সূর্যোদয় দেখলাম ছয় হাজার মিটার উঁচুতে বসে
এক অভিযানেই হিমালয়ের চারটি পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছেন বাংলাদেশের দুই অভিযাত্রী সালেহীন আরশাদী ও ইমরান খান। তার মধ্যে তিনটির উচ্চতা ছয় হাজার মিটার। ১০ দিনের মূল অভিযানটি শেষ হয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর। চার পর্বতশৃঙ্গের অন্যতম কাং ইয়াৎসে-২ জয়ের অভিজ্ঞতা লিখেছেন সালেহীন আরশাদী
তাঁবুর ভেতরটা হেডল্যাম্পের আবছা লালচে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। বাইরের তীব্র ঠান্ডা। নিশ্বাস পর্যন্ত ঘন ধোঁয়া হয়ে লালচে আলোতে খেলা করছে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই আমরা রাতের খাবার সেরে ফেলেছি। ইচ্ছা ছিল তিন কি চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে নেব। রাত ১১টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পোশাক–আশাক পরে রাত ১২টার দিকে ‘সামিট পুশে’ (আরোহণের চূড়ান্ত পর্ব) বেরিয়ে যাব। সেভাবেই অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি; কিন্তু উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তায় ঘুম আর এল না। পাশেই ওজিল (সহ–অভিযাত্রী ইমরান খান) তাঁর স্লিপিং ব্যাগের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে মড়ার মতো পড়ে আছে। আমি একটু পরপর ঘড়ি দেখছি আর অপেক্ষা করছি কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
অ্যালার্ম বেজে ওঠার আগেই বন্ধ করে দিলাম। ওজিলও একই সময়ে উঠে বসল। সবার আগে গ্যাস স্টোভটা জ্বালিয়ে কফির জন্য পানি বসিয়ে দিলাম। পানি গরম হতে হতে ডাউন জ্যাকেট, ওয়াটারপ্রুফ ট্রাউজার, বালাক্লাভা দিয়ে কান–মুখ ঢেকে বাইরের মাইনাস ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিলাম। এর মধ্যেই গরম–গরম কালো কফি তৈরি হয়ে গেল। এমন ঠান্ডায় গরম কিছু গলা দিয়ে নামলেই ভালো লাগে, ক্যাফেইন এখন খুব জরুরিও। আগামী ১৫ ঘণ্টা আমাদের কঠিন পরিবেশের মধ্যে আরোহণ করতে হবে। ক্লাইম্বিং বুট পায়ে দিয়ে আগে থেকেই তৈরি করে রাখা ডে-প্যাকটি কাঁধে নিলাম। তারপর তাঁবু থেকে বের হয়ে গেলাম।
১২টা বাজতে তখনো কয়েক মিনিট বাকি। তাঁবুর ভেতর ও বাইরের তাপমাত্রায় আহামরি কোনো তারতম্য না থাকলেও তাঁবু থেকে বের হওয়ার সময় মনে হয়, ভেতরে এতক্ষণ অনেক বেশি উষ্ণ ছিলাম। এটি বোধ হয় একটি মানসিক বোধ।
আজ পূর্ণিমা
পর্বতারোহণের জন্য চমৎকার আবহাওয়া। হালকা ফিনফিনে বাতাস বইছে। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। ঘটনাচক্রে আজ আবার পূর্ণিমা। গুটিকয় তারাও জ্বলজ্বল করছে। সামনে ভারতীয় দলের কয়েকটা তাঁবু। কোনো একটার ফ্ল্যাপ বোধ হয় খুলে গেছে। বাতাসে পতপত করে আওয়াজ করছে। আজ রাতে তাদেরও সামিট পুশে বেড়ানোর কথা রয়েছে।
পশ্চিম হিমালয়ের মারখা উপত্যকায় আছি আমরা। এটি ভারতের লাদাখের হেমিস ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত। ৫ সেপ্টেম্বর আমরা লাদাখের প্রধান শহর লেহতে পৌঁছাই। আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর বেজক্যাম্পের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করি। দুই দিন পরে কাং ইয়াতসে–২–এর বেজক্যাম্পে এসেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ১০০ মিটার উঁচুতে এই বেজক্যাম্প। এক দিন আগে এখানে এসেছি আমরা। আমাদের অভিযানের নাম ‘গোজায়ান এক্সপেডিশন লাদাখ’। গতকাল রাতেই সামিট পুশের ইচ্ছা ছিল, আবহাওয়া বিরূপ থাকায় এক দিনের অপেক্ষা। ঝোড়ো বাতাসের মধ্যেই গতকাল যে দুজন স্প্যানিশ অভিযাত্রী আরোহণের চেষ্টা করেছিলেন, বিধ্বস্ত অবস্থায় সামিট না করেই আজ সকালে ফেরত এসেছেন তাঁরা। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো আছে, কিন্তু পর্বতে বাতাসের গতি পাল্টে যেতে তো নিয়মের বালাই নেই।
ধীরে ধীরে উপত্যকার শেষ মাথার শেষ তাঁবুটিও অতিক্রম করে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। এখন আমাদের পশ্চিম ঢাল দিয়ে উঠে যেতে হবে। অনেক ওপরে একটি ‘স্তুপা’ বোঝা যাচ্ছে। সেই পথেই চড়াই শুরু করলাম। হিমালয়ে পথনির্দেশক হিসেবে পাথরের ওপর পাথর বসিয়ে স্তুপা বানিয়ে রাখেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এটি মূলত তিব্বতীয় রীতি; কিন্তু হিমালয়ের সব অংশেই এটা দেখা যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা প্রথম ধাপে উঠে এলাম। সামনে আরেকটি স্তুপা দেখে সেই মুখী আরোহণ শুরু করলাম। দ্বিতীয় স্তুপার কাছে পৌঁছাতেই আমরা একটি রিজলাইনে (শৈলশিরা) চলে এলাম।
আমাদের ডান পাশের কাং ইয়াৎসের তুষারশুভ্র ঢালে জ্যোৎস্নার আলো ঠিকরে পুরো উপত্যকাকে আলোকোজ্জ্বল করে দিয়েছে। হেডল্যাম্প নিভিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে বসে রইলাম দুজন। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবারও চাঁদের আলোয় আরোহণ শুরু করলাম।
৫ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতা থেকেই পথে তুষার জমে আছে। আরও ঘণ্টাখানেক পর রাত প্রায় তিনটার দিকে আমরা ক্রাম্পন পয়েন্টে পৌঁছাতে পারলাম। অভিযানের কঠিন অংশ এখান থেকেই শুরু। আমাদের এখন জমাট বাঁধা তুষারের ওপর দিয়ে চলতে হবে। একটি পাথরে বসে বুটের সঙ্গে ক্রাম্পন (পর্বতারোহণের জন্য জুতার নিচে পরা বিশেষভাবে তৈরি তীক্ষ্ণমুখ লোহার পাত) সেট করে নিলাম। বুটের ভেতর তুষার যেন ঢুকতে না পারে, তাই গেইটার (হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত কাপড়ের আবরণ) বেঁধে নিলাম। হালকা কিছু নাশতা আর পানি খেয়ে আমাদের আরোহণের দ্বিতীয় ধাপ শুরু করলাম।
ভেবেছিলাম, এত ঠান্ডার মধ্যে তুষারের অবস্থা বেশ পোক্ত থাকবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, কাং ইয়াৎসের তুষার বড় বড় দানার বালুর মতো হয়ে আছে। তুষারকণাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি লেগে নেই। সবই ঝুরঝুরে হয়ে আছে। পা দিলেই হাঁটু পর্যন্ত দেবে যাচ্ছে। আমরা দুজন আগের অভিযাত্রীদের ট্রেইলটাই অনুসরণ করছিলাম। আগের রাতের তুষারপাতে ট্রেইল ঢেকে গেলেও অনুসরণ করার মতো পথরেখা বোঝা যাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক ওই ঝুরঝুরে তুষারের মধ্য দিয়েই ট্রেইল ব্রেক করে এগিয়ে গেলাম। তখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মিটার আরোহণ করে ফেলেছি। এরপরই আশ্চর্য এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম।
এই আলো স্বর্গের দ্বার খোলার মতো
প্রায় ছয় হাজার মিটার উঁচুতে বসে পৃথিবীতে সূর্যোদয় দেখার অনুভূতিটি ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। রাতেও চাঁদের আলো ছিল, সেই আলোতেই আমরা আরোহণ করেছি। কিন্তু এই আলো অন্য রকম, এই আলো স্বর্গের দ্বার খোলার মতো।
একদিকে সূর্যোদয় হচ্ছিল, আরেক দিকে আমাদের উদ্দেশে একটি হেডল্যাম্পের আলো দ্রুত এগিয়ে আসছিল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, যে পথ উঠে আসতে আমাদের তিন ঘণ্টা লেগেছে, লাইট মাথায় লোকটা সেই পথই তরতর করে আধঘণ্টায় চলে এলেন। কাছে এলে জানলাম, তিনি দোর্জে শেরপা। ভারতীয় দলের শেরপা। শেরপাদের কেন অতি উচ্চতার একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়, আরেকবার তা নিজ চোখে দেখলাম।
দোর্জে সামনে এসে এতদূর পর্যন্ত শেরপা ছাড়া ট্রেইল ব্রেক করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন। সেই সঙ্গে আমাদের সাহসেরও তারিফ করলেন। তাঁর কাছে একটুকরা কেক ছিল, আমাদের দুজনকে সেটি ভাগ করে দিলেন। আমরাও তাঁকে খেজুর খেতে দিলাম। ততক্ষণে ভারতীয় দলের বাকি সদস্যদের দেখা গেল। গুটি গুটি পায়ে রোপ আপ করে তাঁরা সবাই ওপরে উঠে আসছেন। আমি আর ওজিল সিদ্ধান্ত নিলাম, আর আগে আগে যাব না। দোর্জে শেরপা যেহেতু চলে এসেছেন, আমরা তাঁর পেছনে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
ভারতীয় দলের বাকি সদস্যরা ওপরে আসার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও ট্রেইল ব্রেক করা শুরু করলেন দোর্জেজি। তাঁর পেছন পেছন আমরাও আরোহণ করতে লাগলাম। একসময় পথ শেষ হলো। রিজলাইনের শেষ অংশটুকু আরোহণ করে আমরা কাং ইয়াৎসে-২–এর চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। হাতের ঘড়িতে তখন উচ্চতা দেখাচ্ছে ৬ হাজার ২৫৪ মিটার। সামিট করা সবাই একসঙ্গে মুহূর্তটি উদ্যাপন করলাম। এরপর নেমে আসার পালা। অভিযানের এখনো অনেক বাকি।