তিস্তাপারের মায়ায় কয়েকটা দিন

কয়েক দিন ধরে তিস্তার ঘোরে আছি। বৈশাখের তপ্ত দিনে নিস্তরঙ্গ জৌলুশহীন তিস্তায় কী একটা মায়া আছে, বুঝতে পারছি না। তীরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম স্বচ্ছ জলে আমার মুখের প্রতিচ্ছবি। মনে হয়েছিল, নদীটির হৃদয়ে আমার ঠাঁই হয়ে গেছে। এ নদীর বিস্তীর্ণ দুই পারের মানুষগুলোকে বেশি মনে পড়ছে। মনে থাকবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা স্থাপনাগুলোর কথা, ঐতিহ্যের কথা। চণ্ডী গ্রামের কৌতূহলী সাধারণ মানুষের কথা। গ্রামীণ মেলার কথা। পীরগাছার রাজবাড়ির কথা। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে একেবার সোজা উত্তরে গিয়ে ওখানকার কয়েকটি জেলায় পাঁচটা দিন কাটিয়ে যা পেয়েছি, তা আমার সারা জীবনের সেরা প্রাপ্তির তালিকায় উৎকীর্ণ হয়ে থাকল।

ভাগ্যিস ভ্রমণপাগল বন্ধু এজাজ মাহমুদের প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান করেও শেষ পর্যন্ত উপেক্ষা করতে পারিনি। আমি আসলে উত্তরবঙ্গের আবহাওয়াকে ভয় পেয়েছিলাম। অনেকে বলেছিল, এই গ্রীষ্মে যাওয়াটা ঠিক হবে না। ওখানে ভয়ানক গরম। এই হবে সেই হবে। শুরুতে আমার অনাগ্রহ দেখে কবি কামরুল হাসান বাদলের মনটা যে খারাপ হয়ে যায়, সেটা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। গ্রীষ্মের দাবদাহ কিংবা কালবোশেখি, বর্ষার ঝড়জল কিংবা পৌষ-মাঘের হাড়কাঁপানো শীত—যা–ই থাকুক না কেন, সুযোগ পেলেই সে উত্তরবঙ্গে যাবে। তার দিনের ভাবনায় অন্তত একবার তিস্তাপারের একটি জনপদের কথা চলে আসে। বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে, থাকে চট্টগ্রাম নগরে, এখানেই চাকরি-বাকরি, সংসার। তারপরও তাকে রংপুর কেন টানে? রংপুরের কথা বললে আদলটা পাল্টে যায়, অবয়বে ভেসে ওঠে অন্য একটা মানুষ। একদম শিশুর মতো। যে শিশুর জন্ম রংপুরে। তিস্তা, ঘাঘট, চিকলি, দুধকুমার নদ–নদীর কলকল স্রোতের ধ্বনি শুনে যে বেড়ে উঠেছে। কোনো দিন ভুলতে পারেনি পীরগাছার জমিদারবাড়ি, রাজবাড়ির জৌলুশের কথা, দেবী চৌধুরানীর পুকুরে অবাধ সাঁতারের কথা। তাই রংপুর যাওয়ার প্রস্তাবে আমি যতই না বলছিলাম, ততই সে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে বলেই দিল, ‘চলেন কায়সার ভাই। কী আর গরম। আপনার খুব ভালো লাগবে। ওখানকার মানুষ সত্যিই ভালো।’ বাদলের কথাই সত্যি প্রমাণিত হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাউকে পরমাত্মীয় বানিয়ে মাথায় তুলে রাখতে পারে এরা।

২৬ তারিখ উড়োজাহাজে ঢাকা থেকে সৈয়দপুরে নেমেই আমাদের দেখার পালা শুরু। প্রথমেই গেলাম সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানায়। বাংলাদেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানাটির আঙিনা জাদুঘরের মতো। সাজিয়ে রাখা হয়েছে পুরোনো দিনের বাষ্পীয় ইঞ্জিনগুলো। পুরোনো কাঠামোর পাশে ঝুলে আছে একটি বড় ঘণ্টা, শ্রমিকদের ছুটি জানান দেওয়ার জন্য পুরো এলাকা কাঁপিয়ে বেজে ওঠে ঢং ঢং করে। এই ঘণ্টা আসলে শ্রমজীবী মানুষের কর্মঘণ্টা। এপ্রিলের দুপুরে দেড় শ বছরের বেশি বয়সী সেই ঘণ্টা দেখার পর আমার বুকের ভেতর কেবলই ঢং ঢং ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। আর চোখের সামনে ভাসতে থাকল, কর্মক্লান্ত অনেক মানুষ মিছিলের মতো বের হয়ে আসছে কারখানা থেকে। ক্লান্ত কিন্তু চোখে ছুটির আনন্দ। এ রকম একটি কাল্পনিক দৃশ্যের ভেতর দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম রংপুর শহরে। সেখানে পুলিশ অফিসার্স মেসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান পুলিশ কমিশনার নুরেআলম মিনা, চট্টগ্রাম জেলার দায়িত্বে থাকার সময় আমাদের পরিচয়।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার সেই ঐতিহাসিক ঘন্টা
ছবি : এজাজ মাহমুদ

বিকেলে ঘুরতে গেলাম ঘাঘট নদের তীরে। সন্ধ্যায় গেলাম বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন বিশাল বিনোদনকেন্দ্র চিকলি ওয়াটার পার্কে। শহরের হনুমানতলার শতাব্দীপ্রাচীন চিকলি বিলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই পার্ক। আধুনিক সব রাইড, কৃত্রিম জলপ্রপাত আর নৌকা ভ্রমণসহ আনন্দের নানা আয়োজন দেখে মনে মনে নিজের চট্টগ্রাম শহরের জন্য আফসোস হলো। মাত্র ৩০ টাকা দিয়ে কয়েক শ একর ভূমির ওপর একটা বিনোদনকেন্দ্রে মানুষ ঘুরে যেতে পারে।

রংপুরের দ্বিতীয় দিন সকালে প্রথমেই গেলাম মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেগম রোকেয়া সম্পর্কে পড়তে গিয়ে পায়রাবন্দের নাম শুনেছি। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল অবরুদ্ধ অন্ধকার জগৎ থেকে অবরোধবাসিনীদের মুক্ত করা। আর আমার স্বপ্ন ছিল পায়বাবন্দে গিয়ে সেখানকার মাটিকে একটু স্পর্শ করা। যে মাটি এমন আলোর জন্ম দিতে পারে, সে মাটি স্পর্শ করতে পারার পুণ্য অনুভবে চোখ ভিজে গেল। পায়রাবন্দের মাটিতে নারীর কান্নার মতো নীরবে শুয়ে আছে তাঁর বসতবাটি। তারই পাশে ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির ওপর বাংলা একাডেমি গড়ে তুলেছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। সেখানে গিয়ে দেখলাম কয়েকজন পাঠমগ্ন কিশোর–কিশোরীকে। কিন্তু গ্রন্থাগারটিতে সম্প্রতি প্রকাশিত কিংবা হাল আমলের বই আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে হলো।

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পথে যাঁর আলোয় আমরা চমকিত হলাম, তিনি হলেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বেগম রোকেয়ার জন্মস্থানে গড়ে তুলেছেন বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগার। রফিকের পাঠাগারে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দেশে–বিদেশে যত বই, সংকলন, গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, সব সংগ্রহে আছে। বেগম রোকেয়া এভাবে যুগের পর যুগ আলো ছড়াবেন। সেই রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলো। তাঁকে নিয়ে প্রথম আলো প্রতিবেদন করার পর অনেকের কাছে তিনি একটি প্রিয় পরিচিত নাম। তাঁর পাঠাগার থেকে বেগম রোকেয়ার বই সংগ্রহ করলাম। রফিকুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধায় মনটা কোমল হয়ে গেল। পূর্বপুরুষের প্রতি ঋণ শোধের এ এক আশ্চর্য সাধনা। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এসে আমরা গেলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাজহাট জমিদারবাড়ি ও রংপুর কারমাইকেল কলেজের বিশাল ক্যাম্পাসে।

অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংসের শেষ প্রান্তে থাকা দিনাজপুর রাজবাড়ি
ছবি: রকিব হাসান

বাদলের শৈশবের স্মৃতির পীরগাছার দিকে যখন যাত্রা শুরু করি, তখন সূর্য দক্ষিণের প্রান্ত ফেলে পশ্চিমে যাত্রা শুরু করেছে। গ্রীষ্মের দীর্ঘ বিকেলজুড়ে দুই পাশের বিস্তীর্ণ ভুট্টাখেতের সবুজের মায়ার ভেতর ক্রমে যেন একটা হারিয়ে যাওয়া কিংবা লুপ্ত কোনো সাম্রাজ্য আবিষ্কারের দিকে যাচ্ছি। পীরগাছা উপজেলার একেকটা গ্রাম পেরিয়ে যতই এগোচ্ছি, ততই উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বাদলকে জিজ্ঞেস করছি, চিনতে পারবে? সে বলল, ‘বাবা রেলওয়ে থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম চলে যাই। তখন আমি জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।’
এখন ওটা দেখলে চিনবে? তাকে জিজ্ঞেস করি।
বলল, ‘পীরগাছা বাজারের মোড়ে একটা বড় বটগাছ ছিল।’

বটগাছটির কথা সে বারবার বলেছে। বুঝলাম, অর্ধশতাব্দীকাল আগের বটগাছটি এখনো তার ভেতরে অক্সিজেন ছড়াচ্ছে। যা–ই হোক, আমাদের মনে সন্দেহ, সে কি আসলে কিছু চিনতে পারবে? ১৯৮০ সালে একবার, এরপর ১৯৯৬ সালে এসেছিল। মাঝখানে বিস্তর ব্যবধান। সংশয় নিয়ে আমরা যেতেই থাকলাম। ততক্ষণে দিনের রং পাল্টাতে শুরু করেছে। নীরব, নির্জন গ্রামে সবুজ ভুট্টাখেতের ওপর সোনালি আলোর প্রলেপ পড়েছে। গুয়ামারী, পবিত্রঝাড়সহ নানা গ্রাম পেরিয়ে শান্ত বিকেলে হঠাৎ কোলাহল পেলাম। গাড়ির জ্যাম লক্ষ করলাম। একটা বড় দিঘির পাশে রাস্তাটি। তার পাশে শত শত মানুষের ভিড়। কোলাহল। বাঁশির আওয়াজ। নাগরদোলার শব্দ। মাইকে ঘোষণা। বিচিত্র রঙের সম্মিলন। মানুষের কী আনন্দ! এমন খাঁটি গ্রামীণ মেলা কত দিন পর দেখলাম! বাদল বলল, ‘মেলা দেখব।’ এটা মনে হয় আমার শৈশবের সেই চণ্ডী মেলা।

বাদলের স্মৃতি বিজড়িত পীরগাছার চণ্ডী মন্দির
ছবি: এজাজ মাহমুদ

গাড়ি থেকে নেমেই আমরা দেখলাম বহু বছরের পুরোনো একটি ভাঙা মন্দির। লোকজন জানাল, এটি চণ্ডীমন্দির। গ্রামের নাম চণ্ডীপুর। নজরে পড়ল নাগরদোলা। নানা বয়সী মানুষ সেখানে আনন্দে আত্মহারা। তারা একবার ওপরে উঠছে আবার মাটিতে ফিরে আসছে। মনে হলো, বাদল যেন এত দিন একটা অতিকায় নাগরদোলায় চেপেছিল। আর এইমাত্র নিজের মাটির স্পর্শ পেল। তখন দিনের আলোও কমে এসেছে। এক আলো-আঁধারির রহস্যময় সময়ে অবশেষে তার শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। দেখলাম জমিদার জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ রায়ের বাড়ি। পুরোনো দুর্গামন্দির, চণ্ডীমন্দির। গেলাম তার বিদ্যাপীঠের মাঠে। সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় মানুষেরা। সন্ধ্যার অন্ধকারে তারা হৃদয়ের আলো দিয়ে আমাদের পথ দেখাল। আর সেই আলোয় আমাদের সহযাত্রী একে একে উদ্ধার করতে লাগল তার স্মৃতিচিহ্নগুলো। যেন সে এত দিন স্মৃতিভ্রষ্ট একটা মানুষ ছিল। আজ সে ফিরে পাচ্ছে তার স্মৃতি। এজাজ ঠাট্টার ছলেই বলছিল স্মৃতি ফিরে পাওয়ার কথা।

তৃতীয় দিনে দেখলাম ভারতের অভ্যন্তরে এক টুকরা বাংলাদেশ। এ নিয়ে কত কথা। ছোটবেলায় শুনে অবাক হতাম আর ভাবতাম, কী করে একটা দেশের ভেতরে অন্য একটা দেশের অংশ থাকতে পারে? মনে মনে সেই জায়গা দেখার স্বপ্ন দেখতাম। সেখানকার মানুষ, যারা ভারতের ভেতরে থেকেও বাংলাদেশি, তাদের মানসিক অবস্থা কী, সব সময় জানতে ইচ্ছা করত। তাদের ভেতরে কি একটা দ্বৈত অনুভব কাজ করে? নাকি বঞ্চনার উত্তরাধিকার কাঁধে বইতে বইতে তাদের মধ্যে ‘কোথাও নই, কারোরই নই’—এ রকম একটা বোধ কাজ করে।

বাংলাদেশের আঙ্গরপোতা গ্রাম, পেছনে ভারতের কুচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমা
ছবি: রকিব হাসান

বহুদিনের কৌতূহল এবার মেটালাম। বিখ্যাত তিন বিঘা করিডর পেরিয়ে ঘুরে বেড়ালাম আঙ্গুরপোতা ও দহগ্রাম। এই দুটি ছিটমহল লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দুটি ইউনিয়ন। এর তিন দিকে ভারতের কোচবিহার জেলা, একদিকে তিস্তা নদী, নদীর ওপারে ভারতীয় ভূখণ্ড। আঙ্গুরপোতার একেবারে শেষ প্রান্তে ভারতের সীমানায় কোনো কাঁটাতার নেই। একটা পাকা সীমানাচিহ্ন খুঁটির মতো বসানো হয়েছে। একদিকে ইংরেজিতে ইন্ডিয়া, আরেক দিকে বাংলাদেশ লেখা। ওখানটায় একটি ভারতীয় চা–বাগানের শেষ প্রান্ত। চা–বাগানের গাছের ছায়ায় ভারতের সীমান্ত প্রহরীকে দেখা গেল। এখানে একজন কৃষকের দেখা পেলাম। তখন দুপুর। তিনি একটি লিচুগাছের চারা রোপণ করছিলেন। কাজে মগ্ন মানুষটি আমাদের সব কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন। জানতে চাইলাম, তাঁর বাড়ি থেকে তো ভারত কাছে, বাংলাদেশ দূরে। তো কাজকর্মে কিংবা বাজারসাজার করতে অথবা বেড়াতে তিনি নিশ্চয় ভারত যান? দুই কদম এগিয়ে গেলেই তো ভারত। তিনি বললেন, কাঁটাতার নেই কিন্তু নিষেধের তার তো রয়েছে। পরানের ভয় আছে না? তিনি আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন, ভারতের সীমানায় একটি পাকা ঘর। সেখানে ওদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। তিনিই জানালেন, তাঁদের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করেন। অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ তেমন নেই। দিনকাল কেমন যাচ্ছে জানতে চাইলে বললেন, ‘মা–বাবার কাছে শুনেছি, শৈশবেও দেখেছি, মূল বাংলাদেশে যেতে তখন খুব কষ্ট ছিল।’ এখন যখন ইচ্ছা যাওয়া যায়। এটা তাঁদের জন্য বড় স্বস্তি। ভারতীয় গরু বাংলাদেশে আসা নিয়ে মজার তথ্য দিলেন তিনি। আঙ্গুরপোতা, দহগ্রামে গরুরও জন্মনিবন্ধন করতে হয়! গরু চোরাচালান ঠেকাতে সরকারের এ ব্যবস্থা।

ঘোরাঘুরির মাঝখানে বিশ্রাম নিয়েছিলাম দহগ্রাম পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে। তাদের আতিথেয়তায় প্রাণ ছুঁয়ে গেল। কেন্দ্রের পাশে ছোট মসজিদে গেলাম জুমার নামাজ পড়তে। মনে আশা ছিল স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলার। তারা কথা বলে কম। উচ্চ স্বরে কথা বলে না। ভারতের সীমানার ভেতর বাংলাদেশ থেকে আমরা চলে এলাম পাটগ্রাম। মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করলেন পাটগ্রাম থানার ওসি ওমর ফারুক। পুকুরের মাছ আর খেতের তরিতরকারিতে পেট ভরানোর পর চোখ বুজে আসছিল। কিন্তু আমাদের চোখ বুজলে চলবে না। দিন শেষ হওয়ার আগেই দেখতে হবে বুড়িমারী স্থলবন্দর।

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দরে
ছবি: রকিব হাসান

পাটগ্রাম থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বুড়িমারী বন্দর দিয়ে দুই দেশ থেকে মানুষের আসা–যাওয়া দেখলাম। এই স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পর্যটকেরা দার্জিলিং-সিকিম-ভুটান-নেপাল যায়। তবে ইদানীং পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরই অনেক সহজ পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের সঙ্গে ভুটান ও নেপালের আমদানি–রপ্তানির পণ্য এই বন্দর দিয়েই যাওয়া–আসা করে। ফেরার সময় জ্যোৎস্না বলেছিল, এই বন্দর দিয়ে কোনো দিন দার্জিলিং গেলাম না। জীবনের কতটা বছর পার করে এলাম অথচ কত কিছু দেখার বাকি রয়ে গেল। তিনটা দিন কেমন করে যেন কেটে গেল একটা ঘোরের ভেতর। আমি বলি, ঘোরের ভেতর নয়, মায়ার ভেতর।

দিনাজপুরে কেটেছে চতুর্থ দিন। সেখানে আমাদের জন্য নানা ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। ভ্রমণে পর্যটকেরা শুধু প্রকৃতি আর স্থান দেখে, তা নয়; ভ্রমণে মানুষও দেখা যায়। এই পৃথিবীতে যত কোটি মানুষ আছে, তত কোটি হৃদয়। একেকজনের হৃদয়, একেকজনের মানসিকতা একেক রকম। ভ্রমণে গেলে মানুষকে পাঠ করা যায়। এই চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে। দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের উৎকীর্ণ টেরাকোটায় রামায়ণ, মহাভারতের আখ্যানগুলোর সচিত্রকরণ হয়েছে। একেকটি ফলক দেখিয়ে দেখিয়ে রামায়ণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাক্রম আমাদের কাছে বর্ণনা করলেন মন্দিরের গাইড। মানুষটি দেখতে শীর্ণকায়। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তিনি যে পুরো রামায়ণ ধারণ করে বসে আছেন, সেটা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। এ রকম নানা বিস্ময়ের ভেতর দিয়ে আমি আর জ্যোৎস্না আলাদা হয়ে যাব পুরো দল থেকে। বাদল, এজাজ, শোয়েব, বন্যা থেকে যাবে। তারা আরও উত্তরে বাংলাদেশের সর্বশেষ সীমান্ত তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যাবে। আর আমরা ফিরে যাব। প্লেনের টিকিট না পাওয়ায় ট্রেনে ফেরার উদ্যোগ, নীলসাগর রাত সাড়ে নয়টায় পার্বতীপুর থেকে ছাড়বে। দিনাজপুর শহর থেকে পাবর্তীপুর গাড়িতে মাত্র ৪০ মিনিটের পথ।

দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটা
ছবি: শোয়েব ফারুকী

রাত নয়টায় পার্বতীপুর শহীদ মিনারের কাছে পৌঁছেই ফোন যোগাযোগে দেখা মেলে মামুন ভাইয়ের। তিনি পার্বতীপুর পৌর মেয়র আমজাদ হোসেনের ছোট ভাই। ট্রেনের টিকিট নিয়ে আমাদের এগিয়ে দিতে অপেক্ষায় আছেন। গাড়ি থেকে নেমে আমি তাড়াহুড়া করতে লাগলাম। মনে তখন নানা উৎকণ্ঠা। অচেনা জায়গা। কীভাবে ট্রেনে উঠব। লাগেজ কীভাবে তুলব। আসন পাব। মামুন ভাই বুঝলেন, আমি খুব চিন্তিত। তিনি আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ‘ট্রেন আপনাকে না নিয়ে পার্বতীপুর ছাড়বে না। আপনারা আসনে বসার পর হুইসেল বাজবে।’ বলেই হো হো করে হাসলেন।

মানুষটাকে এই প্রথম দেখা, কখনো নামও শুনিনি। এজাজই টিকিটসহ সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল দিনাজপুরের পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদের মাধ্যমে। জেলার বড় কর্তাটি মধ্যাহ্নভোজে আমাদের সঙ্গও দিয়েছিলেন। মামুন ভাইয়ের সঙ্গে আলাপে মনে হলো না একমুহূর্তের পরিচয়। তিনি আমাকে টিকিট দেখালেন, কিন্তু হাতে দিলেন না। বললেন চলেন। আমরা পিছু নিলাম। ভাবলাম স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন স্টেশনের কাছে তাঁদের একটি ক্লাব ঘরে। আমি বললাম, ট্রেনের সময় তো হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘ট্রেন আসুক। পরিচয়ের প্রথম দিনেই না খেয়ে চলে যাবেন!’ আমি অবাক এবং কিছুটা বিরক্তও হলাম, মনে মনে। ট্রেনের সময় দেখছি আর পাঁচ মিনিট। তিনি আমার কোনো কথা শুনবেন না। বলেন, ‘কী আনাব? কী খাবেন?’ এজাজ আমাকে বলল, সারা রাত ট্রেন জার্নি করবেন। কিছু খেয়ে যান। আমি বললাম, খেতে গিয়ে ট্রেন ফেল করব। মামুন ভাই বললেন, ‘ট্রেন দুই ঘণ্টা লেট। আপনি ভয় পাবেন না।’ একটু পর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন পাবর্তীপুরের নতুন মেয়র আমজাদ হোসেন। সঙ্গে তাঁর অনুসারীর বহর। পরিচয়ের মুহূর্তেই তিনি অলৌকিক জাদুর বলে হয়ে গেলেন জন্মজন্মান্তরের আত্মীয়। একে একে বলতে লাগলেন জীবনের মজার সব ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতার কথা। ফাঁকে ফাঁকে পার্বতীপুরের বিখ্যাত সব খাবার আসতে শুরু করে। মালপোয়া, দই, রসগোল্লা, চিকেন কাবাব, পরোটা। খেতেই হবে। এমন জবরদস্তি আবদার। আমরা শুধু হঠাৎ পাওয়া পরমাত্মীয়ের আতিথেয়তায় বিমূঢ়। আমাদের সময় কী ভয়ানক দ্রুতগতিতে পেরিয়ে গেল, বুঝলাম না। পার্বতীপুর স্টেশনের খোলা প্ল্যাটফর্মে বৈশাখের চাঁদনি রাতে আমাদের সেই দিনের মুখর আড্ডা আমার জীবনের স্মৃতিময় দিনগুলোর একটি।

ট্রেন দুই ঘণ্টা নয়, চার ঘণ্টা বিলম্ব। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে, তারিখ পাল্টে গেছে। রাত একটায় অবশেষে ট্রেন এসেছে। এই স্টেশনেরও স্টেশনমাস্টার ছিলেন বাদলের বাবা, তার জন্মের আগে। সেই প্রাক্‌–জন্মের কোনো স্মৃতি কিংবা মানুষের উত্তরাধিকার কি না, জানি না এই সব মানুষ। তাঁরা আমাদের এমন করলেন কেন? সেই গভীর জাদুর রাতে আমাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে, আসনে বসিয়ে, ট্রেনের লোকজনদের বলে দিয়ে তাঁরা প্ল্যাটফর্মে নামলেন। ট্রেন ছাড়ল ধীরে। তাঁদের মায়াময় হাতগুলো দুলতে থাকল। সেই দোলা আমার চোখ দুটোকে আর্দ্র করে দিল। এমন মায়ার রাত মানুষের জীবনে খুব কম আসে।