ঢাকা থেকে একটু দূরেই ১৬০ বছরের পুরোনো এই বাড়ি

রায়বাড়ির উত্তরসূরিদের অনুমতি নিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন পুরোনো বাড়িটিছবি: এলিজা বিনতে এলাহী

গাঙ্গুটিয়া কোন দিকে?

ধামরাই উপজেলা সদরে গিয়ে একে একে জনা দশেক মানুষকে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ বললেন এলাকার নামটি প্রথম শুনলেন, কেউ বললেন চেনেন না। এ রকম চলতে চলতে সঠিক তথ্য পেলাম যাঁর কাছে, তিনি বললেন, ‘সোজা ১৫ কিলোমিটার যাবেন। সাইনবোর্ডে বারবাড়িয়া এলাকার নাম লেখা দেখে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বাকি পথ চিনিয়ে দেবে।’

তাঁর দেখানো পথে এগোতে থাকলাম। আসলে ধামরাই সদর থেকে ১৫ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি পথ গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়ন। অনেক কিছু বদল হলেও আমরা যে বাড়িতে যাব, সেখানে যাতায়াতের পথ বদলায়নি। বছর পাঁচেক আগের মতোই ইটবিছানো সরু পথটায় পাশাপাশি দুটি বাহন চলতে পারে না।

গাঙ্গুটিয়া জমিদারবাড়ি
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহী

ইটের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দুই পাশের সবুজ ধানখেত, গাঙ্গুটিয়ার ছোট বাজার, মাটির বাড়িগুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। খাঁ খাঁ তপ্ত দুপুরেও মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। সেখানে পৌঁছে খুঁজে পাওয়া গেল বাড়িটিও—গাঙ্গুটিয়া জমিদারবাড়ি।

রায়বাড়িতে পৌঁছে দেখি গেট বন্ধ। কথা বলার জন্য আশপাশে যখন কাউকে খুঁজছিলাম, তখন একজন নারী এলেন। তিনিও ভেতরে প্রবেশ করবেন। রায়বাড়ির উত্তরসূরিরা অতিথিদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেন। সেই অনুমতি নিতে হয় আগেই। অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজন তরুণ এসে সদর দরজা খুললেন। তরুণটি সে রকম কিছুই জিজ্ঞেস করেননি। আমি নিজ থেকেই আগমনের উদ্দেশ্য বললাম। তিনি ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।

আরও পড়ুন
জমিদারবাড়িতে যাওয়ার পথ
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহী

ভেতরে প্রবেশ করতেই হাতের বাঁ দিকে একটি সীমানাঘেরা দেওয়া জায়গা চোখে পড়ল। সোজা তাকালে দেখা যায়, একতলা একটি ভবনের সংস্কারকাজ চলছে। ভবনের সামনের পিলারগুলোর গায়ে চিনি–টিকরির কারুকাজ। ওপরে ছাদের সম্মুখভাগে প্রাণী ও নারীর প্রতিমূর্তি। ধীর পায়ে এগোলাম। একাধারে কয়েকটি স্থাপনা। লম্বা একটি সারি। একেকটি স্থাপনা একেক রকম—কোনোটি একতলা, কোনোটি দ্বিতল। কোনোটি কিছুটা ক্ষয়ে গেছে। আবার কোনোটি ক্ষয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। জানালা ও দরজাগুলোতে ইউরোপীয় আদলে আয়রনের কারুকাজ। বসতবাড়িগুলোর সারিতে সরু প্রবেশপথ রয়েছে আরও ভেতরে যাওয়ার জন্য। জানি না অন্দরমহল বলা ঠিক হবে কি না। সেই পথ ধরে ভেতরে গেলাম। প্রবেশপথে লেখা রয়েছে গোবিন্দ ভবন। স্থাপনকাল ১২৭০ বঙ্গাব্দ। ভেতরের অবস্থা আরও বেশি ক্ষয়ে যাওয়া। কিছু ভবন স্যাঁতসেঁতে। ভেতরের ভবনগুলোর মধ্যে একটি ভবনের বারান্দার পিলারগুলো দেখলাম গথিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। বাকি ভবনগুলোর স্থাপত্যশৈলী উনিশ কি বিশ শতকের বাড়ির মতোই। গথিক স্থাপত্যের মতো সেই বারান্দা ধরে পথ চললে সামনেই একটি দিঘির দেখা মিলবে।

দিঘির ঘাট নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। এই বাড়িতে অনেক পাতকুয়া বা ছোট জলাধার আছে। একটি দেখতে পেলাম। আবারও বারান্দা ধরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম!

দেখলাম একজন নারী কাজ করছেন। এগিয়ে গিয়ে কথা বললাম। তাঁর নাম প্রতিমা সাহা। তিনি জমিদার গোবিন্দচন্দ্র রায়ের প্রপৌত্রের ঘরের নাতবউ। প্রতিমা সাহার কাছেই এই বাড়ির ইতিহাস জানলাম। এখন এ বাড়িতে বসবাস করছে জমিদারের সপ্তম বংশধর। তাঁরা সবাই মিলে কিছু সংস্কারকাজে হাত দিয়েছেন।

প্রতিমা সাহার সঙ্গে লেখক
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহীর সৌজন্যে

গোবিন্দচন্দ্র রায়ের ছয় ছেলে এক মেয়ে ছিল। প্রতিমা সাহা জানালেন, ছয় ছেলের জন্য ছয়টি ভিন্ন ভবন নির্মাণ করেন গোবিন্দচন্দ্র। ভবনের দরজায় লেখা বাংলা সাল থেকে অনুমান করা যায়, এই বাড়ির বয়স ১৬০ বছরের মতো।

প্রথমে প্রবেশমুখে বাউন্ডারি দেওয়া যে জায়গাটা ছিল, সেটি সমাধিভূমি আর যে ভবনের কাজ চলছিল, সেটি ছিল বৈঠকখানা বা কাছারি ঘর। প্রতিমা সাহা বললেন, কাছারি ঘরের বয়স ১০০ বছর। ৬টি ভবনের সঙ্গে ৬টি কুয়া আছে।

১৯৭১ সালে গোবিন্দচন্দ্র রায়ের বংশের চারজনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। গোবিন্দ ভবনের চত্বরে তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে স্মৃতি সমাধি আছে। বর্তমানে ভবনগুলো রামগোপাল রায়, স্বদেশরঞ্জন রায়সহ গোবিন্দচন্দ্র রায়ের ছয় ছেলের পরবর্তী প্রজন্ম বসবাস ও দেখাশোনা করেন।

প্রতিটি ভবনের সঙ্গে আছে এমন কুয়া
ছবি: এলিজা বিনতে এলাহী

জমিদারবাড়ি দর্শন শেষ হতে হতে বৈশাখের গরম অনুভূত হলো। প্রতিমা সাহার কাছে বিদায় নিয়ে ধীরে ধীরে মূল ফটকের দিকে গেলাম। জমিদারবাড়ির কোল ঘেঁষে গাজীখালী নদী। এই ভরদুপুরেও নদীতে ছিপ ফেলে বসে আছেন জেলেরা। নদীতে পানি এখন অনেক কম। গাজীখালী নদী মানিকগঞ্জ জেলায় পড়েছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি ঢাকা জেলার গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নে, নদীর ওপারেই দেখতে পাচ্ছি মানিকগঞ্জ জেলা।

গাঙ্গুটিয়া জমিদারবাড়িটি একটি সীমান্তবর্তী বাড়ি। ধামরাইয়ের গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়ন শেষ হলো, শুরু হলো মানিকগঞ্জ জেলা। একবিংশ শতকেও এই এলাকা কোলাহলমুক্ত। এখানে আসার সরু একটি ইটের পথ। ১৮৬৩ সালে এই অঞ্চল কেমন ছিল, ভাবার চেষ্টা করলাম। তখন কি পথ ছিল, না একেবারে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল? এই গাজীখালী নদীই হয়তো ছিল চলাচলের একমাত্র পথ। হয়তো এ কারণেই নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিল এই ধ্রুপদি স্থাপত্য। গাজীখালী নদী ও গোবিন্দ ভবনের যৌবন আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম।

রাজধানীর এত কাছে, আপনিও ঘুরে আসতে পারেন এক দিন সময় করে।