব সব সে আগে থেকে সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু এখন তো তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ভ্রমণ কার্যক্রমের অর্থ সম্পাদক দিদারুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ‘কী জানি?’ গাজী ফিরোজ বলল, ‘প্রণবদা নিশ্চয় কোনো নিউজের সন্ধানে কোথাও গেছে।’ তবুও আমার ভাবনা যায় না। ফোনে ধরতে চেষ্টা করলাম বারবার। ফোনও যায় না। সাজেক আসার পর আমাদের নেটওয়ার্ক এক দাগে এসে ঠেকেছে। ফোনে কাউকে পাওয়া খুব কঠিন। জগতের সবকিছু ভুলে এই প্রকৃতির মধ্যে ডুবে থাকার সুযোগ দেওয়ার জন্য হয়তো কথা বলার যন্ত্রগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এখানে আসার পর থেকে একজন মানুষ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার কাঁধে শিকারের একটা বড় যন্ত্র। তার নাম সৌরভ। সৌরভ ছবি শিকার করে। সে বলল, ‘যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিক থেকে কেউ যেন ডেকে বলছ—আমাকে তোল, আমাকে তোল।’ প্রকৃতি তার নিজের ভাষায় ক্যামেরাকে ডাকছে। আমাদের সফরসঙ্গী নূর একজন শিল্পী। আমার মনে হয়েছিল সে ছবি আঁকবে। কিন্তু তার আগ্রহে উদ্ভিদবৈচিত্র্যে। চারপাশের বিচিত্র গাছপালার নাম সে বলছে উদ্ভিদবিশেষজ্ঞের মতোই। প্রণবের জন্য উদ্বেগ নিয়ে আমরা অন্ধকারে দুই পাহাড়ের মাঝখানে সর্পিল পথ বেয়ে ফিরে এলাম ত্রিপুরাপাড়ার মেঘপল্লীতে। কিন্তু প্রণব কোথায়? আমার চোখেমুখে উদ্বেগের চিহ্ন স্পষ্ট। সেটা পড়তে পেরে গেছে দুই ছোট ভাই সুজয় চৌধুরী আর ইফতেখার ফয়সাল। তারা বলল, ‘ভাইয়া চিন্তা কইরেন না। উনি নিশ্চয় কোনো কাজে গেছে।’ এই বলে দুজনে গেয়ে উঠল—একজনে ছবি আঁকে এক মনে, ও মন আরেকজন বসে বসে রং মাখে। এরা ভালো লেখে, ওরা ভালো ছেলে জানতাম। কিন্তু এমন সুরে সুরে গান গাইতে পারে, জানতাম না। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক এই দীর্ঘ পথের যাত্রায় ওদের গলার সুর আমাদের প্রাণের ভেতর এক অদ্ভুত সঞ্জীবনী সুধা সরবরাহ করেছে, যা আমাদের ক্লান্ত হতে দেয়নি।

সন্ধ্যার একটু পর প্রণবের গলা শুনতে পেলাম। আমার প্রাণ ফিরে এল। সে বলল, ‘কায়সার ভাই একটু পর আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন সাজেক রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ণ দেব বর্মণ।’

আমি বললাম, ‘আমাদের সবাইকে টেনশনের মধ্যে রেখে তুমি গিয়েছিলে কোথায়?’

সে তার মুঠোফোনে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, ‘দেখেন আমি কোথায় গেছি।’

দেখলাম একটা ছোট স্রোতোধারা। সাজেক নদী। ওই নদীর এক পাশে ভারত, এক পাশে বাংলাদেশ।

সে বলল, ‘ওই জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলাম।’

একটু পর প্রণবের কটেজের সামনে আমরা সবাই জড়ো হলাম। সেখানে এলেন আমাদের প্রবীণ আলোকচিত্রী সুপ্রিয় চাকমা। তিনি রাঙামাটি থেকে দেড় শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে এসেছেন। আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করলেন সুপর্ণ দেব বর্মণ। গিটার হাতে এলেন এখানকার কণ্ঠশিল্পী জন চাকমা। শুরু হলো দীর্ঘ আড্ডা। কথায় কথায় তিনি জানালেন, সাজেকে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। আগে পর্যটক এসে কোথাও থাকার জায়গা না পেয়ে বিপদে পড়ত। গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে দেড় শর মতো রিসোর্ট। পাহাড়ে সংবাদ সংগ্রহ আর ছবি তোলার রোমহর্ষ সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন সুপ্রিয়দা। সবশেষে গান ধরলেন জন চাকমা। সঙ্গে গলা মেলালেন আমাদের ইফেতখার আর সুজয়। অশ্বজিৎ টেবিলে তবলার মতো সংগত দিল। আর তালে তালে নাচল বেলায়েত। পাহাড়ের নির্জনতায় আমাদের গানের সুর ভেসে গেল বহুদূর। আমরাও ভেসে গেলাম এক আশ্চর্য সুরের মদিরায়। বহুক্ষণ চলল এই গান আর কথামালা।

অতিথিদের সঙ্গে আমরা রাতের খাবার সারলাম ওখানেই। খাওয়ার পর বাইরে খোলা আকাশের নিচে বারবিকিউর চুলায় ওরা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমরা তারই পাশে গোল হয়ে সবাই দাঁড়ালাম। অনতিদূরে মিজোরামের অরণ্যের কালো সীমারেখার দিকে চেয়ে চেয়ে এ রকম গল্পগুজব করতে কেমন যে লেগেছে, তার বিবরণ লেখা খুব কঠিন। এমন নির্জন অরণ্যের মাঝখানে শীতরাতে আগুনের পাশে আমাদের গল্পগুলো ক্রমশ উষ্ণতর হয়ে উঠল। কিছুতেই শেষ হয় না। একসময় চোখের পাতা নিমীলিত হলে আমরা যে যাঁর মাটির ঘরের সামনে এলাম। ঘুমাতে যাওয়ার আগে শেষবার আকাশের তারকারাজির দিকে তাকালাম। নিস্তব্ধ বনানীর ওপর আকাশটা যেন একটা অতিকায় বাটির মতো উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দূরে কোথাও বনের মধ্যে কী একটা পাখি ঢেকে উঠল। মনে হলো ওপরের নক্ষত্রশোভিত শব্দহীন আকাশ আর নিচের শব্দহীন সবুজ পরস্পরের কাছে এসে কী যেন কানাকানি করতে চাইছে। মাঝখানে আমি বিয়োগরেখার মতো পড়ে আছি। এমন সাজেকময় রাত জীবনে বেশিবার আসে না।