এক দিনে ঘুরে আসুন ঢাকার অদূরের এই দুই জমিদারবাড়ি
বৃষ্টি নামতে পারে এই আশঙ্কার মধ্যেই ঢাকা থেকে গাড়ি ছুটতে শুরু করল। শশীর অনুরোধে আসিফ ভাই গান ধরলেন, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…’।
আমি বসেছিলাম মাইক্রোবাসের সামনে চালকের পাশের সিটে। গানটা শুনতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা মুখ। মুহূর্তেই সব উচ্ছ্বাস যেন হারিয়ে গেল। গান থামলে কিংশুক ভাই পেছনের সিট থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, চুপচাপ কেন?’
তারপর গল্প, স্মৃতিচারণা, হাসি-মজা করতে করতে পৌঁছলাম তেওতা জমিদারবাড়ি।
জনশ্রুতি আছে, মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এই জমিদারবাড়িতে বসেই ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ’ গানটি লিখেছিলেন নজরুল। শিবালয় উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক স্থাপন করা তথ্য বোর্ডেও নজরুলের সঙ্গে জমিদারবাড়ির সম্পর্কের বিষয়টি চোখে পড়ল। পঞ্চানন সেন নামের একজন জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। মূল ভবনটি লালদিঘি ভবন নামে পরিচিত।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ছবি তুলে ভবনের ভেতরে গেলাম। উঠানের মতো ফাঁকা জায়গা। তার চারপাশে ভবন। দুটো ঘোড়া সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে দেখে পুরোনো দিনের জমিদারবাড়ির ছবি ভেসে উঠল চোখে। ভবনের কিছু কিছু জায়গায় অযত্ন-অবহেলার ছাপও দৃষ্টি এড়াল না। আদিত্য ভাই ভবনের স্থাপত্যশৈলী বিষয়ে বললেন। ওপরতলার বেশির ভাগ ঘরের আগেই বারান্দা। তা ছাড়া দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন নকশা ও র্যাকের আদলে করা ফাঁকা জায়গাও চোখে পড়ল। হয়তো সেখানে নানা শৌখিন সংগ্রহ সাজিয়ে রাখা হতো। একটি ভবনের ওপরে খোলা ছাদ। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না। ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। দৌড়ে ঘরের ভেতর গেলাম। ঠিক হলো প্রত্যেককে জীবনের একটি করে সিক্রেট শেয়ার করতে হবে। সবুজ ভাই জীবনের দৃঢ়তম বেদনার কথা কিছুটা আড়াল রেখেই বললেন। লায়লা আপা, শশী, কিংশুক ভাই, আসিফ ভাই, সেতু আপাও শেয়ার করলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা। অনামিকা নিজে কিছু না বললেও গোয়েন্দাদের মতো প্রশ্ন করে করে আমার থেকে অনেক কিছু জেনে নিলেন।
ভবন ঘুরে রাস্তার পাশের দোলমঞ্চ দেখতে গেলাম। তারপর গেলাম পুকুরপাড়ে। কবি নজরুল ও প্রমিলা দেবীর ছবি দেয়ালে খোদাই করে বাঁধানো সেখানে। ঘাটটাও সুন্দর। পাড়টা টাইলস করা। আমরা নজরুল ও প্রমীলা দেবীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দলবেঁধে ছবি তুললাম। গাড়িতে ওঠার সময় একটি জিজ্ঞাসা জাগল মনে, জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত জমিদারবাড়ি সংরক্ষণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হতে আরও কত দেরি হবে?
সবার পেটে খিদে। দুপুর দুইটা বাজে ঘড়িতে। আরিচা ঘাটে গিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। সরু পাকা রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় গাড়ির জানালা নামিয়ে যমুনার জল দেখতে দেখতে আরিচা ঘাটে পৌঁছলাম। বৃষ্টি পড়ছে দেখে সবাই বললেন, এখানে না, মানিকগঞ্জ শহরে গিয়ে খাব। ঘনঘোর বরষামুখর পরিবেশ। প্রকৃতির পরশে সবাই মুগ্ধ। শহরে পৌঁছে একটি রেস্তোরাঁ থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে গেলাম সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে। এই গ্রামেই আকাশের দিকে সগর্বে মাথা তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সাতটি প্রাসাদ। প্রাসাদগুলো বালিয়াটি জমিদারবাড়ি নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রয়েছে ভবনগুলোর তত্ত্বাবধানে। রোববার সাপ্তাহিক বন্ধ। সোমবার দুপুর দুইটা পর্যন্ত খোলা থাকে। বাকি পাঁচ দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে কার্যক্রম। দর্শনার্থীদের প্রবেশের জন্য টিকিট কাটতে হয়। টিকিটের মূল্য ৩০ টাকা।
টিকিট নিয়ে বাড়ির ভেতর গেলাম। শুরুতেই প্রবেশদ্বারের ওপর সিংহের মূর্তি চোখে পড়ল। সাতটি প্রাসাদের চারটির অবস্থান সামনের দিকে আর তিনটির পেছনের দিকে। ভবনগুলোর স্থাপত্যশৈলী বড় নজরকাড়া, নান্দনিক। গোবিন্দ রাম সাহা নামের এক জমিদারের হাতে জমিদারবাড়ির কাজ শুরু হয়। লবণ ব্যবসায়ী হিসেবে নাম ডাক ছিল তাঁর। পরবর্তীকালে তাঁর চার পুত্র দধীরাম, পণ্ডিতরাম, আনন্দরাম ও গোলাপরামের হাতেই ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ জমিদারবাড়ি নির্মাণ হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে।
টিপটিপ করে বৃষ্টি তখনো পড়ে চলেছে। ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখছি। নান্দনিক সীমানাপ্রাচীর, বড় লিচুগাছ। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান।
বাড়ির পেছনের দিকটাও ছায়াময়, মায়াময়। রাস্তার দুই ধার দিয়ে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরঘাটে গেলাম। আগে পুকুরে সাতটি ঘাট ছিল। কিন্তু পূর্ব পাশের একটি ঘাট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ছয়টি ঘাট আছে এখন। তা ছাড়া উত্তর-পশ্চিম কোণে জোয়ার-ভাটা প্রবাহিত হওয়ার জন্য একটি সুড়ঙ্গ বা চ্যানেল ছিল। একপাশে ছোট ছোট কিছু ঘরও চোখে পড়ল। আকাশে তখনো মেঘ, বৃষ্টি পড়ছে, চারপাশটা সুন্দর। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে গল্প, আলোচনা করে জাদুঘরে গেলাম। ক্যাশ বাক্স, নামফলক, পূজার আসন, দেয়াল আয়না, আলমারি, ফুলদানি, গ্রামোফোন কী নেই সেখানে। ঝাড়বাতিগুলো সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজেকে জানান দিচ্ছে। ঝাড়বাতিগুলোর একটির একটি অংশ ব্যতীত বেশির ভাগই অক্ষত আছে। বেশ কিছু লোহার সিন্দুকও চোখে পড়ল নিচতলায়।
রংমহল থেকে বেরিয়ে প্রাসাদের সামনে বসে ফটোসেশন করে গাড়িতে উঠলাম। ভীষণ বেগে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল।
যেভাবে যাবেন
তেওতা জমিদারবাড়ি: ঢাকা থেকে আরিচা ঘাট যেতে হবে। তারপর আরিচা ঘাট থেকে জমিদারবাড়ি। গাবতলী থেকে বাসে করেও আরিচা ঘাট যাওয়া যায়। আর আরিচা ঘাট থেকে ইজিবাইক, সিএনজিযোগে জমিদারবাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
বালিয়াটি জমিদারবাড়ি: ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জগামী বাসে গেলে সাটুরিয়া বাস স্টপেজে (সাটুরিয়া জিরো পয়েন্ট) নামতে হবে। জিরো পয়েন্ট থেকে জমিদারবাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি, ইজিবাইক পাওয়া যায়। জিরো পয়েন্টে নেমে যেকোনো ইজিবাইক বা সিএনজিচালককে বললেই নিয়ে যাবে।