‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ সম্পন্ন করে ইকরামুল হাসান কেন দেশে ফিরতে পারছেন না?

হিমালয় পর্বতমালার মধ্য দিয়ে নেপালের পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যাওয়া পথটিই ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’। দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। দুর্গম এই পথই হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কঠিন অভিযানে নেমেছিলেন ইকরামুল হাসান। ৯ জুলাই কাঞ্চনজঙ্ঘা উত্তর বেজক্যাম্প পাংপেমাতে পৌঁছানোর মাধ্যমে অভিযানের ইতি টানেন তিনি। তরুণ এই পর্বতারোহীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজীব মিয়া

হিমালয়ের দুর্গম পথে একা হেঁটেছেন ইকরামুল হাসান
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

এখন কোথায় আছেন?

অভিযান শেষ করে নেপালের কাঠমান্ডু চলে এসেছি।

প্রশ্ন :

অভিযান কবে শেষ হলো…

৯ জুলাই। সেদিন ভোর সাড়ে চারটায় লোনাক থেকে রওনা হয়ে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে কাঞ্চনজঙ্ঘা উত্তর বেজক্যাম্প পাংপেমাতে পৌঁছাই। ৫ হাজার ১৪২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই বেজক্যাম্পে পৌঁছার মাধ্যমে আমার অভিযান শেষ হয়।

প্রশ্ন :

কত দিন লাগল?

অভিযান শুরু করেছিলাম গত বছরের ১ আগস্ট। মাঝে বিরতি ছিল। অভিযানে হাঁটতে হয়েছে ৯৬ দিন, বিশ্রামসহ যা ১০৯ দিন। এই পথে মোট ২৯টি পাস অতিক্রম করেছি। তার মধ্যে ১৪টি ৫ হাজার মিটার উচ্চতার অধিক।

আরও পড়ুন
হিমালয়ের দুর্গম পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার কঠিন অভিযানে ইকরামুল হাসান
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

শুরুটা কোথায় হয়েছিল?

‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ অভিযান হিমালয়ের উত্তর–পশ্চিমে নেপাল-তিব্বতবর্তী হিলশা গ্রাম থেকে শুরু করতে হয়। গত বছর আগস্টের প্রথম সকালে মূল অভিযান শুরু করি। তারপর হুমলা, মুগু, ডোলপা, মানাং, গোরখা, রুবি ভ্যালি, লাংটাং, হেলাম্বু, গৌরীশঙ্কর, সলুখম্বু, এভারেস্ট বেজক্যাম্প, মাকালু ন্যাশনাল পার্ক হয়ে নেপালের উঁচু-নিচু দুর্গম বিপজ্জনক পথ পায়ে হেঁটে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেজক্যাম্পে পৌঁছাই।

প্রশ্ন :

এই পথ কতটা কঠিন?

অত্যন্ত বিপৎসংকুল এবং কষ্টসাধ্য পর্বত অভিযান এই ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’। সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৫০ জনের কম পর্বতারোহী এই অভিযান সম্পন্ন করেছেন। আমাকে অনেকবার বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পথ হারাতে হয়েছে। অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছে। কখনো কখনো পাথুরে পথে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিপদের সম্মুখীনও হতে হয়েছে। পাহাড়ধসের মতো মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। বরফ ফাটল ও হিমালয়ের বিপজ্জনক হিমবাহ পাড়ি দিয়েছি।

প্রশ্ন :

অভিযানের মধ্যে বিরতি নিয়েছিলেন কেন?

আমি মূলত এই অভিযানে দুটি বিরতি নিয়েছি। প্রথম বিরতিটা নিতে হয়েছিল এই অভিযানের মাঝপথে। তখন মুস্তাং জেলার অন্নপূর্ণা সার্কিটে ছিলাম। বিরতি নিয়ে যোগ দিই বাংলাদেশ নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ-নেপাল মৈত্রী অভিযানে। এই অভিযান হয়েছে দুবার এভারেস্ট আরোহণকারী এম এ মুহিতের নেতৃত্বে। তাঁর সঙ্গে আমরা দোগারি ও ডোলমা খাং নামের ছয় হাজার মিটারের পর্বত অভিযানে অংশগ্রহণ করি। এর মধ্যে ডোলমা খাং (৬ হাজার ৩৩২ মিটার) পর্বতে সফলভাবে আরোহণ করি। এরপর আমি গ্রেট হিমালয়া ট্রেইলের অভিযান আবার শুরু করি।

আর দ্বিতীয়বার অর্থের অভাবে দেশে ফিরতে হয়েছিল। কিছুটা অর্থের সংস্থান করেই আবার চলে এসেছিলাম। দ্বিতীয় দফায় সাব্রুবেসি নামক জায়গা থেকে অভিযান শুরু করেছিলাম।

অভিযানে তাঁবুই ছিল ঠিকানা
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ সম্পন্নকারী অভিযাত্রীকে নেপালের কোন প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দিয়ে থাকে?

নেপালের সব পর্বত অভিযানের সফলতা সনদ দিয়ে থাকে দেশটির ট্যুরিজম বোর্ড। ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ কিছুটা ভিন্ন মেজাজের বলে কালেভদ্রে এই অভিযান হয়। আমিও মাত্রই অভিযান শেষ করলাম। এখন পুরো অভিযান নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। আমি যে সত্যিই অভিযান করেছি তার ছবি, ভিডিও, বিভিন্ন জায়গায় পারমিটসহ সব প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। সেসব তারা যাচাই–বাছাই করে সনদ দেবে। আমি সবকিছু গোছাচ্ছি। আশা করি সনদও পেয়ে যাব।

প্রশ্ন :

আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন…

আমাদের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ফুলবাড়িয়া। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়। গাজীপুরের জনতা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছি। ২০১৯ সালে বাবা মারা গেলে সংসারের দায়িত্ব আমার কাঁধেই আসে। সংসার ও পড়াশোনার খরচ চালাতে সুপারশপে বিক্রয়কর্মী হিসেবেও কাজ করেছি। পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশের নাট্যকর্মী হিসেবেও কাজ করছি।

অভিযান শেষে
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আর পর্বতারোহণ?

এই জীবনসংগ্রামের মধ্যেও ভিন্ন কিছু করতে চাইতাম। ২০১৩ সালে যোগ দিই ‘বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবে’। পর্বতারোহণের প্রাথমিক ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছি ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ে। এরপর হিমালয়ে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নিতে থাকি। এ পর্যন্ত হিমালয়ের ‘কেয়াজো-রি’, ‘দ্রৌপদী-কা-ডান্ডা-২’ ও ‘হিমলুং’, ‘ডোলমা খাং’ পর্বতশৃঙ্গ সফল আরোহণ করেছি।

প্রশ্ন :

অভিযান তো শেষ, কবে ফিরছেন?

এখনই বলতে পারছি না। গাইড ও পোর্টারের বিল বাবদ প্রায় আড়াই লাখ টাকা প্রয়োজন। অভিযানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়ালেও এখনো সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড় হয়নি। অভিযানে খরচের জন্য নেপালের বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি। সেগুলো পরিশোধ করে দেশে ফিরতে হবে। দেশবাসীর কাছে সহযোগিতা চাই, আপনারা পাশে দাঁড়ালেই খুব শিগগিরই সফলতার আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরতে পারব।